Sunday 20 October 2013

ভাবনা কথন

এক
এলোমেলো খাপছাড়া ভাবনার ফাঁক গলে
টুক করে ঢুকে পড়ে রঙিন প্রজাপতি;
আঁকিবুঁকি ডানায় ভর করে স্বপ্ন,
ভাসে সীমাহীন...
মরা ধূসর সাগরের তল ছেনে তুলে আনে
সোনালী ঝিনুক
বুকে তার লুকানো ছিল
গোলাপি মুক্তো...

দুই
ভাবনাগুলো
শীতের বিকেলে বাদামী ধানক্ষেতে
কুয়াশার মেঘ হয়ে জমতে না জমতে
বলা নেই কওয়া নেই
ধুপ করে সন্ধ্যে নামার আগে
মিলিয়ে যায়...

তিন
সাগরের প্রিয় রঙ কি?
আকাশ তাকে বলে দিবে।
জলকণাগুলো কি রঙে সাজবে আজ?
সেও আকাশ বলে দিবে।

Tuesday 9 April 2013

জয়িতা, গর্ভধারিনী, সমরেশ মজুমদার

গর্ভধারিনী জয়িতাঃ

 

উচ্চবিত্ত পরিবারের স্বাধীনচেতা মেয়ে জয়িতা। তবে সমাজের উঁচু শ্রেনীর আর দশটা মেয়ের মত সে নয়। নয় বিলাসিকতায় গা ভাসানো ঝকমকে এক্সপেন্সিভ শোপিস মাত্র। বিত্তশালীদের বৈভব-বিলাসিতার ভেতরকার নগ্ন-উন্মুক্ততায় তার দমবন্ধ হয়ে আসে। প্রতিবাদী সে আচরণে, প্রতিবাদী বেশভূষায়। ভাবনা-চিন্তায় সে স্বচ্ছ ও গতিশীল। চরিত্রে নেই তার ন্যাঁকা-ভণিতাসুলভ কোনো দিক।

কল্যাণ, সুদীপ, আনন্দ জয়িতার বন্ধু। জয়িতার সাথে প্রেসিন্ডেন্সিতে পড়ে। তার মতই মেধাবী ও স্পষ্ট চিন্তার মানুষ তারাও। জয়িতার বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো দিক হলো, তারা কেউই তাকে মেয়ে বলে আলাদা খাতির অথবা বৈষম্য করে না। জয়িতা তাদের চোখে কেবল মেয়ে নয় বরং একটা মানুষ, তাদের বন্ধু। বন্ধুত্বের সম্মানটুকু জয়িতা তাদের চোখে দেখতে পায়। সস্তিবোধ করে তাদের সঙ্গ ও বন্ধুত্বে। চারজনের মধ্যে যে জিনিসটা কমন ছিল, তা হলো - প্রত্যেকে স্বপ্ন দেখতো একটা শ্রেণীহীন সমাজের, যেখানে ধনী-গরীব থাকবে না, সবার জীবনযাত্রার মান একই হবে, মানুষ শুধু নিজেকে নিয়ে ভাববে না বরং সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নে সমান ভূমিকা রাখবে। তারা স্বপ্ন দেখে দুর্নীতিমুক্ত, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, মানুষের ভেতরের কুসংস্কার ও অসচেতনতা মুক্ত সত্যিকারের স্বাধীন এক সমাজের, স্বপ্ন দেখে পরিবর্তনের। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়ানো বৈষম্যের কুৎসিত রূপটা তারা ঘৃণা করে, তাই দুর্নীতিগ্রস্ত ঘুণে ধরা সমাজের ক্যান্সারে আক্রান্ত কোষগুলোয় সজোরে আঘাত করে নির্মূল করা ছাড়া আর কোন পথ দেখে না... বয়সে তারা তরুণ, রক্তে পরিবর্তনের নেশা, সমাজ বদলানোর এই গুরুভার তারা নিজেরাই নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়। বেটার নাও দেন নেভার, কিছু একটা করতে হবে, এখুনি...

বেছে বেছে তারা আঘাত করে সমাজের প্রকৃত বাস্তবতা থেকে পুরাই বিচ্ছিন্ন বৈষম্যের জলজ্যান্ত উদাহরণ বিত্তশালীদের নির্লজ্জতার প্রধান আখড়াগুলোতে, যা অচিরেই সমাজের প্রচলিত আইন-কানুন ও শিল্পপতি/বুর্জোয়াগোষ্ঠীদের আঁতে ঘা লাগায়। ক'টা বিছিন্ন তরুণ-তরুণীর এই খামখেয়ালী তারা মেনে নেবে কেন। তার উপর যাদের মাথায় উপর নেই কোন পলেটিক্যাল শেল্টার। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার পরিণতি হয় ভয়ানক, বুর্জোয়া ও রাজনীতিবিদদের রোষানলে পড়ে তারা বাধ্য হয় শহর ছাড়তে। আশ্রয় নেয় দুর্গম, বৈরী জলবাতাস-পূর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলে। জয়িতা ও তার বন্ধুরা কেবল পরিবর্তনের ফাঁপা বুলি আওড়ায় না, পরিবর্তনকে তারা ধারণ করে নিজের মধ্যে। যে কারণে শহর থেকে পালিয়েও থেমে থাকে না তাদের ভেতরের সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত উপায়ে সমাজ পরিবর্তনের স্পৃহা - সেই দুর্গম পাহাড়ি মাটিকেই তারা বেছে নেয় স্বপ্ন সার্থকের ভূমি হিসেবে। সেখানের মানুষের নির্দিষ্ট আয়, কো-অপারেটিভ ডেয়ারি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে মানসিক সুস্থিতি ফেরাতে তাদের সংগ্রাম শুরু হয় নব উদ্যমে।

জয়িতা নির্ভেজাল এক বিপ্লবী নারী, পরিবর্তন স্পৃহা মিশে আছে তার অস্তিত্বে। যার জ্বলন্ত প্রমাণ সে দিয়েছিলো সেই পাহাড়ি মানুষদের মাঝে সত্যিকার অর্থে মিশে যেয়ে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী পুরুষটিকে ভালোবেসে তার সন্তান নিজ গর্ভে ধারণ করে। ধনী পরিবারের শহুরে ও শিক্ষিত মেয়ে হয়েও জয়িতা গ্রামের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের তাগিতে নির্দ্বিধায় হয়ে ওঠে তাদেরই একজন। শহরের তথাকথিত আধুনিক মানুষগুলোর ভেতর সে দেখে - "পুরু চামড়ার নখদন্তহীণ চোখের পর্দা-ছেঁড়া আত্নসম্মানহীন কয়েক লক্ষ বাঙালী গর্তে মুখ লুকিয়ে এ ওকে গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে।" গ্রামের পাহাড়ি মানুষগুলো বরং তার কাছে ভণিতাহীন, অকৃত্রিম ও স্বচ্ছ।



সমরেশ-কে অনেককেই পোড় খাওয়া কমিউনিস্ট বলতে শুনি। এখানে বলে রাখা ভালো, লেখকের ব্যক্তিগত বিশ্বাস নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আমার আগ্রহ তার লেখা বা প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা প্রিয় চরিত্রগুলোতে। আমার কাছে লেখক যদি তার লেখার মধ্যে বাস্তবতাকে তুলে না ধরে, তাহলে তা হবে রূপকথা। আর রূপকথাতে আমার আগ্রহ বরাবরই কম। আলবার্তো মোরাভিয়া'র মতে, বাস্তবতাকে সফলতার সাথে তুলে ধরতে হলে, লেখকের নিজের ভেতর যা থাকা আবশ্যক, তাহলো - স্পষ্ট রাজনৈতিক, সামাজিক এবং দার্শনিক ধারণার ভিত্তিতে নিজস্ব একটা নৈতিক অবস্থান গ্রহণ... এবং সেই নৈতিক অবস্থানটিই হয়ে ওঠে তার লেখার প্রাণ। যদিও মোরাভিয়ার মতে অবশেষে - "A writer survives in spite of his beliefs." গর্ভধারিনী-তে সমরেশকেও আমার কাছে সমাজ বাস্তবতার আলোকে নিজের বিশ্বাস টিকিয়ে রাখতে রীতিমত হিমশিম খাওয়া সংগ্রামরত উপন্যাসিক মনে হয়েছে। পুরো উপন্যাস জুড়ে তিনি নিজের ভেতরের শ্রেণীহীন সমাজের প্রত্যাশা তুলে ধরতে যেয়ে প্রচলিত সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেকে অস্বীকার করতে পারেননি। উপন্যাসের মূল চরিত্র জয়িতার মধ্যেও আমি সমরেশের শ্রেণীহীন সমাজের সেই আত্নীক দাবী দেখতে পাই - যা কেবলমাত্র অর্থনৈতিক সমতার দাবী নয়, বরং নারী-পুরুষের ভেদাভেদহীন, কুংস্কার-অসচেতনতা-জড়তা মুক্ত, সত্যিকারের বৈষম্যহীন স্বাধীন এক সমাজের প্রতি তার আকংখার প্রতিফলক।

