Saturday 6 September 2014

সবিশেষ পার্টি বিত্তান্ত





সবিশেষ পার্টি বিত্তান্ত

কিন্তু স্যার... পানি কেন লাগবে?”
আহসানের ছুঁচো প্রশ্নে বিরক্তিতে মিঃ জামশেদের ভ্রু কুঁচকে আসে পঞ্চাশোর্ধ  বলিরেখায় চাপ পড়ে। চোখে-মুখে তাচ্ছিল্যের ভাব ফুটে ওঠে। এবং এসব কিছুর পরোয়া না করেই সে তাকায় আহসানের দিকে
আহাসান আমতা আমতা করে – “না, মানে... এই রিজিওনে তো পানিবাহিত রোগ নাই বলেই জানি বাসায় খাবার পানি ফিল্টারের যে ব্যবস্থা আছে, তা যথেষ্ট সেফ। অফিস ও বাসায় সেম ব্যবস্থা। আই মিন ফিল্টার। তাহলে বোতল পানির বিলাসিতা কেন?“
যত্তোসব হাভাতের দল! দুইটা এক্সিকিউটিভ গেস্ট আপ্যায়নের মুরোদ নাই, যাচ্ছে পার্টি দিতে।
ভেতরে আরো দু’য়েকটা গালি আসতে থাকে আজকাল এই এক সমস্যা অল্পতেই মেজাজ খিঁচড়ে মুখ খারাপ হয় কাইলা লোকালরা কিছু বুঝে না বলেই রক্ষা, মুখে মেকি হাসি টেনে দিব্যি শুয়োরের পয়দায়িশবলে চালায়ে দেয়া যায়। কিন্তু কোত্থেকে এই উটকো বাঙ্গালীটা এসে জুটলখারাপ না! ক্ষমতা জাহিরের কেউ না থাকলে, সেই ক্ষমতা অর্থহীন। চেহারায় তাচ্ছিল্যের ভাবটা বজায় রেখেই মিঃ জামশেদ লিস্টটা  আগামাথা, চুলচেরা খতিয়ে দেখতে থাকে। যার প্রতিটা জিনিস অতি যত্নে টুকে রেখেছে মিতা - আহসানের স্ত্রী।
যদিও আহসান এখানে মিতার করা লিস্ট যাচাই করতে আসে নাই এসেছিল সিনিয়ার স্টাফদের সাথে পরিচিত হওয়ার একটা উপযুক্ত দিনক্ষণ মিঃ জামশেদের সাথে আলাপ করে ঠিক করতে। প্রায় দুসপ্তা হলো সে এখানে এসেছে, এখনো সিনিয়ার তেমন কারো সাথেই পরিচয় হয়ে উঠেনি। মিঃ জামশেদের কাছে আসার কারণ দুটোপ্রথমত, যেহেতু আহসান তার প্রজেক্টেই জুনিয়র হিসেবে জয়েন করেছে, তাই তাকে অন্য স্টাফের সাথে পরিচয় করানোর প্রাথমিক দায়িত্বটা মিঃ জামশেদের উপর বর্তায়। আর দ্বিতীয়টা, কাকতালীয়ভাবে মিঃ জামশেদ একজন বাঙ্গালী কিন্তু মিঃ জামশেদের মাত্রাতিরিক্ত খবরদারিমূলক আচরণ আহসানকে প্রথম ধাক্কায় খুশির বদলে হতাশই করে বেশি বলতে গেলে এক প্রকার বাধ্য হয়েই সে লিস্টটা তুলে দেয় তার হাতে
না না... ড্রিক্সস আরো লাগবে! ভদকা, রেড ওয়াইন এড করো। ক্যাশু ন্যাট, চিজ বাইট, প্রিংগেলস রাখো ডিংক্সের সাথে। আর থাকবে ঝলসানো মাংশ। এপিটাইজার, সাইড-ডিসগুলো হতে হবে রকমারি। বাচ্চাদের জন্য চকলেট, কাপকেক, আইসক্রিম... সারপ্রাইজিং আইটেমে কি কি বৈচিত্র্য আনা যায় ভাবো... ইন দ্যাট কেস ইউ সুড সিক অ্যাডভাইস ফ্রম মাই ওয়াইফ! সি হ্যাজ দ্য রিয়েল আইডিয়াস! সি গট এবসোলুটলি দ্য ম্যাজিক!”
স্যার, এটা তো সে অর্থে পার্টি না একটা ছোটখাটো গ্রিটিংস মাত্র। এখানে এত বাড়াবাড়ির কি আদৌ প্রয়োজন আছে?“
মিঃ জামশেদ আহসানের কথা শুনেও না শুনার ভান করে, গলায় আরেকদফা বিরক্তি ঢেলে বলে, “মেইন কোর্স, ডেজার্টের কিছুই দেখি না এখানে। রোজকার আলু-পটলের সদাই দিয়ে কি সিনিয়ার স্টাফের পার্টি দিতে চাও তুমি?”
