Tuesday 12 March 2013

উপন্যাসের প্রিয় চরিত্রগুলো (দ্বিতীয় পর্ব)

 চেজিরা, টু উইমেন, আলবার্তো মোরাভিয়াঃ


'টু উইমেন' মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত দু'জন নারী চেজিরা ও তার কিশোরী মেয়ে রোসেতার গল্প। সরল ও নরম মনের, সৃষ্টিকর্তায় অগাধ বিশ্বাসী মেয়ে রোসেতার তুলনায় মা চেজিরা কিছুটা রুক্ষ, অস্পষ্ট হয়তো বা জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে কঠোর, সমাজের পুরুষ দৃষ্টির কাছে সে আবেদনময়ী এক নারী কেবল, তাও আবার একা। অথচ ভেতরের সবটা জুড়ে সে শুধুই মমতাময়ী এক মা, যুদ্ধের নির্মমতা হতে যে ঢাল হয়ে আগলিয়ে রাখতে চায় তার কোমলমনা শিশুকন্যাটিকে। তারা বাস করত রোমে, বিধবা চেজিরা সেখানে একটি দোকান চালাতো।

চেজিরা অসম্ভব শক্ত মনের এক ইতালিয়ান নারী। তার চরিত্রে বিধবার অসহায়ত্বের বদলে ছিল দাম্ভিকতা ও দৃঢ়তার স্পষ্ট ছাপ। নিজের ও মেয়ের দেখাশুনা করতো সে অসাধারণ গর্ব ও দক্ষতার সাথে। কিন্তু যুদ্ধ তার সবকিছু উল্টেপাল্টে দেয়। যুদ্ধ মানে অনিশ্চয়তা, যুদ্ধ মানে আতংক। যুদ্ধ মানুষকে দিয়ে এমন অনেক কিছু করায় যা হয়তো সে স্বাভাবিক জীবনে কখনো কল্পনাও করতে পারে না। এরকম নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে গল্পের শুরুতেই চেজিরার ভেতরের অনেক চাপা হতাশা, গ্লানি বেরিয়ে আসে।


জার্মান বাহিনীর রোম আক্রমণের শুরুতেই চেজিরা তার মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে দক্ষিণের অপেক্ষাকৃত অনুন্নত, পাহাড়ি গ্রামাঞ্চলে আশ্রয় নেয়। সাথে নেয় তার সারাজীবনের সঞ্চিত কিছু অর্থ। কিন্তু যুদ্ধের বাস্তবতায় তার সেই অর্থ দ্রুত মূল্যহীন বস্তুতে পরিণত হয়, যেখানে এক টুকরো পনীর বা এক খন্ড রুটি হয়ে ওঠে সোনার চেয়ে মূল্যবান, কারণ ক্ষুধার জ্বালা কেবল খাদ্যই দুর করতে পারে, স্বর্ণ বা অর্থ নয়। আর দশটা সহায়সম্বলহীন রিফিউজির সাথে তাদের কোন তফাৎ থাকেনা, উপরন্তু গ্রামের নীতিহীন, সুযোগসন্ধানী মানুষের আচরণে তাদের জীবন আরো দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। দীর্ঘ নয় মাস তারা ঠাণ্ডা, ক্ষুধার সাথে যুদ্ধ করে মানবেতর জীবন কাটাতে থাকে এবং অপেক্ষা করতে থাকে তাদের জন্য যারা আসলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। অপেক্ষা করতে থাকে দুর্দশা থেকে মুক্তির, অপেক্ষা করতে থাকে মিত্রবাহিনীর। একসময় চেজিরা জয়ের খবর পায়, খবর পায় মুক্তির সেই কাংখিত আশ্বাস নিয়ে মিত্রবাহিনীর মহানায়কদের আগমনের। যদিও জয়-পরাজয় নিয়ে চেজিরা ততটা উৎকণ্ঠিত ছিল না, যতটা সে অধীর ছিল ফেলে আসা শান্ত-সুন্দর-নিশ্চিত জীবনটার জন্যে। সে শুধু জানতো তাদের ফিরে যেতে হবে, আবার সবকিছু আগের মতো করে পেতে।