আমার জীবনের নানা অভিজ্ঞতায় আমি এমন অনেক মেয়ে দেখেছি - যারা রোদে বের হতে চায় না কালো হবার ভয়ে, কাদা-মাটি ছোঁয় না হাতে ময়লা লাগার ভয়ে, পানি ধরে না নেইল পলিশ উঠে যাবে বলে... ছুরি-কাঁটাচামুচ ধরার স্টাইলে বা কথায় ইংলিশ এক্সসেন্ট দিয়ে তারা বিচার করে কে কতটা স্মার্ট অথবা ক্যালাস। নিজের চারপাশে একটা অভেদ্য দেয়াল তারা সমসময় তুলে রাখে, কাউকে এর ভেতরে নেয় না, নিজেও এর বাইরে বের হয়না। পুরো পৃথিবীটাই এদের কাছে হাইলি আনহাইজিনিক, সাসপিশাস। আমি তাদের সম্পর্কে ভাল বা খারাপ কোনরকম মন্তব্য করছি না, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এরকম সঙ্গ অল্পেই আমার ভেতর বিরক্তি ধরায়, আমার দমবন্ধ হয়ে আসে, এদের কাছে থেকে আমি হরহামেশাই পালিয়ে বাঁচি। যারা জীবনে চ্যালেঞ্জ নিতে জানেনা, অচেনা পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা রাখেনা, মাটি-পানি-আলোর সংস্পর্শে আসেনা, তাদের প্রতি আমার শুধুই করুণা। তারা নিজেরাও জানেনা বাস্তবতা থেকে তারা কত দুর, জীবন থেকে কত দুরে। একই কারণে জয়িতার জীবনের চ্যালেঞ্জিং ক্ষমতা আমাকে টানে, মুগ্ধ করে, উৎসাহ দেয়... তাই জয়িতা আমার কাছে আকর্ষণীয়, আধুনিক, স্পষ্ট ও স্মার্ট।

Wednesday 20 March 2013

উপন্যাসের প্রিয় চরিত্রগুলো (তৃতীয় পর্ব)

দীপার সাতকাহনঃ



আসামের চা বাগান, গাছগাছালি, বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদীটার উপর রাতের জোনাকীর খেলা, চাঁপার ঘ্রাণ আর খুব ভোরে শিউলি কুড়ানো - দীপার গল্প যেন প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা প্রতিটি মেয়ের গল্প। মায়ের চোখরাঙ্গানি, পিটুনি, ঠাকুমার নিষেধ উপেক্ষা করে সে ছুটে যায় বার বার খোলা মাঠ, পথ-ঘাট পেরিয়ে - কখনো ফুল কুড়োতে তো কখনো বড়শী নিয়ে বন্ধুদের সাথে মাছ ধরতে। আশ্চর্য! প্রকৃতি তো বাছবিচার করে না তার অকৃত্রিম-অফুরন্ত রং-রূপ ঢেলে দিতে ছেলে অথবা মেয়ের। তার বন্ধু খোকন আর বিশু ছেলে, তাতে কি! ওদের কাছেও তো আঙরাভাসা নদীটা নীল আর চা বাগানগুলো সবুজ, একই রঙ একই গন্ধ। তাহলে কেন মা-ঠাকুমার যত বিপত্তি তার মেয়ে হয়ে বাইরে যাওয়ায়। খোকন, বিশুরা ফড়িং বা মাছ ধরতে যেতে পারলে সে পারবে না কেন? ওরা হাঁটুর উপরে প্যান্ট পরলে কোন দোষ নেই - অথচ দেয়াল টপকে পার হতে, গাছে উঠতে বা কোছা ভরে ফুল কুড়োতে তার যদি একটু হাঁটু বের হয়েই যায়, তাতেই বা কি এমন দোষ? এরকম চারপাশের প্রকৃতির প্রতি একটি শিশুর সরল-সহজাত আকর্ষণ, আর পদে পদে বাধা পেয়ে অন্ধকারে নিত্য আলোর শিখা খুঁজতে থাকার মতই তার ছোট মনে দানা বেঁধে উঠতে থাকা মেয়েদের উপর সমাজ আরোপিত নানা বিধিনিষেধের প্রতি প্রশ্ন। যার উত্তর একটাই - সে মেয়ে!

দুঃস্বপ্নের মত দীপার জীবনে সেই তের বছরেই জড়িয়েছিল এক নিষ্ঠুর অতীত। শুধুমাত্র উত্তরাধিকারের জন্যে এক আত্নকেন্দ্রিক ধনী পরিবারের রোগাক্রান্ত, মৃতপ্রায় ছেলের সাথে তার বিয়ে দেয়া হয়। কিছু ভয়ানক অভিজ্ঞতা বুকে নিয়ে সেদিন পালিয়ে বেঁচেছিল সে। এই অপরিনামদর্শি, জীর্ন বাঁধন নিশ্চিতভাবেই তার ভাগ্যে রেখে যায় বিধবার কালো দাগ। জীবনের এই নির্মম অধ্যায় মুছে ফেলে সে শুরু করতে চেয়েছে নতুন জীবন। পুঁজি ছিল প্রতিকূলতায় হার না মানা তার দৃঢ় মনোবল। কঠোর পরিশ্রমে গড়ে নিতে চেয়েছে নিজের ভাগ্য। সাথে তার স্রোতের মত গতিশীল মনে ঝড় তুলত নানা প্রশ্ন, যার উওর সে পায়নি কারুর কাছে - বিধবারা পেয়াজ, ডিম, মাছ-মাংস খেলে কি হয়? কেন মেয়েদের পদে পদে কঠোর অনুশাসনের মধ্যে না চললে ভগবানের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে? কোন ভগবান? কি তার নাম? ধর্মের এই একচোখা নিয়মগুলোর বিরুদ্ধে এভাবেই তার ভেতরে ফুটে ওঠে প্রতিবাদী স্বাধীনচেতা এক রূপ।

দীপাবলী এমন এক চরিত্রের নাম, যাকে ভাগ্যদেব সুপ্রসন্ন হয়ে কখনো নিরবিচ্ছিন্নভাবে কিছু দেয়নি। বেঁচে থাকার জন্য, সমাজে নিজের জায়গা করে নেয়ার জন্য যাকে প্রতিটি মুহূর্ত লড়ে যেতে হয়েছে - কখনো পারিপার্শ্বিকতার সাথে তো কখনো নিজের সাথে। কঠোর পরিশ্রমে অর্জন করে নিয়েছে আয়করের চাকুরী, সম্মান, প্রতিষ্ঠা, বেছে নিয়েছে জীবনসঙ্গী। তারপরেও তার লড়াই থেমে থাকে নাই। আত্নমর্যাদা ও আদর্শের লড়াই আপনাআপনি কখনো থামে না, তার উপর দীপা নারী, আর নারী মাত্রই তো এসব ঠুনকো অনুভূতি বিসর্জন দিতে দিতে প্রাণহীন কাঠপুতুল হয়ে টিকে থাকা, নয়তো বা নিছক ঐ এক আত্নমর্যাদা আঁকড়েই জীবনে চরম কিছুর মূল্য দেয়া। দীপা আপোষ করার মেয়ে নয়। স্বপ্নপূরণ ও মুক্তির আশায় সে কারুর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে না। আপনজন, কাছের মানুষের আত্নকেন্দ্রিক লোভী চেহারাগুলো তাকে ক্ষতবিক্ষত করলেও নিজের নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে সে থেকেছে অনড়। এবং সবশেষে সে আপোষহীন, অবিচল ও একা।



লেখক সমরেশ মজুমদার তার জনপ্রিয় উপন্যাস 'সাতকাহন' এর দীপাবলী-কে এঁকেছেন আপোষহীন সংগ্রামী এক নারী চরিত্র হিসেবে। কেন দীপাবলীর মত এমন একটি চরিত্রটি তার মনে এল এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন - "আমি এগারো বছর বয়সের একটি বিধবা মেয়ে দেখেছিলাম। সে আমাদের চা বাগানের। তাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল এত সুন্দর, কোমল, নিষ্পাপ একটি মেয়ে কেন এভাবে হারিয়ে যাবে? শেষ হয়ে যাবে? সাতকাহন লেখার সময় সেই মেয়েটিকেই আমি আমার মতো করে রূপ দিয়েছি। তাকে সমাজ, সংসারের বেড়াজালের ভেতর দিয়ে আমি পরিপূর্ণ মানুষ করে তুলতে চেয়েছি।" দীপাবলীর একা থেকে যাওয়াটা অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি, এব্যাপারেও লেখকের বক্তব্য স্পষ্ট - "বাংলাদেশের মেয়েরা যে আত্নমর্যাদাসম্পন্ন এটা আমাদের শ্রদ্ধার সঙ্গেই মনে রাখা দরকার।" একাধিকবার এই দীপাবলিকে টেলিভিশন ও সিনেমার পর্দায় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে, তবে তা উপন্যাসের দীপার মত করে আদৌ কারো মনে দাগ কাটতে পেরেছে কিনা সন্দেহ!