আসলে মিতা বলছিল এই সুযোগে যদি কিছু মানুষকে আমাদের সংঙ্কৃতির সাথে পরিচয় করানো যায়, তো খারাপ কি। যেমন ধরেন মেইন কোর্সে থাকল খুব সাধারন মাছ, ডাল, ভাত। আর ডেজার্টে পিঠা-পায়েস, সন্দেশ।
তাই নাকি! এসব এক্সিকিউটিভ লেভেলে ওঠা-বসার কোন অভিজ্ঞতাই তোমাদের নাই দেখছি? বাই দা ওয়ে তোমার স্ত্রী বাংলাদেশের কোন রিজিওনের?”
হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন স্যার?”
অবশ্যই ভ্যালিড রিজন আছে!” শুরু থেকেই নির্দ্বিধায় প্রকাশ করে আসা মিঃ জামশেদের অবজ্ঞার ভাবটা যেন থার্মোমিটারের পারায় ম্যালেরিয়া জ্বরের মতো উর্দ্ধমুখিআমার বাবা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল শওকত আলী বাঙালীদের নিয়ে যে বিশেষ উক্তিটি করতেন, তা হলোহালচাষা বাঙ্গালীদের কাছ থেকে একটি বিশেষ লেভেলের পর সেন্স আশা করা মূর্খতা
ছাত্রজীবনে ডিবেট চ্যাম্পিয়ন আহসানও এবার পাল্টা জবাব দিতে ছাড়ে না, “মাফ করবেন স্যার! আমার মনে হয়, আপনার বাবা নন-বাঙ্গালী ছিলেন। পাঞ্জাবি বা পাকিস্তানী আর্মি কারণ একমাত্র তাদের পক্ষেই বাঙ্গালীদের নিয়ে এরকম ছ্যাঁদো মন্তব্য করা সম্ভব।
হোয়াট ডু ইউ মিন!” মিঃ জামশেদের কানের লতি লাল হয়ে ওঠে।
আহসান ব্যাখ্যা করে, “দেশটা যদি কৃষিপ্রধান হয়, তাহলে সেটা হালের সেন্সেই টিকে থাকার কথাহালচাষা বাঙালী বলে কাউকে আলদা ক্লাসিফাই করাটাই বরং কোনো সেন্স প্রমাণ করে না
মিঃ জামশেদ সে মুহূর্তে কিছুটা থতমত খেলেও পরক্ষণেই নিজের নিশ্ছিদ্র দাম্ভিকতা সামলে নেন, এবং কিছুটা কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলেন, “জানো তো, বড় বড় দেশ এবং তাদের এই দাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশকে কি চোখে দেখে? দুর্নীতিতে পর্যুদস্ত, বানে ভাসা একটা দেশ। যেখানের মানুষেরা সব আনসিভিলাইজড, আনকালচার্ডতার উপর বাংলাদেশ এখন অরেঞ্জ জোনে অর্থাৎ অবস্থা এই ওয়েস্ট আফ্রিকান দেশগুলো থেকেও খারাপ। স্বাধীনতার পরপর অ্যাখ্যাপ্রাপ্ত তলাবিহীন ঝুড়ির অবস্থা লিটারালি খুব একটা বদলায়নি এখনো ঘরে অতিথি এলে চা দেয়ার কালচারটুকুও আমরা শিখেছি বৃটিশদের কাছ থেকেই অতএব তাদেরকে আমাদের কালচার দেখিয়ে রাতারাতি পগারপার করার চিন্তাটা হাস্যকর।
আহসানের ধৈর্য্য এবার জবাব দিচ্ছিল, “আমি তর্কে যেতে চাই না, লোক দেখানো কালচার শেখার আগে আমরা হয়ত একটু বেশি উদার ছিলাম। অন্তত ছোটকালে আম্মাকে ঘরে মেহমান এলে অবেলায়ও ভাত রেঁধে খাওয়াতে দেখেছি!”
আলোচনার এই পর্যায়ে জামশেদের তেলচু এক্সামপলে ভাটা পড়তে থাকে, উপায়ন্তর না দেখে মরিয়া হয়ে সে তার শেষ অস্ত্র বের করে। দুদিনের এই বাঙাল ছোকরার কাছে হার মানার অর্থ হলো পরবর্তী সময় অলিখিতভাবে তার অধীন হয়ে থাকা। এর ডানা এখনই কেটে ফরফরানি রুখতে হবেকিল দ্য কেট ইন দ্য ফার্স্ট নাইট - নাহলে এতদিনের সঞ্চিত ক্ষমতা কি কাজের!
