Wednesday 20 March 2013

উপন্যাসের প্রিয় চরিত্রগুলো (তৃতীয় পর্ব)

দীপার সাতকাহনঃ



আসামের চা বাগান, গাছগাছালি, বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদীটার উপর রাতের জোনাকীর খেলা, চাঁপার ঘ্রাণ আর খুব ভোরে শিউলি কুড়ানো - দীপার গল্প যেন প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা প্রতিটি মেয়ের গল্প। মায়ের চোখরাঙ্গানি, পিটুনি, ঠাকুমার নিষেধ উপেক্ষা করে সে ছুটে যায় বার বার খোলা মাঠ, পথ-ঘাট পেরিয়ে - কখনো ফুল কুড়োতে তো কখনো বড়শী নিয়ে বন্ধুদের সাথে মাছ ধরতে। আশ্চর্য! প্রকৃতি তো বাছবিচার করে না তার অকৃত্রিম-অফুরন্ত রং-রূপ ঢেলে দিতে ছেলে অথবা মেয়ের। তার বন্ধু খোকন আর বিশু ছেলে, তাতে কি! ওদের কাছেও তো আঙরাভাসা নদীটা নীল আর চা বাগানগুলো সবুজ, একই রঙ একই গন্ধ। তাহলে কেন মা-ঠাকুমার যত বিপত্তি তার মেয়ে হয়ে বাইরে যাওয়ায়। খোকন, বিশুরা ফড়িং বা মাছ ধরতে যেতে পারলে সে পারবে না কেন? ওরা হাঁটুর উপরে প্যান্ট পরলে কোন দোষ নেই - অথচ দেয়াল টপকে পার হতে, গাছে উঠতে বা কোছা ভরে ফুল কুড়োতে তার যদি একটু হাঁটু বের হয়েই যায়, তাতেই বা কি এমন দোষ? এরকম চারপাশের প্রকৃতির প্রতি একটি শিশুর সরল-সহজাত আকর্ষণ, আর পদে পদে বাধা পেয়ে অন্ধকারে নিত্য আলোর শিখা খুঁজতে থাকার মতই তার ছোট মনে দানা বেঁধে উঠতে থাকা মেয়েদের উপর সমাজ আরোপিত নানা বিধিনিষেধের প্রতি প্রশ্ন। যার উত্তর একটাই - সে মেয়ে!

দুঃস্বপ্নের মত দীপার জীবনে সেই তের বছরেই জড়িয়েছিল এক নিষ্ঠুর অতীত। শুধুমাত্র উত্তরাধিকারের জন্যে এক আত্নকেন্দ্রিক ধনী পরিবারের রোগাক্রান্ত, মৃতপ্রায় ছেলের সাথে তার বিয়ে দেয়া হয়। কিছু ভয়ানক অভিজ্ঞতা বুকে নিয়ে সেদিন পালিয়ে বেঁচেছিল সে। এই অপরিনামদর্শি, জীর্ন বাঁধন নিশ্চিতভাবেই তার ভাগ্যে রেখে যায় বিধবার কালো দাগ। জীবনের এই নির্মম অধ্যায় মুছে ফেলে সে শুরু করতে চেয়েছে নতুন জীবন। পুঁজি ছিল প্রতিকূলতায় হার না মানা তার দৃঢ় মনোবল। কঠোর পরিশ্রমে গড়ে নিতে চেয়েছে নিজের ভাগ্য। সাথে তার স্রোতের মত গতিশীল মনে ঝড় তুলত নানা প্রশ্ন, যার উওর সে পায়নি কারুর কাছে - বিধবারা পেয়াজ, ডিম, মাছ-মাংস খেলে কি হয়? কেন মেয়েদের পদে পদে কঠোর অনুশাসনের মধ্যে না চললে ভগবানের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে? কোন ভগবান? কি তার নাম? ধর্মের এই একচোখা নিয়মগুলোর বিরুদ্ধে এভাবেই তার ভেতরে ফুটে ওঠে প্রতিবাদী স্বাধীনচেতা এক রূপ।

দীপাবলী এমন এক চরিত্রের নাম, যাকে ভাগ্যদেব সুপ্রসন্ন হয়ে কখনো নিরবিচ্ছিন্নভাবে কিছু দেয়নি। বেঁচে থাকার জন্য, সমাজে নিজের জায়গা করে নেয়ার জন্য যাকে প্রতিটি মুহূর্ত লড়ে যেতে হয়েছে - কখনো পারিপার্শ্বিকতার সাথে তো কখনো নিজের সাথে। কঠোর পরিশ্রমে অর্জন করে নিয়েছে আয়করের চাকুরী, সম্মান, প্রতিষ্ঠা, বেছে নিয়েছে জীবনসঙ্গী। তারপরেও তার লড়াই থেমে থাকে নাই। আত্নমর্যাদা ও আদর্শের লড়াই আপনাআপনি কখনো থামে না, তার উপর দীপা নারী, আর নারী মাত্রই তো এসব ঠুনকো অনুভূতি বিসর্জন দিতে দিতে প্রাণহীন কাঠপুতুল হয়ে টিকে থাকা, নয়তো বা নিছক ঐ এক আত্নমর্যাদা আঁকড়েই জীবনে চরম কিছুর মূল্য দেয়া। দীপা আপোষ করার মেয়ে নয়। স্বপ্নপূরণ ও মুক্তির আশায় সে কারুর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে না। আপনজন, কাছের মানুষের আত্নকেন্দ্রিক লোভী চেহারাগুলো তাকে ক্ষতবিক্ষত করলেও নিজের নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে সে থেকেছে অনড়। এবং সবশেষে সে আপোষহীন, অবিচল ও একা।