দীপার জীবনের সাতকাহনের মাঝে আমি শুধু আমাকে নয়, বরং চেনা-অচেনা অসংখ্য মেয়েকে দেখতে পাই, পুরো দুই খন্ডের বিশাল এই উপন্যাস জুরে কোথাও না কোথাও, বিন্দু বিন্দু হলেও অনেকেই ভেসে ওঠে আমার মানসপটে। ছোট দীপার সাথেই বা আমি নিজের এত মিল পাই কেন, কে জানে! হয়ত মফঃস্বলে বেড়ে ওঠা আমি খুব সহজে চিনে ফেলি দীপার ফুল, পাখি, জোনাকির প্রতি সেই চিরচেনা অদম্য আকুতি। তারউপর মেয়ে হয়ে জন্মে আমিও চলতে-ফিরতে-উঠতে-বসতে শুধু 'না' শুনেই অভ্যস্থ। আমার চেয়ে বছর দু'য়েক ছোট ভাইটা বাড়ির পেছনের খোলা মাঠে ইচ্ছে মতো ছুটতে পারবে, আমি 'না'... পাড়ার একই বয়সি ছেলেদের সাথে ও খেলতে পারবে, আমি 'না'... এছাড়া্‌ও, যখন খুশি বাইরে যেতে পারব না, ফুটবল/ক্রিকেট খেলতে পারব না, নিজের জমানো টাকায় ইচ্ছেমতো দোকান থেকে শখের কিছু কিনতে যেতে পারব না... জোরে কথা বলতে পারব না, আস্তেও না... হাসতে পারব না, কাঁদতেও না... আমার এ 'না'এর পালা যেন অনন্তকাল ধরে চলতেই থাকে... এত শত 'না' এর মাঝে যখন নিজেকে হারিয়ে যাওয়া কেউ লাগতে থাকে তখন দীপার কথা ভেবে আমি শক্তি পাই। কারণ দীপা আমার ভেতরে একই থাকে, সে কখনো হারায় না।

জীবন সংগ্রামে হাল ছেড়ে দেয়া, সমাজ কর্তৃক গুঁড়িয়ে দেয়া আত্নসম্মান নিয়ে দিকজ্ঞানশূন্য অসহায় কোন মেয়ের কাছে জীবনকে পুনরুজ্জীবিত করে নতুন আঙ্গিকে দেখতে, পারিপার্শ্বিকতার সাথে নিজ আদর্শের সংঘর্ষে শক্তি যোগাতে, সাধ ও স্বাধীনতা অর্জনে দীপাবলীর সংকল্প ও সংগ্রামের গল্প মূলত এক দৃষ্টান্ত।

Tuesday 12 March 2013

উপন্যাসের প্রিয় চরিত্রগুলো (দ্বিতীয় পর্ব)

 চেজিরা, টু উইমেন, আলবার্তো মোরাভিয়াঃ


'টু উইমেন' মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত দু'জন নারী চেজিরা ও তার কিশোরী মেয়ে রোসেতার গল্প। সরল ও নরম মনের, সৃষ্টিকর্তায় অগাধ বিশ্বাসী মেয়ে রোসেতার তুলনায় মা চেজিরা কিছুটা রুক্ষ, অস্পষ্ট হয়তো বা জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে কঠোর, সমাজের পুরুষ দৃষ্টির কাছে সে আবেদনময়ী এক নারী কেবল, তাও আবার একা। অথচ ভেতরের সবটা জুড়ে সে শুধুই মমতাময়ী এক মা, যুদ্ধের নির্মমতা হতে যে ঢাল হয়ে আগলিয়ে রাখতে চায় তার কোমলমনা শিশুকন্যাটিকে। তারা বাস করত রোমে, বিধবা চেজিরা সেখানে একটি দোকান চালাতো।

চেজিরা অসম্ভব শক্ত মনের এক ইতালিয়ান নারী। তার চরিত্রে বিধবার অসহায়ত্বের বদলে ছিল দাম্ভিকতা ও দৃঢ়তার স্পষ্ট ছাপ। নিজের ও মেয়ের দেখাশুনা করতো সে অসাধারণ গর্ব ও দক্ষতার সাথে। কিন্তু যুদ্ধ তার সবকিছু উল্টেপাল্টে দেয়। যুদ্ধ মানে অনিশ্চয়তা, যুদ্ধ মানে আতংক। যুদ্ধ মানুষকে দিয়ে এমন অনেক কিছু করায় যা হয়তো সে স্বাভাবিক জীবনে কখনো কল্পনাও করতে পারে না। এরকম নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে গল্পের শুরুতেই চেজিরার ভেতরের অনেক চাপা হতাশা, গ্লানি বেরিয়ে আসে।


জার্মান বাহিনীর রোম আক্রমণের শুরুতেই চেজিরা তার মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে দক্ষিণের অপেক্ষাকৃত অনুন্নত, পাহাড়ি গ্রামাঞ্চলে আশ্রয় নেয়। সাথে নেয় তার সারাজীবনের সঞ্চিত কিছু অর্থ। কিন্তু যুদ্ধের বাস্তবতায় তার সেই অর্থ দ্রুত মূল্যহীন বস্তুতে পরিণত হয়, যেখানে এক টুকরো পনীর বা এক খন্ড রুটি হয়ে ওঠে সোনার চেয়ে মূল্যবান, কারণ ক্ষুধার জ্বালা কেবল খাদ্যই দুর করতে পারে, স্বর্ণ বা অর্থ নয়। আর দশটা সহায়সম্বলহীন রিফিউজির সাথে তাদের কোন তফাৎ থাকেনা, উপরন্তু গ্রামের নীতিহীন, সুযোগসন্ধানী মানুষের আচরণে তাদের জীবন আরো দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। দীর্ঘ নয় মাস তারা ঠাণ্ডা, ক্ষুধার সাথে যুদ্ধ করে মানবেতর জীবন কাটাতে থাকে এবং অপেক্ষা করতে থাকে তাদের জন্য যারা আসলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। অপেক্ষা করতে থাকে দুর্দশা থেকে মুক্তির, অপেক্ষা করতে থাকে মিত্রবাহিনীর। একসময় চেজিরা জয়ের খবর পায়, খবর পায় মুক্তির সেই কাংখিত আশ্বাস নিয়ে মিত্রবাহিনীর মহানায়কদের আগমনের। যদিও জয়-পরাজয় নিয়ে চেজিরা ততটা উৎকণ্ঠিত ছিল না, যতটা সে অধীর ছিল ফেলে আসা শান্ত-সুন্দর-নিশ্চিত জীবনটার জন্যে। সে শুধু জানতো তাদের ফিরে যেতে হবে, আবার সবকিছু আগের মতো করে পেতে।

অথচ জয় তাদের জন্যে আনন্দের বদলে বরং আরো নির্মমতা বয়ে আনে। যখন ফেরার পথে চেজিরার বহু প্রতিক্ষিত সেই হিরোদেরই এক অংশ মরোক্কান সৈন্যরা গির্জার ভেতর মাদার মেরীর মূর্তির সামনেই কিশোরী রোসেতাকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে, চেজিরাকে মেরে অজ্ঞান করে দেয়। সেদিন চেজিরার অভিযোগ কেউ শুনেনি, তার ধর্মভীরু ছোট মেয়েটিকে না বাঁচিয়ে মাদার মেরীও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিষ্পলক চেয়ে ছিল, যেন আসলেই সে নির্জীব পাথুরে মূর্তি মাত্র। রোসেতার সরল মনে এই বর্বরতা ভয়াবহ প্রভাব ফেলে, তার শরীরের মতো মনের বিশ্বাসও দুমড়ে-মুচড়ে যায়। মায়ের সাথে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে, জীবনের ইতিবাচক মূল্যবোধগুলো বিসর্জন দিয়ে সে একটা উশৃংখল পতিতার মতো জীবন কাটাতে শুরু করে। নানা ঘটনা পরিক্রমায় অবশেষে তারা রোমে ফিরে, যুদ্ধ শেষ হয়, রেখে যায় দুটি নারীর জীবনে অমোচনীয় কিছু ক্ষত।

যুদ্ধের ধ্বংস ও যন্ত্রণার তীব্রতা যে কেবল রণক্ষেত্রের ভেতর নয়, বরং তার বাইরেও সমান ছাপ ফেলে সেই বাস্তবতাই লেখক আলবার্তো মোরাভিয়া এই দু'টি অতি সাধারণ নারী চরিত্রের ভেতর দিয়ে নিখুঁত ও যথাযথভাবে তুলে ধরেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে লেখক নিজে তার স্ত্রীসহ দীর্ঘ আট মাস পালিয়ে, লুকিয়ে বেঁচে ছিলেন। টু উইমেনে মা-মেয়ের নয় মাসের রিফিউজি জীবনের গতানুগতিক বর্ণনায় মোরাভিয়া তার নিজের সেই অনন্য মূল্যবান অভিজ্ঞতাগুলোকেই হয়তো বিস্তারিত আওড়ে গেছেন। প্রাসঙ্গিকভাবেই চেজিরাকে তিনি এঁকেছিলেন শক্তিশালী এক নারী চরিত্র হিসেবে। যে কারণে এ চরিত্রটিকে সিনেমার পর্দায় তার নিজ স্বকীয়তায় ঠিক ঠিক উপস্থাপনের ফলেই ১৯৬০ সালে একটি ইতালীয় ভাষার ছবি হয়েও অস্কারের সেরা অভিনেত্রীর পুরুস্কারটি লুফে নেন সোফিয়া লরেন।
 

আমি 'টু উইমেন' উপন্যাসটি পড়েছিলাম ২০০৭-এ। যা ছিল সেসময় আমার জীবনের অন্যতম দুঃসাহসিক কাজগুলোর একটি। এর আগে পর্যন্ত যুদ্ধ আমার কাছে ছিল দুর থেকে ভেসে আসা কান্নার করুণ সুরের মত অথবা '৭১ এর খান সেনাদের ভয়ে আমার কিশোরী মায়ের খড়ের গাদায়, চিলেকোঠায় লুকিয়ে বাঁচার দমবন্ধকর গায়ে কাঁটা দেয়া গল্প। অথচ সব যুদ্ধই যে পৃথিবীর সব নারীর কাছে একই বীভৎসতা নিয়ে হাজির হয় তা আমি জেনেছিলাম অচেনা এই নারী চেজিরা ও তার বারো বছরের মেয়ে রোসেতার কারণে। হয়তো আমার এই সামান্য বিশ্লেষণ-ধৃষ্টতায় চরিত্র হিসেবে চেজিরা এখনো পুরোটাই অভেদ্য ও অস্পষ্টই থেকে গেল। তবে এটুকু বলতে পারি সে আমার মনে সবসময় প্রবল শক্তিশালী ও আকর্ষণীয় এক চরিত্রের উদাহরণ হয়ে আছে এবং থাকবে।