আহসান আমি এই অরগানাইজেশনের সাথে আছি বিশ বছর। সিনিয়র স্টাফ হিসেবে আমার একটা রেপুটেশন আমি মেইন্টেইন করে আসছি শুরু থেকে তোমাকে সিলেক্ট করা হয়েছে জুনিয়র প্রোজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে। আমরা কোওয়ার্কার হলেও, আমি সিনিয়র। টপ অফ দ্যাট তোমাকে সিলেক্ট করা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে, আনফরচুনেটলি দেশটা আমার।
আনফরচুনেটলি! আমি অস্বীকার করছি না।“ এখানে আহসান গতকালের বিষয়টা উল্লেখ না করে পারে না, গতকাল লোকাল স্টাফদের সাথে তাদের গ্রিটিংস পর্বটা খুব সাধারণভাবেই এ্যারেঞ্জ করা হয়েছিল এ্যারেঞ্জ বলাটা বোধহয় ঠিক হলো না, কারণ তারা নিজ গরজে এসেছিল আহসান ও মিতাকে গ্রিট করতে। তাদের কোনো ঝামেলায় ফেলবে না ভেবে এসেছিল একদম সর্ট নোটিসে। তারপরও আপ্যায়নে ও আন্তরিকতায় তারা খুশি সবকিছু এপ্রিশিয়েট করেছিল মন খুলে আফ্রিকানদের নিয়ে তাদের মনে নানা ভ্রান্ত ধারণা ভেঙ্গেছিল তখনই। অথচ আজ সে একই মোলাকাত পর্ব নিয়ে শুধুমাত্র মানুষভেদে আরো পরিষ্কার করে বললে গায়ের চামড়াভেদে বাড়াবাড়ির মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে তার বাঁধছে। সে বলে, “আই আম নট কম্ফোরটাবল ইন মেকিং ডিফরেন্সেস বিটউইন লোকাল স্টাফ এন্ড ইন্টারন্যাশ্ন্যাল স্টাফ
মিঃ জামশেদের গলার স্বর হঠাতই যেন খাদে নেমে আসে, বাচ্চা বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে, “লিসেন আহসান, ইউ আর আ পার্ট অফ এন ইন্টারন্যাশন্যাল অরগানাইজেশন। লোকাল স্টাফ আর ইন্টারন্যাশনাল স্টাফের তফাৎ করা তোমাকে শিখতে হবে। লোকাল স্টাফদের সাথে কি হল তাতে আসলে তেমন কিছু যায় আসে না, বাট ইন দ্যাট কেস উই হ্যাভ সাম রেস্পনসিবিলিটি। আমি তোমাকে সাহায্য করছি যাতে, আমরা কিছুটা হলেও কালচার্ড এই কনসেপ্টটা ওদের মাথায় থাকে
আহসানের বলার কিছুই থাকে না। মিঃ জামশেদের মাত্রাতিরিক্ত আধিপত্য জাহিরের চেষ্টায় সে বিরক্ত হলেও একটা নতুন এটমোস্ফেয়ারে এসে শুরুতেই বেঁধে যাওয়া গ্যাঞ্জামটাকে আর টানতে চায় না। অবাধ্য শিশু যেমন তেমাথা-ছ’হাত-সতের সিঙের দানবের ভয়ের কাছে বশ মেনে অবশেষে ঘুমোতে যায়, তেমনি এই অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির কাছে এক্সিকিউটিভ জুজুর ভয়ে বশ মানা ছাড়া আহসানের সামনে আর কোনো পথ থাকে না
***
তুচ্ছ পরিচয় পর্ব টেনে রুপ দেয়া হলো বড় এক্সজিকিউটিভ পার্টিতে। মিতার সহজ স্বাভাবিক প্লান আপদোমস্তক বদলিয়ে করা হলো বিস্তর জমকালো আয়োজন। পার্টির ব্যাপকতা মাথায় রেখে মিসেস জামশেদের পরামর্শ মতে ভেন্যু ঠিক করা হলো তাদের বাড়ির লাগোয়া বড় অতলান্টিক ভিউ লন। সাহায্যের নামে এক এক করে সব দায়িত্ব সেই মহান দম্পতী নিলেও খাদ্য, পানীয় ও খরচাপাতির দিকটা রয়ে গেল আহসান ও মিতার ভাগে। এক্ষেত্রে মিঃ জামশেদ বরাবর লাগে টাকা দেবে গৌরি সেননীতিতে বিশ্বাসী।