অথচ জয় তাদের জন্যে আনন্দের বদলে বরং আরো নির্মমতা বয়ে আনে। যখন ফেরার পথে চেজিরার বহু প্রতিক্ষিত সেই হিরোদেরই এক অংশ মরোক্কান সৈন্যরা গির্জার ভেতর মাদার মেরীর মূর্তির সামনেই কিশোরী রোসেতাকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে, চেজিরাকে মেরে অজ্ঞান করে দেয়। সেদিন চেজিরার অভিযোগ কেউ শুনেনি, তার ধর্মভীরু ছোট মেয়েটিকে না বাঁচিয়ে মাদার মেরীও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিষ্পলক চেয়ে ছিল, যেন আসলেই সে নির্জীব পাথুরে মূর্তি মাত্র। রোসেতার সরল মনে এই বর্বরতা ভয়াবহ প্রভাব ফেলে, তার শরীরের মতো মনের বিশ্বাসও দুমড়ে-মুচড়ে যায়। মায়ের সাথে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে, জীবনের ইতিবাচক মূল্যবোধগুলো বিসর্জন দিয়ে সে একটা উশৃংখল পতিতার মতো জীবন কাটাতে শুরু করে। নানা ঘটনা পরিক্রমায় অবশেষে তারা রোমে ফিরে, যুদ্ধ শেষ হয়, রেখে যায় দুটি নারীর জীবনে অমোচনীয় কিছু ক্ষত।

যুদ্ধের ধ্বংস ও যন্ত্রণার তীব্রতা যে কেবল রণক্ষেত্রের ভেতর নয়, বরং তার বাইরেও সমান ছাপ ফেলে সেই বাস্তবতাই লেখক আলবার্তো মোরাভিয়া এই দু'টি অতি সাধারণ নারী চরিত্রের ভেতর দিয়ে নিখুঁত ও যথাযথভাবে তুলে ধরেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে লেখক নিজে তার স্ত্রীসহ দীর্ঘ আট মাস পালিয়ে, লুকিয়ে বেঁচে ছিলেন। টু উইমেনে মা-মেয়ের নয় মাসের রিফিউজি জীবনের গতানুগতিক বর্ণনায় মোরাভিয়া তার নিজের সেই অনন্য মূল্যবান অভিজ্ঞতাগুলোকেই হয়তো বিস্তারিত আওড়ে গেছেন। প্রাসঙ্গিকভাবেই চেজিরাকে তিনি এঁকেছিলেন শক্তিশালী এক নারী চরিত্র হিসেবে। যে কারণে এ চরিত্রটিকে সিনেমার পর্দায় তার নিজ স্বকীয়তায় ঠিক ঠিক উপস্থাপনের ফলেই ১৯৬০ সালে একটি ইতালীয় ভাষার ছবি হয়েও অস্কারের সেরা অভিনেত্রীর পুরুস্কারটি লুফে নেন সোফিয়া লরেন।
 

আমি 'টু উইমেন' উপন্যাসটি পড়েছিলাম ২০০৭-এ। যা ছিল সেসময় আমার জীবনের অন্যতম দুঃসাহসিক কাজগুলোর একটি। এর আগে পর্যন্ত যুদ্ধ আমার কাছে ছিল দুর থেকে ভেসে আসা কান্নার করুণ সুরের মত অথবা '৭১ এর খান সেনাদের ভয়ে আমার কিশোরী মায়ের খড়ের গাদায়, চিলেকোঠায় লুকিয়ে বাঁচার দমবন্ধকর গায়ে কাঁটা দেয়া গল্প। অথচ সব যুদ্ধই যে পৃথিবীর সব নারীর কাছে একই বীভৎসতা নিয়ে হাজির হয় তা আমি জেনেছিলাম অচেনা এই নারী চেজিরা ও তার বারো বছরের মেয়ে রোসেতার কারণে। হয়তো আমার এই সামান্য বিশ্লেষণ-ধৃষ্টতায় চরিত্র হিসেবে চেজিরা এখনো পুরোটাই অভেদ্য ও অস্পষ্টই থেকে গেল। তবে এটুকু বলতে পারি সে আমার মনে সবসময় প্রবল শক্তিশালী ও আকর্ষণীয় এক চরিত্রের উদাহরণ হয়ে আছে এবং থাকবে।

No comments:

Post a Comment