Saturday 2 March 2013

উপন্যাসের প্রিয় চরিত্রগুলো (প্রথম পর্ব)

জীবনটা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়া উপন্যাসের কোনো চরিত্র না। যেখানে সুখ-দুঃখ, ভালোলাগা-মন্দলাগা, হাসি-কান্নার মত ছোটবড় প্রতিটি অনুভূতির গাঁট ধরা থাকবে অভিজ্ঞ কোন হাতের যাদুকরীতে। জীবনের প্রতিটা বাঁক বরং আরো অনেক বেশি বর্ণিল, আপেক্ষিক, অনিশ্চিত ও বৈচিত্র্যময়। কোথাও চরম আবার কোথাও নির্মল যা আগে থেকে অনুমান করা কঠিন। তারপরেও ভালো লাগা উপন্যাসের প্রিয় কোন চরিত্রের মাঝে প্রায়শই আমরা ফুটে উঠতে দেখি নিজের প্রতিচ্ছবি। অবাক হয়ে ভাবি এও কি সম্ভব! নিজের ভেতরের স্বপ্ন, ইচ্ছে, চেপে রাখা না বলা কথাগুলো নির্জীব কাগুজে ক'টা পাতায় কেমন করে এত সহজে প্রাণ পেয়ে গেল। আজ এরকমই কিছু উপন্যাস ও তার চরিত্র নিয়ে লিখতে বসলাম। যার ভেতরে অসংখ্যবার ভিন্ন সময়ে ভিন্ন আঙ্গিকে আমি আয়নার মত প্রতিবিম্বিত দেখেছি আমার চারপাশটা, প্রিয়-অপ্রিয়-চেনা-অচেনা মানুষ, কখনো নিজেকে...

 পার্ল এস. বাকের মাঃ 

মা হলো গ্রামের অতি সাধারণ পরিশ্রমী বর্গাচাষী নারীদের একজন। গ্রামীণ জীবনধারা, পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ, কঠোর পরিশ্রম এসবকিছুর সাথে একজন নারীর মনের কল্পনাবোধ, স্বপ্ন, মমতা, রাগ-ক্ষোভ-ঈর্ষা এরকম অনেক চেনা অনুভূতির অদ্ভুত সংমিশ্রণ ফুটে ওঠে এই এক চরিত্রের মধ্যে দিয়ে। পুরো উপন্যাস জুড়ে যে চরিত্রটিকে লেখিকা সম্বোধন করে যান কেবল 'মা' নামেই। মা ছাড়া অন্য নাম চরিত্রটির সাথে যায় না। 

এই সাধারণ গ্রামীন কৃষক রমণীর ভেতরের স্বপ্ন, সাধ, আকাংখাগুলোও আর দশটা মেয়ের মতই অতি সাধারণ। বর্গা নেয়া জমিটুকুতে সকাল-সন্ধা ঘাম ঝরিয়ে শস্য ফলানো, পুরো দিনমান বীজ বুনে সন্ধায় ঘরে ফেরার পথে কল্পনায় সে বীজ শীঘ্রই অঙ্কুর হয়ে চারা বের হবে এই ভাবনা তার মনকে অদ্ভুত সুখানুভূতিতে আচ্ছন্ন করে রাখে। ঘরে ফিরে সন্তানদের মুখে তৃপ্তির অন্ন তুলে দিয়ে তার সমস্ত ক্লান্তি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। মায়ের কোমলমতি মনের ভাগ থেকে বাদ যায় না বাড়ির কুকুর বা অন্য পোষা প্রাণীগুলোও, যাদের খাইয়েও মা সমান তৃপ্তি পায়। তারাও সন্তানের মতই দিনভর মায়ের ফেরার পথ চেয়ে থাকে। মায়ের অকৃত্রিম ভালবাসা ভরা মনটার প্রকাশ পায় এভাবেই নিজের সন্তান, শাশুড়ি ও বাড়ির প্রতিটি জীব যারা মাকে নির্ভর করেই বেঁচে থাকে তাদের প্রতি তার নিরলস দায়িত্ববোধ ও মমতা থেকে। সাথে নানা কাজের মাঝেও অন্ধ হয়ে আসা মেয়েটার ভাবনা মাকে অস্থির করে তুলে।

মা তার স্বামীকে ভালবাসতো। কারণ স্বামীর কারণে সে পেয়েছে সন্তানধারণের মত গর্ব। নিজের মাতৃত্বের ক্ষমতায় মা একজন গর্বিত নারী। স্বামীর আত্নকেন্দ্রিক সভাব, আড্ডা-জুয়া-বিলাসীতা, সংসার ও কাজের প্রতি অনীহা কারণে কখনো ভেতরের ক্ষোভ চেপে রাখতে না পেরে মা ফেটে পড়তো, এরকম সামান্য এক ঘটনার পর স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়, আর ফিরে না। দিনের পর দিন মা অপেক্ষা করে থাকে স্বামীর জন্যে, ভালো রেঁধে তুলে রাখে। সংসারের এতগুলো মানুষের দায়িত্ব এসে পড়ে মায়ের কাঁধে, যা সে একাই পরিশ্রম ও দক্ষতার সাথে পালন করতে থাকে। কিন্তু পৃথিবীর সবখানেই বুঝি কোন মেয়েকে তার স্বামী ছেড়ে যাওয়াটা সমাজের চোখে স্বামীর বা পুরুষের দ্বায়িত্বজ্ঞানহীনতার চেয়ে সেই মেয়েরই দোষ বুঝায়। আর অন্যেরাও তখন নিজের কাজ ফেলে সেই মেয়ের দোষ ঘাটতে অতিউৎসাহী হয়ে পড়ে। নিশ্চয়ই তার কোন দোষ আছে নাহলে স্বামী তাকে ছেড়ে যাবেই বা কেন, এরকম প্রশ্নে মায়ের নারীসত্ত্বা, অহমকে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে। যেকারণে মানুষের নানা প্রশ্নের নানা কটূক্তির জবাবে সে মিথ্যে বলা শুরু করে। গ্রামের মানুষের মুখ বন্ধ করতে শহরে গিয়ে স্বামীর নাম করে নিজের ঠিকানায় চিঠি লিখিয়ে নেয়া শুরু করে যে, স্বামী তার শহরে ভালো চাকুরী করছে। সবার মুখ বন্ধ হয়, মায়ের ভেতরের হাহাকার রয়েই যায়।

দ্বিগুণ পরিশ্রমে মাঠের কাজ, সংসারের ভরণপোষণে লেগে যায় মা। শরীর ও মনের জোরে হয়তো সে একজন পুরুষের চেয়েও বেশি ফসল ফলায়, সন্তানের মুখে ভালো খাবার তুলে দেয়, কিন্তু তারপরেও সে অন্যের চোখে রয়ে যায় একজন নারী হয়েই। যে কারণে খুব সহজে জমিদারের নায়েবের কুনজরে পড়ে এই স্বামী পরিত্যক্তা নারীটি। এখানে বলে রাখা ভালো যে, লেখক মা-কে ধরাছোঁয়ার বাইরে দোষগুণের উর্দ্ধে কোন দেবীর আসনে নেননি। মা-কে তিনি এঁকেছেন সাধারণ একজন নারী অথবা মানুষ হিসেবে। আর মানুষের আচরণে নিশ্চিত করে কিছু বলা মানে তার উপর জোড় করে কিছু চাপিয়ে দেয়া। যেখানে মানুষের আচরেন নিশ্চিত বলে কিছু নেই। ততদিনে স্বামী ফিরার আশাও মা বাদ দিয়েছে। উপরুন্ত স্বামীর ছেড়ে যাওয়ায় তার ভেতরে যে অপমানবোধ, যে ক্ষোভ জমেছিলো, তার শোধ নিতে চেয়েছে নায়েবের সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে। কিন্তু এখানেও মা প্রতারিত, লোভী নায়েবের পুরুষ দৃষ্টি যে শুধু মায়ের নারী শরীরটাকে চেয়েছিলো, তা বুঝে প্রথমবারের মতো সন্তান ধারণ তার কাছে গর্বের চেয়ে পাপবোধ ও আত্নানুশোচনার জন্ম দেয়। এ পাপ থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে সে শরীরের উপর চিরস্থায়ী যন্ত্রনার ছাপ নিয়ে।

মা একসময় বুড়িয়ে যায়, তার ছেলে সমর্থ হয়। ঘড়ে বউ এসে মায়ের স্থান নিতে থাকে, সেখানে চলতে থাকে ছেলের বৌয়ের সাথে চলে মায়ের কর্তৃত্বের সংঘাত। সংসারে তার স্থান অন্য কেউ নিয়ে নিচ্ছে তা মেনে নেয়া মায়ের কাছে কষ্টকর হয়ে পড়ে। উপন্যাসের শেষে মায়ের সবচেয়ে ছোট ছেলের জমিদারের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার মধ্যে দিয়ে চীনের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটে। জনসম্মুখে মায়ের চোখের সামনে নিজের প্রিয় সন্তানের মৃত্যদন্ড, চরম মানসিক বিপযস্থ অবস্থায়ও এক নব জাতকের কান্নার আওয়াজ মায়ের ভেতরে সব হারানোর মাঝেও কিছু পাওয়ার অনুভূতি জাগায়।