লেখক সমরেশ মজুমদার তার জনপ্রিয় উপন্যাস 'সাতকাহন' এর দীপাবলী-কে এঁকেছেন আপোষহীন সংগ্রামী এক নারী চরিত্র হিসেবে। কেন দীপাবলীর মত এমন একটি চরিত্রটি তার মনে এল এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন - "আমি এগারো বছর বয়সের একটি বিধবা মেয়ে দেখেছিলাম। সে আমাদের চা বাগানের। তাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল এত সুন্দর, কোমল, নিষ্পাপ একটি মেয়ে কেন এভাবে হারিয়ে যাবে? শেষ হয়ে যাবে? সাতকাহন লেখার সময় সেই মেয়েটিকেই আমি আমার মতো করে রূপ দিয়েছি। তাকে সমাজ, সংসারের বেড়াজালের ভেতর দিয়ে আমি পরিপূর্ণ মানুষ করে তুলতে চেয়েছি।" দীপাবলীর একা থেকে যাওয়াটা অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি, এব্যাপারেও লেখকের বক্তব্য স্পষ্ট - "বাংলাদেশের মেয়েরা যে আত্নমর্যাদাসম্পন্ন এটা আমাদের শ্রদ্ধার সঙ্গেই মনে রাখা দরকার।" একাধিকবার এই দীপাবলিকে টেলিভিশন ও সিনেমার পর্দায় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে, তবে তা উপন্যাসের দীপার মত করে আদৌ কারো মনে দাগ কাটতে পেরেছে কিনা সন্দেহ!

দীপার জীবনের সাতকাহনের মাঝে আমি শুধু আমাকে নয়, বরং চেনা-অচেনা অসংখ্য মেয়েকে দেখতে পাই, পুরো দুই খন্ডের বিশাল এই উপন্যাস জুরে কোথাও না কোথাও, বিন্দু বিন্দু হলেও অনেকেই ভেসে ওঠে আমার মানসপটে। ছোট দীপার সাথেই বা আমি নিজের এত মিল পাই কেন, কে জানে! হয়ত মফঃস্বলে বেড়ে ওঠা আমি খুব সহজে চিনে ফেলি দীপার ফুল, পাখি, জোনাকির প্রতি সেই চিরচেনা অদম্য আকুতি। তারউপর মেয়ে হয়ে জন্মে আমিও চলতে-ফিরতে-উঠতে-বসতে শুধু 'না' শুনেই অভ্যস্থ। আমার চেয়ে বছর দু'য়েক ছোট ভাইটা বাড়ির পেছনের খোলা মাঠে ইচ্ছে মতো ছুটতে পারবে, আমি 'না'... পাড়ার একই বয়সি ছেলেদের সাথে ও খেলতে পারবে, আমি 'না'... এছাড়া্‌ও, যখন খুশি বাইরে যেতে পারব না, ফুটবল/ক্রিকেট খেলতে পারব না, নিজের জমানো টাকায় ইচ্ছেমতো দোকান থেকে শখের কিছু কিনতে যেতে পারব না... জোরে কথা বলতে পারব না, আস্তেও না... হাসতে পারব না, কাঁদতেও না... আমার এ 'না'এর পালা যেন অনন্তকাল ধরে চলতেই থাকে... এত শত 'না' এর মাঝে যখন নিজেকে হারিয়ে যাওয়া কেউ লাগতে থাকে তখন দীপার কথা ভেবে আমি শক্তি পাই। কারণ দীপা আমার ভেতরে একই থাকে, সে কখনো হারায় না।

জীবন সংগ্রামে হাল ছেড়ে দেয়া, সমাজ কর্তৃক গুঁড়িয়ে দেয়া আত্নসম্মান নিয়ে দিকজ্ঞানশূন্য অসহায় কোন মেয়ের কাছে জীবনকে পুনরুজ্জীবিত করে নতুন আঙ্গিকে দেখতে, পারিপার্শ্বিকতার সাথে নিজ আদর্শের সংঘর্ষে শক্তি যোগাতে, সাধ ও স্বাধীনতা অর্জনে দীপাবলীর সংকল্প ও সংগ্রামের গল্প মূলত এক দৃষ্টান্ত।

No comments:

Post a Comment