  
'মা' চরিত্রটিকে লেখিকার নিজের মূল্যায়নঃ পার্ল এস. বাক তার বিশাল উপন্যাস 'দা গুড আর্থ' এর পরপরই 'দা মাদার' লিখেন, যা লিখে তিনি নিজে খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। বিষয়টা আমার কাছে 'চোখের বালি' উপন্যাসে বিনোদিনী চরিত্রটির সাথে ন্যায় করতে না পারায় রবীন্দ্রনাথের ভেতরে যে আত্ননুশোচনা রয়ে গিয়েছিলো খানিকটা সেরকম লেগেছে। রবীন্দ্রনাথ যেমন সেকালের সমাজের বেড়াজাল থেকে হিন্দু বিধবা স্ত্রী বিনোদিনী-কে বের করতে পারেন নি, বাকও তেমন চীনের সে সময়ের সমাজ ব্যবস্থায় একটি নারীর একা থাকার যে যন্ত্রণা, সমাজের নিয়মকানুন পারিপার্শ্বিকতায় সে যন্ত্রণা আরো আরো তীব্র হয়ে ওঠা থেকে এই চরিত্রটিকে বের করতে পারেননি।

পুরো চরিত্রটির ভেতর লেখিকা নিজে নারী হিসেবে তার অনেক অনুভূতি, উপলদ্ধি ও চিন্তাভাবনা অকপটে লিখে গিয়েছেন যা একটু খেয়াল করলেই আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়, যেমন - মাতৃত্ব নিয়ে বাকের নিজের যে ভাবনা ও অব্যক্ত হতাশা তাও এই 'মা' চরিত্রটির মধ্যে স্পষ্ট ফুটে ওঠে।

মায়ের প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়নঃ প্রকাশক Peter Conn যিনি পরবর্তীতে বাকের দ্বিতীয় স্বামী ছিলেন, তিনি এই উপন্যাসটিকে “Pearl S. Buck: A Cultural Biography” বলে উল্লেখ করেন। 'মা' সম্পর্কে Peter Conn লিখেন - “veered perilously close to a personal confession, an unguarded glimpse into the secrets of her sexual and maternal frustration”। পার্ল এস. বাকের 'দা মাদার' উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৪ সালে। বলা হয়ে থাকে এই উপন্যাসটির মাধ্যমে বিশ্ব-সাহিত্যের পটে চীনের গ্রামীণ সমাজে নারীর অবস্থানের যথাযথ নিখুঁত চিত্রায়ণই তাকে এনে দিয়েছিলো ১৯৩৮ সালে নোবেল অর্জনের মত দুর্লভ খ্যাতি।

মা চরিত্র ও উপন্যাসটি আমার মূল্যায়নের দুঃসাহসঃ যদিও মায়ের স্বামীর তুচ্ছ ঝগড়ার জের ধরে রাগের বশে চলে যাওয়াটা বুঝা গেলেও, একবারে ফিরে না আসাটা আমার কাছে রহস্যই থেকে গেছে। তারপরেও এটা অস্বীকার করার উপায় নাই 'দা মাদার' উপন্যাসটি পড়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত এর কেন্দ্রীয় চরিত্র মা আমার ভেতরে আসে ঘুরেফিরে, বার বার। একজন স্ত্রী বা জননী হিসেবে নয় বরং একজন নারী হিসেবে এ চরিত্রটি আমাকে ভাবিয়েছে অনেক বেশি। বলতে গেলে আমার আশেপাশের অনেক জটিলতা, সমাজে নানা অবস্থানের নারীদের সীমাবদ্ধতা, প্রাপ্তি ও হতাশাগুলো চিনতে শিখিয়েছে নতুন করে, সম্মান করতে শিখিয়েছে নিজ নিজ অবস্থানে নিত্য টিকে থাকার চেষ্টারত প্রতিটি নারীকে। সাথে অবাক হয়েছি লেখিকার চরিত্রটির ভেতরে ঢুকে তা বিশ্লেষণের ক্ষমতা দেখে, তাই ভেবেছি হয়ত তিনি নিজেও একজন নারী ছিলেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। চীনের সেকালীন গ্রাম্য সমাজের রীতিনীতি ও কাঠামো পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণও লেখিকার নিখুঁত দৃষ্টি ও একটি প্রান্তিক সমাজের সাথে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা আমাকে মুগ্ধ করেছে।

Wednesday 27 February 2013

আমার শহীদ মিনার ভাঙ্গার অধিকার আমি কাউকে দেই নাই, আমার পতাকা অমর্যাদার অধিকার আমি কাউকে দেই নাই!

"দেশ, কাল ও শান্তির কথা ভেবে রয়েছি আমরা নীরব
যখন নীরবতা ওরা দুর্বলতা ভাবে রক্ত করে টগবগ"

রক্ত ফুটছে... এই খবরগুলো দেখে...

নাস্তিকতা আস্তিকতা যার যার ব্যাপার, ধর্মে কোথাও গায়ের জোরে কিছু করার কথা বলা হয়নি। শাহবাগ আন্দোলনের সাথে আস্তিকতা-নাস্তিকতা কেন জড়ানো হচ্ছে বুঝলাম না। এ আন্দোলন তো কোন ধর্মের বিপক্ষে নয়, বরং ধর্মকে যারা নিজেদের সুবিধায় ব্যবহার করে আসছে তাদের বিপক্ষে। ঠিক এই মুহূর্তে যেমন আন্দোলনকারীদের ইসলামের বিপক্ষে বা নাস্তিকতার লেবাস দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সুবিধাবাদী আচরণ এটাকে বলে। যেখানে সবাই জানে এই আন্দোলনের সূত্রপাত কিভাবে হয়েছে - কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় না হওয়ায় কিভাবে ক্ষোভের তীব্রতায় ফুঁসে উঠেছে দেশ এবং কিভাবে ধর্ম-বর্ণ, দল-মত সব ভেদাভেদ ভুলে নানা শ্রেনীর মানুষ নরপশুগুলোর ফাঁসির দাবিতে তরুণদের সাথে একাত্নতা প্রকাশ করেছে। রাজাকারের ফাঁসি ও জামাত শিবিরের মতো ধর্মভিত্তিক সুবিধাবাদী দলকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে ১৭ দিন আন্দোলন চলেছে, হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছে, কিন্তু কোথাও তো কোন বিশৃঙ্খলা হয়নি, আগুন জ্বলেনি, আতংক সৃষ্টি হয়নি। গায়ের জোরে ঘটনা ঘটানো হচ্ছে এখন, তার কারণটাও স্পষ্ট - ধর্মান্ধরা ওই একটা পন্থাই জানে।

'নাস্তিক' 'নাস্তিক' করে গলা ফাটিয়ে এই জামাত-শিবির নামের ধর্মান্ধ সুবিধাবাদী গোষ্ঠী আসলে কি বোঝাতে চাচ্ছে সেটা স্পষ্ট না। এভাবে ফাঁকা ঢিল ছুড়ে তারা আসলে কাকে আঘাত করতে চাচ্ছে? দাবি যদি ন্যায্য হয় এবং সেটা পূরণও যদি আবশ্যকীয় হয়, আর সে দাবির সাথে যদি দেশের অধিকাংশ মানুষ এক হয়, তখন আর সেটা কারো একার দাবি থাকে না, পরিণত হয় গণদাবীতে। তারপর সেটা করিম করলো না রহিম করল তা কোনো গুরুত্বপূর্ন বিষয় না। এখানে 'ইহুদী-নাছারা', 'নাস্তিক-আস্তিক' এসব শব্দ ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা অর্থহীন। কথায় কথায় পবিত্র গ্রন্থ, নবী-রাসূলের নাম ব্যবহার করে তারা মূলত নিজেরাই নিজের অনুভূতিকে সস্তা বস্তুতে পরিণত করছে, অন্য কেউ নয়। "জাত গেলো জাত গেলো বলে, একী আজব কারখানা"... এতো অল্পতে যারা নিজের জাত কুল রক্ষায় দিগজ্ঞানহীন উন্মাদ হয়ে পড়ে, তাদের মূলত গোড়ায় গলদ আছে, তাদের ঈমান প্রশ্নবিদ্ধ। তাদেরকে বলছি - দয়া করে আপনারা ধর্ম-কে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা বন্ধ করুন, প্লিজ! মানুষ ভালমন্দের তফাৎ করা জানে, সেটা মানুষের উপর ছেড়ে দিন। হুদা গেঞ্জাম সৃষ্টিকারীদের তো আল্লাহ্‌ও পছন্দ করে না।

যেমন মিথ্যাকে হাজারটা ফেক ছবি, ফটোশপ দিয়েও প্রতিষ্ঠা করা যায় না। তেমনি সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে মিথ্যার তকমার প্রয়োজন হয়না। পতিতা, গাঁজাখোর... শাহবাগ ওপেন সেক্স এলাকা, সেখানে ধর্ষণ হচ্ছে... এসব বলে কি আদতে আন্দোলনকারীদের কোন ক্ষতি করা গেছে না তাদের মনের জোর কমানো গেছে, বরং উল্টা নিজেদেরকেই সাধারণ মানুষের কাছে ধর্মবেশ্যায় পরিণত করেছেন আপনারা।

যেই শহীদমিনারে আমরা ছোটবেলা থেকে বাবা, চাচাদের হাত ধরে গিয়েছি, সন্মান ভরে স্মরণ করেছি সেই বীরযোদ্ধাদের যাদের আত্নবলিদানে আজকে আমরা প্রাণ ভরে মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারি, মনের কথা লিখতে পারি। পুরো বিশ্ব যে শহীদদের সম্মান দিয়ে ২১ ফেরুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে গ্রহণ করেছে। অথচ এদেশে থেকেও, এ বাংলা ভাষায় কথা বলেও কোন সাহস বলে আপনারা এই স্বাধীন দেশের শহীদ মিনারের গায়ে হাত দেন?!

আমার ছয় বছরের ছোট্ট ছেলেটাও জানে নিজ দেশের পতাকাকে কেমন করে ভালোবাসতে হয়, স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশনে সে নিজ হাতে জাতীয় পতাকা আঁকে, টিভি বা কম্পিউটারে কোথাও পতাকা দেখলে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে - "মা দেখো বাংলাদেশ"! অথচ সে জন্মের পর থেকেই আছে দেশের বাইরে। আর আপনারা কোন ধর্মগুরু, কোন কেতাবের দীক্ষায় যে দেশে আলো বাতাসে শ্বাস নেন, যে পতাকার তলে বেঁচে থাকেন, ছত্রাকের মত বংশবিস্তার করেন, সে পতাকাকে অমর্যাদা করার সাহস পান?! ছিঃ

ধর্মান্ধদের কাছে আমার প্রশ্নঃ কেন নাস্তিকতার অজুহাতে কাউকে নির্মমভাবে চোরা/গুপ্ত হত্যা করা হবে? কেন শহীদমিনারের মত বাঙ্গালীর আত্নঅনুভূতির কেন্দ্রে আঘাত করা হবে? কেন অহিংস কোনো আন্দোলনে সহিংস অস্ত্রধারী পান্ডারা আক্রমন করবে? যে দেশে বাস করছেন সেদেশের পতাকার প্রতি কেন সামান্যতম সম্মানবোধ আপনাদের জন্মালো না? কোন ধর্মে মানুষকে নিজ দেশের জাতীয় পতাকাকে অসম্মান করতে শেখায়? কোন ধর্মে এই পাশবিকতার দীক্ষা দেয়া হয়?


ছবিসূত্র
 
এরা ধর্মাদ্ধ, মানুষ নয়!

স্বাধীনতার চার দশক পরেও যারা একটি স্বাধীন দেশের পতাকা পুড়াতে পারে, শহীদ মিনার ভাঙতে পারে, তারা সেই দেশের জন্য কতটা পুষে রাখা কালসাপ! প্রকাশ্যে এ জঘন্য রাষ্ট্রদ্রোহীতার সামিল অপরাধ করেও কি তারা পার পেয়ে যাবে? যে দল একটি দেশের সার্বভৌমত্বের জন্যে স্পষ্টই হুমকি তা কেন নিষিদ্ধ করা হবে না? শুধু নিষিদ্ধই নয় বাংলাদেশের আইনানুযায়ী এধরণের রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধের যে শাস্তি, তাও তাদের দিতে হবে, দ্রুত! এ পতাকা কোন সস্তায় পাওয়া বস্তু নয়, এর সাথে যাচ্ছেতাই করার অধিকার কাউকে দেয়া হয় নাই!

আমার শহীদ মিনার ভাঙ্গার অধিকার আমি কাউকে দেই নাই, আমার পতাকা অমর্যাদার অধিকার আমি কাউকে দেই নাই!


জয় বাংলা!

Tuesday 12 February 2013

চেতনায় শ্লোগান

মাথায় খোলা আকাশ নির্ঘুম রাত
ঘুমিয়েছে চাঁদ, তারাগুলো ঝিমোয়
চারিদিকে তখনো উত্তপ্ত মিছিলের আঁচ
শ্লোগানে শ্লোগানময়

বিন্দু বিন্দু ঘাম শুষে নেয় নির্লজ্জ সূর্য্য
বাতাসে সেই ঘামের বাষ্প, জ্বলছে দুপুর
তখনো সেখানে তারা অক্লান্ত
মাথায় আগুন শ্লোগানে মুখর

রক্তে তাদের ঋনের ডাক
তালে তালে দোলাদোল
শুনছে সবাই, বিশ্ব অবাক
বাঙালীর হৃৎপিণ্ডের ডামাডোল

চেতনার রঙে রাঙিয়ে ব্যানার
পিশাচ বিনাশের প্রত্যয় নিয়ে
ব্জ্রহৃদয়টা বানিয়ে হাতিয়ার
অজস্র তরুণ আজ ঠায় রাজপথে

জেগে আছি আমিও পেরিয়ে মাইল হাজার
জান ভরে সেই শ্লোগান শুনি,
এক, দুই, তিন, চার - তুই রাজাকার, তুই রাজাকার
আর মনে শুধু মুক্তির দিন গুনি

Monday 11 February 2013

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে



































বাসায় একসময় একটা টিয়া পাখি আনা হয়েছিলো, তখন ছিল বাকের ভাইয়ের যুগ। মানে বিটিভিতে হুমায়ূন আহমেদের 'কোথাও কেউ নেই' নাটকের সময়কাল। তাই ওটার নাম রাখা হলো 'বাকের ভাই'। পাশের বাড়ির মীমরাও আমাদের দেখে একটা টিয়া কেনার জেদ ধরলো, শেষে সফলও হলো। ওদেরটার নাম রাখা হলো 'বদি'। তো বাকের ভাই আর বদি সারাদিন একসাথেই থাকে, কারণ মীম, মুন দু'ভাইও সারাদিন আমাদের বাসায় থাকে, স্কুলের সময়টা বাদ দিয়ে। আপুর খুব শখ বাকের ভাই আর বদি-কে দিয়ে 'তুই রাজাকার' বলাবে। সে শখ পূরণ করতে সারাদিন আমাদের পাখি দু'টোর খাঁচার সামনে বসে বলা লাগত - তুই রাজাকার, তুই রাজাকার... যদিও কাজের কাজ কিছু হয়নি, বাকের ভাই আর বদি 'তুই রাজাকার' বলায় কোনো আগ্রহ দেখানি। ওরা ওদের মত ক্যাঁ ক্যাঁ করেই যেত।

বদি ছিলো কিছুটা শান্ত স্বভাবের আর বাকের ভাই ছিলো পুরা দস্যি, অস্থির আর ছটফটে। মাঝে মাঝে অকারণেই সে তার গলা ফাটিয়ে ক্যাঁ ক্যাঁ করে চিৎকার শুরু করে দিত। আব্বা ভাবলো ছোট খাঁচায় বুঝি ওদের কষ্ট হচ্ছে, তাই বাঁশ দিয়ে ওত্যন্ত মেহনত আর দক্ষতার সাথে অসম্ভব সুন্দর দু'টো খাঁচা বানিয়ে দিলো। খাঁচাগুলো এতো সুন্দর হয়েছিলো যে সবাই এসে পাখি না দেখে মুগ্ধ হয়ে খাঁচাই দেখতো। আফসোস! তখন আমাদের কোনো ক্যামেরা ছিলো না, নাহলে হয়ত অন্তত একটা ছবি থাকতো সেই খাঁচা সাথে বাকের ভাই আর বদির! যাই হোক সুন্দর খাঁচায়ও বাকের ভাইয়ের অস্থিরতা কমে না। আব্বা আবিষ্কার করল যখন অন্য টিয়ারা ক্রমাগত চিৎকার করতে করতে ঝাঁক বেঁধে আকাশ দিয়ে উড়ে যায়, তখনই আমাদের বাকের ভাই অস্থির হয়ে ওঠে, চিৎকার করে অন্যদের জানাতে চায় যে সে আটকা পড়ে আছে। সেও তো একটা পাখি, খোলা আকাশটা তাকেও টানে পাখিদের মতই! এটা জানার পর থেকে আমাদের কষ্ট লাগা শুরু হলো তার জন্য। শেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো ওকে ছেড়ে দিব। মীম, মুন প্রথমে যদিও রাজি হয়নি শেষে ওরাও ওদের পাখিটাকে ছেড়ে দিয়েছিলো। 

যেদিন বাকের ভাইকে ছেড়ে দেয়া হলো, সেদিন আমাদের তিন ভাই-বোনের মনের অবস্থা ভাষায় প্রকাশ করার মত ছিলো না। সকাল থেকে খাঁচার দরজাটা খুলে রাখা হয়েছিলো, অথচ বাকের ভাই বের হচ্ছিলো না। হয়ত মানুষের নির্মমতায় অভ্যস্ত পাখিটি আকর্সিক এই মহানুভতার কোনো অর্থ খুজে পাচ্ছিল না। অন্যদিকে আমারা ভাবলাম সে হয়তো আমাদের ভালোবেসে ফেলেছে, তাই ছেড়ে যেতে চাইছে না। তারপরেও আব্বা তাকে খাঁচা থেকে বের করে উড়িয়ে দিলো, প্রথমে ও অল্প একটু উড়ে উঠোনের পেয়ারা গাছটাতে গিয়ে বসলো। শাটা এবার জোরেশোরে বুকে চেপে বসলো। আমি মনে মনে বলতে থাকলাম, বাকের ভাই যেয়ো না, যেয়ো না, প্লিজ... একসময় ও ঠিকই চলে গেল। আমাদের আশা তবুও কাপের তলানীর অবশিষ্ট চায়ের মত রয়েই গেল - মনে মনে ভাবতাম যখন ওর আমাদের কথা মনে পড়বে তখন ঠিক ফিরে আসবে। রোজ সকালে উঠে উঠোনের পেয়ারা গাছ, আশেপাশের সব ক'টা গাছে খুঁজতাম। আমাদের বাকের ভাই আর ফিরে আসেনি, ফিরে আসেনি মীমদের বদিও। শুধু টিয়াপাখিদের শেখানোর চেষ্টায় অনবরত আওড়ানো - 'তুই রাজাকার' আমাদের মগজে গেঁথে থাকলো। এরপর 'তুই রাজকার' অনেকদিন আমাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল বাজে কোনো গালি হিসেবে। যদিও 'রাজাকার' শব্দের ভেতরের প্রকৃত বীভৎসতা আমি বুঝেছিলাম আরো অনেক পরে।

 















আজ ছোট বেলার প্রিয় বাকের ভাইয়ের কথা খুব বেশি মনে পড়ছে, পাখিটার কষ্টটা এতদিনে আমি নিজের ভেতরে স্পষ্ট উপলদ্ধি করছি - যখন হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে প্রকাণ্ড অচিনপুরের লাল ধুলোর সাথে মিশে তাদের শ্লোগান -"রাজাকারের ফাঁসি চাই" আমার কাছে পৌছায়... আর খাঁচায় আটকে পড়া পাখির মত ডানা ঝাপটে ছটফট করা ছাড়া আমার কিছুই করার থাকে না। একই শ্লোগান তো আমারও ভেতরে। তাই চোখ বন্ধ করে আমিও তাদের সাথে সুর মেলাই। এই মিছিলে, এই কাতারে মিশে যেতে চাই। 

এ অক্ষমতার মাঝেও যে ভাবনা আমাকে অনেক বেশি স্বস্থি দিচ্ছে, তাহলো - চারপাশে এ শ্লোগানের রবে আমাদের পরের প্রজন্মের মগজে রাজাকার ও রাজাকারের ক্ষমার অযোগ্য পাপের চেহারাটা গেঁথে যাচ্ছে একই সাথে। আন্দোলনের এই অর্জনটাও আমার কাছে কম মনে হচ্ছে না।

 















রাজাকার তো রাজাকার, রাজাকারের শেকড়বাকড়, ফলপাকড়, বীজঅঙ্কুর পর্যন্ত মুক্ত সত্যিকারের স্বাধীন একটা বাংলাদেশ উপহার দিবো এই হোক পরের প্রজন্মের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার!

(ছবিগুলো সংগৃহীত)

Wednesday 23 January 2013

ভগ্নাংশ

গাড়ি চলছে ঝড়ের গতিতে। বাতাস চিরে বেরিয়ে যাওয়ার শাঁ শাঁ শব্দ আর ইঞ্জিনটার একঘেয়ে গোঙ্গানি। উইন্ডস্ক্রিনে আছড়ে পড়া কুয়াশা আর চোখের কোণে জমে থাকা মেঘ, সামনে দমবন্ধকর ঘোলাটে রহস্য। বার বার ওয়াইপার ঘুরিয়ে কাঁচটা পরিষ্কার করার ব্যর্থ চেষ্টা করে দীপ্ত। ভেজা পথ দ্রুত মাড়িয়ে যেন মুহূর্তে পৌঁছে যেতে চায় আবেগ থেকে দুরে, বাস্তবতার কাছাকাছি। ক'টা মাসে জমে থাকা অনেক কাজ সারতে হবে। তারপরেও এই চেয়ে নেয়া বিরতি স্বস্তি এনে দিচ্ছেনা কিছুতেই। পিছনে কিছু একটা ছুটে যাওয়ার অনুভূতি আঁকড়ে বসছে বুকে, কিছুতেই তাড়াতে পারছে না সেটা। পাশের সিটে বসে আছে খেয়া। "গাড়ি থেমে আছে কেন?!" - অস্থিরতা ফুটে উঠে তার কণ্ঠে?

"হানড্রেড ফরটি।" নির্লিপ্ত জবাব দীপ্তর।


বছর পাঁচেক আগে এক ব্রিটিশ কোম্পানির কাজ নিয়ে দেশ ছাড়ে দীপ্ত। তার প্রায় দুই বছর পর অনেকটা আত্নবিশ্বাস আর স্বপ্ন নিয়ে মাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। ছোট ভাইয়ের কাছে মায়ের অবস্থার বিবরণ পেতে পেতে ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠতো সে। প্রথমে বিশ্বাস হতে চাইতো না, যে মানুষটি জীবনের সব প্রতিকূলতার মোকাবেলা করে একাই তিনটি ছেলে মেয়ে বড় করলো, সে কিভাবে এত দ্রুত অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়তে পারে! তবে মায়ের যে কিছু অস্বাভাবিকতা আগে থেকেই ছিলো, এটা অস্বীকার করতে পারে না সে। তারপরেও তাদের একমাত্র নির্ভরতার আশ্রয় সেই মায়ের অস্বাভাবিকতাগুলোকে কিছুটা স্বাভাবিক জ্ঞান করেই তারা বেড়ে ওঠে। অহেতুক সেসব ঘাঁটতে যেয়ে তাদের কষ্টের জীবনে বাড়তি বোঝা বাড়ানোর দুঃসাহস হয়নি কখনো।

ধীরে ধীরে মায়ের সেই জটিলতাগুলোই প্রকট হতে থাকে। একটু একটু করে সে ভুলতে থাকে অনেক কিছু - ছেলেমেয়েদের নাম, বাড়ির ঠিকানা এমন কি নিজের সিগনেচার। সাথে তার পূর্বের কিছু সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে, যেমন - সবসময় বাড়িতে কাল্পনিক কাউকে দেখতে পাওয়া, যে তাকে অনুসরণ করছে অথবা তার অতি মূল্যবান কিছু চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে, তাকে নিয়ে কেউ বাজে কথা বলছে বা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, অনবরত কল্পনায় এরকম উদ্ভট কিছু দেখতে বা শুনতে শুনতে এগুলো নিয়ে সে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়া শুরু করে। ধীরে ধীরে তার উদ্বিগ্নতার পরিমাণ এতই বেড়ে যেতে থাকে যে তাকে সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। চিৎকার করে সে অদৃশ্য কারো সাথে ঝগড়া শুরু করে অথবা টিভিতে কোনো নাটক বা সিনেমা দেখতে দেখতে সেই চরিত্রগুলোর সাথে কথা বলা শুরু করে, আবার কখনো আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের সাথে তর্ক করতে থাকে। প্রথম প্রথম এরকম পরিস্থিতিতে খেয়া কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে দীপ্তকে ফোন করতো, ভয়ে কেঁদে ফেলতো। মাকে যুক্তি দিয়ে কখনোই কিছু বোঝানো যায় না দেখে তারা অসহায় বোধ করতো, পরে বুঝতে পারে কোনো প্রকার যুক্তি আসলে মায়ের ভেতর পর্যন্তই পৌছায় না।

সবসসময় কল্পনায় ধুলো খুঁজতে থাকা মানুষটি নিজেই আটকে পড়ে চারপাশের কাল্পনিক ধুলো-ময়লার জগতে। গায়ের জামার কোণা তুলে ঘন্টার পর ঘন্টা সে কল্পনায় দেখতে পাওয়া ধুলো ঝাড়তে থাকে, কখনো উপুড় হয়ে বসে হাতের তালু দিয়ে ঘষে ঘষে সারাদিন মেঝে পরিষ্কার করতে থাকে, ক্লান্তিতে তার গা দিয়ে ঘাম ঝরতে থাকে, চোখ বুঁজে আসে, অথচ তাকে তুলতে গেলে সে বিরক্ত হয়ে, গায়ের সব শক্তি দিয়ে ঠায় বসে থাকতে চায় সেখানেই, খেয়া তাকে তুলতে পারতো না, কখনো খুব বেশি ক্লান্ত হলে মা মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়তো।

ডাক্তারের মতে মায়ের মধ্যে দেখা দিচ্ছে একসাথে মানসিক জটিলতার নানা দিক। দীর্ঘদিন লালন করা সিজোফ্রেনিয়ার সাথে ভুলে যাওয়ার রোগ ডিমেনশিয়া, যে কারণে তার ব্রেনের সেলগুলো খুব দ্রুত ড্রাই হয়ে যাচ্ছে। সে এখন পরিণত হয়েছে এমন একজন মানুষে যে কল্পনা আর বাস্তবের মধ্যে তফাৎ করতে জানে না। ভুলে গিয়েছে নিজের নিত্তনৈমিত্তিক প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতে, ভুলে গিয়েছে অতি আপনজন এমনকি নিজের ছেলেমেয়েকে পর্যন্ত। মানসিক পঙ্গুত্ব শারীরিক পঙ্গুত্বের চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর হতে পারে, যখন একটা শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সক্ষম ব্যক্তি নিজেকে কল্পনার জগতে আটকে একটি শিশুর চেয়ে বেশি অবুঝ ও অক্ষম হয়ে যায়। যারা হয়তো তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে প্রতি মুহূর্তে চেষ্টা করে যাচ্ছে, তার অত্যাবশ্যকীয় কাজগুলো করে দিচ্ছে, তাদের প্রতিই সে হয়ে ওঠে অসহনশীল বা কখনো কখনো আক্রমণাত্মক।

মাঝে মাঝে জীবনের নির্মমতায় হতবাক হয়ে যায় খেয়া, এরই মাঝে নিজের মা হবার ক্ষণিকের অনুভূতিতে নেচে উঠেছিল সে, যা তার ভেতরে রয়ে গিয়েছে শুধুই যন্ত্রণার ছাপ হয়ে। ভয়ানক মানসিক চাপ আর দুর্বল শরীর নিয়ে জীবনটা তার কাছে তখন হয়ে উঠেছিল অর্থহীন। বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে একঘেয়ে ঘড়ির কাঁটার শব্দ, আর চারপাশের অন্ধকার যেন তাকে গিলে ফেলছিল প্রতি মুহূর্তে। গাদা গাদা ঘুমের ওষুধ দিয়ে তখন তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হতো, ঘুমের মধ্য অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখতো খেয়া, ভাইয়ের সাথে তাদের বাড়ির পেছনের মাঠটাতে ছুটছে সে, ছুটছে তো ছুটছেই, একসময় ছুটতে ছুটতে আকাশে ভাসতে শুরু করে, ছোট-বড় অদ্ভুত গোলমেলে সাইজের রঙবেরঙের প্রজাপতি বা পাখি ঠিক স্পষ্ট মনে পড়ে না সব তাকে ঘিরে তার সাথে শূন্যে ভাসতে থাকে... হ্যালুসিনেশন বা কল্পনা যে কিভাবে একটা মানুষের কাছে বাস্তবতার চেয়ে বেশি প্রিয় হতে পারে, তা এভাবেই বিছানায় শুয়ে শুয়ে অসহায়ের মত নিজেকে দিয়ে যাচাইয়ের সুযোগ পেয়েছিলো খেয়া। যখন নিজের ক্লান্তি আর কষ্ট থেকে পালাতে সে লুকোতে চাইতো হেলুসিনেশনের জগতে।

--------------------------

তাদের একটা ব্রেক দরকার ছিল। ব্রেক শুরু হলো, হঠাৎ করেই যেন সব ব্যস্ততা থেমে গেল, ঢেউয়ের তালে তালে দুলতে থাকা ভেলাটি আচমকা ঢেউ থেমে গেলে যেমন খানিকটা দিগজ্ঞানশুন্য বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তাদের অবস্থাও এখন কিছুটা তেমন। দীপ্তর বড় বোন এসেছিল, মাকে নিতে। সামনে ছ'মাস মেয়ের সাথেই থাকবে সে। তিন বছরে এই প্রথম এতো দীর্ঘ সময় মা দীপ্ত আর খেয়াকে ছাড়া কোথাও থাকবে।

যে কোনো কষ্ট ভুলতে বাবার স্মৃতি হাতড়ানো ছোট থেকে দীপ্তর একটা নেশার মত। যেমন - এই মুহুর্তে বাবা থাকলে কি করে তাদের বিবর্ণ ধূসর দিনগুলো রঙে ভরে যেত, কোন যাদুবলে তাদের সব কষ্টগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে যেত, এসব ভেবেই কেন জানি মনটা ভালো হয়ে যেত তার। যদিও চার বছরের ছোট্ট স্মৃতিতে খুব বেশি থাকার কথা নয়। তবু আধো-অন্ধকার, ঝাপসা স্মৃতি অথবা বাবাকে নিয়ে শোনা গল্প সব তার ছোট্ট মনের কল্পনায় গুলিয়ে চোখের সামনে দেখা রঙিন অতীত বলেই ধরা দেয়। কাঠের ফ্রেমে লাল-হলুদ ডোর দেয়া শক্ত খদ্দরের কাপড় আঁটানো ইজি চেয়ারটাতে বাবা রাতের খাবার পর বিশ্রাম নিতো, শীতের রাতে ছোট্ট দীপ্তকে নিজের গায়ে জড়ানো চাদরটার ভেতর ঢুকিয়ে বুকের কাছে নিয়ে চার্লিস এঞ্জেলসের টিভি সিরিস দেখতো। এতো ছোট বেলার কথা তার মনে থাকার কথা নয়, কিন্তু আশ্চর্য, মায়ের কাছে শোনা এই গল্পটা তার মাথায় এমন ভাবে গেঁথে আছে, যেন এখনো চোখ বন্ধ করলে সে বাবার গায়ের উষ্ণতা পায়। একদম জীবন্ত লাগে কল্পনায় অসংখ্যবার টেনে টেনে দেখা খুব প্রিয় সেই স্মৃতিটাও - যেখানে বাবার মুখ ভরা সাদা ফেনা, খুব যত্ন করে শেভ করছে সে, ছোট দীপ্ত অবাক হয়ে তা দেখছে। বাবার চোখ তার দিকে পড়তেই, আচমকা আঙ্গুলে করে একদলা ফেনা তার গালে মাখিয়ে দেয়। সে কেঁদেছিল কিনা মনে নেই, শুধু মনে পড়ে বাবা হাসছিল। কেন জানি সেই হাসি বার বার তার কাছে উচ্ছাসে ভরা, প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। যখনি এ স্মৃতি মনে পড়ে মানুষটাকে অসম্ভব ভালো লাগে তার। কল্পনায় সবসময় বাবার মুখে সেই একই হাসিটা দেখতে পায় দীপ্ত, শিশুর মত সরল সে হাসি।

বাবার মৃত্যুর স্মৃতি খুব বেশি ভাবতে চায় না দীপ্ত। জানে অসম্ভব মেরিটোরিয়াস এই ভাল মানুষটিকে নিয়ে সবাই খুব গর্ব করতো। বিলেত থেকে পড়ে এসে দেশের জন্যে যে ভাল কিছু করবে, সবাই তা জানতো। তাই দুই ছেলে-মেয়ে ও অন্তসত্ত্বা স্ত্রীকে রেখে উচ্চ শিক্ষা তাগিদে বিদেশে যেতে বাধ সাধেনি কেউ। কিন্তু মানুষের অনেক প্রত্যাশাই ভয়ঙ্করভাবে অপূর্ণ থেকে যায়। দীপ্তর মনে পড়ে কেমন করে একটি ফোন তাদের জীবন উলটপালট করে দিল। ঘরভর্তি মানুষ, হুলস্থুল ব্যাপার, প্রায় সবার চোখ সেদিন ভেজা ছিল। কেবল স্থির পাথরের মূর্তির হয়ে বসে ছিল মা। বাবা যে আর ফিরে আসবে না, এটা তখনো বুঝে উঠে নাই সে, শুধু মায়ের রক্তশূন্য ফ্যাকাশে মুখটা তাকে অস্থির করত। এখনো সে মুখ তাকে অস্থির করে। 

সবাই সেদিন মাকে কাঁদতে বলেছিল, বলেছিল বুকের ভার হালকা করতে। 'আল্লাহ্‌ যা করে ভালোর জন্যে করে' - এসব বলে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কোন সান্তনাই তাদের আর সেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিতে পারে নাই। দীপ্ত জানে মানুষটাকে কেড়ে নিয়ে সৃষ্টিকর্তা তাদের সাথে অবশ্যই ভালো কিছু করে নাই বরং অবিচার করেছে। সে ও তার বছর চারেক বড় বোন আর বাবা ইংল্যান্ড যাবার মাস কয়েক পর পৃথিবীর আলো দেখা ছোট ভাইটার জন্যে বাবার আকস্মিক মৃত্যু কোনো ভালো কিছু ছিল না। তিনটে অবুঝ শিশু নিয়ে জগতের বৈরী জল-বাতাসের বিরুদ্ধে একা টিকে থাকার যুদ্ধও তাদের মায়ের জন্যে ভালো কিছু ছিল না। সে জানে মানুষটা থাকলে তাদের সবার জীবন অন্যরকম হতো - সারাক্ষণ নিজেকে নিয়ে মেতে থাকা বোনটার জীবন, বাবার এক টুকরো স্মৃতি কপালে না জুটা ছোট ভাইটার জীবন, কিছুটা আত্নভোলা চাপা স্বভাবের তার নিজের জীবনও অন্যরকম হতে পারতো। আর সবচেয়ে অন্যরকম হতো, তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে সারাজীবন নিরপত্তাহীনতায় ভুগা, পৃথিবীর সব মানুষের প্রতি সন্দেহ আর অবিশ্বাসের দৃষ্টি পোষণ করা, উদ্বিগ্নতা আর উৎকণ্ঠা নিয়ে অদ্ভুত সব নিয়মের বেড়াজালে নিজেকে বেঁধে ফেলা তাদের মায়ের জীবন। ছোট বেলায় দীপ্তর উদ্ভট কিছু নেশা ছিল, তার মধ্যে একটি ছিল - দাদীর ছেড়ে রাখা পোষা মুরগীগুলোর পেছনে ছোটা। তাদের মধ্যে কোনটার যখন ছানা থাকতো, তখন তারা ভয়ঙ্কর রকম আক্রমণাত্নক হয়ে উঠতো। মুরগী তাড়াতে যেয়ে একবার এরকম এক মা মুরগীর তাড়া খেয়ে সে নিজেই ড্রেনে পড়ে গিয়েছিল। যখন অন্যদের সাথে মায়ের ঝগড়া বাঁধতো, তখন মায়ের ভয়ংকর আক্রমণাত্মক রূপ প্রায়ই দীপ্তকে সেই মা মুরগীটার কথা মনে করিয়ে দিতো।

কর্কশ একটা হর্ন দিয়ে প্রায় গা ঘেঁষে পাশ কাটিয়ে গেল বেশ বড় একটা কাভার্ড ভ্যান। ধাতস্ত হতেই খেয়াল হলো, বাড়ির টার্নটা বহু আগেই পেছনে ফেলে হাইওয়ে ধরে সোজা চলে এসেছে অনেকখানি। পাশে খেয়া বসে আছে নির্বিকার। সামনে একটা ইউটার্ন নিয়ে পিছে ফিরে আসার পথ খুঁজছে দীপ্ত... ক্রমে স্পষ্ট হয়ে আসছে ট্রাফিক লাইট, একদম ডানের রাস্তাটা ধরে দুটো বাক পেরলেই তাদের ঘর।

দীপ্তর কাঁধের কাছটা আলতো করে খামছে ধরে, প্রায় অস্পষ্ট সরে খেয়া বলে ওঠে - আস্তে যাও প্লীজ!

মানুষের প্রতিটা আচরণের আসলেই কি কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব, একটু আগেই যে অবস্থা থেকে দ্রুত আরো দ্রুত পালাতে চাইছিলো সে, গন্তব্যের খুব কাছে এসে সে গতিই কমাতে চাইছে প্রানপনে। ঘরের খুব কাছে এসে তার উপলদ্ধি হয়, ঘর ছুটে যাচ্ছে আস্তে আস্তে...

----------------------