নতুন জায়গায় নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার উত্তেজনাটা মিতার মিয়য়ে যেতে খুব একটা বেশি সময় লাগে না, মিসেস জামশেদের পরামর্শের নামে প্রতিটা বিষয়ে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্ধত আচরণ থেকে। এমন কি পার্টির দিন শখ করে মায়ের কাছ থেকে শেখা আমডালটা রাঁধতে গিয়েও, তিনি টিপ্পুনি কাটতে ছাড়েন না, “তোমাদের ওদিক বাসায় গেস্ট এলে বুঝি দাল-ভাত খেতে দেও?” যদিও পার্টির ডিনার টেবিলে আর সব খাবারের সাথে কি ভেবে যেন সেই ডালটাও পরিবেশন করে ফেলেছিল, বোকা কোনো কালো চাকর।

পার্টির দিন ঠিক করা হয়েছিল শুক্রবার। সেদিন সকাল থেকেই মিসেস জামশেদ তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কাজে নিয়জিত চারটি লোকাল কালো চাকর নিয়ে মেতে যায়, বাড়ির প্রতিটা জৌলুশ ঘষে, মেজে আরো উজ্জ্বল করতে। প্রতিটা কোণা, প্রতিটা টেবিল নিজ চোখে পরখ করে তবেই সে নিজে তৈরি হতে যায়। সাজগোজে খুব একটা বাড়াবাড়ি না থাকলেও কদিন আগে আমেরিকা থেকে স্বামীর আনা এক্সক্লুসিভ আফ্রিকান হীরের হারটা পরতে সে ভুলে না

মিস্টার জামশেদের ডাইরেক্ট বস এবং প্রোজেক্ট ডাইরেক্টর স্টিভ জনসন সপরিবারে আমন্ত্রিত। নির্দিষ্ট সময়ে সে তার চার ছেলে ও স্ত্রী জেন সহ পার্টিতে হাজির হন। মিঃ ও মিসেস জামশেদের তৎপরতা থাকে দেখার মতন। মিসেস জামশেদ অতি আহ্লাদে বাচ্চাদের গাল টিপে টিপে আদর করতে গিয়ে চোদ্দ বছর বয়সের জোসোয়ার গালটা আহ্লাদে বুঝি একটু জোরেই টিপেছিল, জোসোয়া সাথে সাথেই বিদ্যুৎ গতিতে তার কাছ থেকে কদম দুয়েক সরে গিয়ে প্রায় চেচিয়ে ওঠে,ইউউউ! নাড!” বলে। কিন্তু মিসেস জামশেদের বিনয় তখন এতোটাই বিগলিত অবস্থায় ছিল যে জোসোয়ার বলা শব্দগুলো তার কান অব্দি পৌছল না পর্যন্ত!

স্টিভ পরিবার আসার সাথে সাথেই অবধারিতভাবেই বিনা ঘোষণায় পার্টি শুরু হয়ে গেলবাচ্চারা একের পর এক চকোলেট, ড্রিকন্স আর স্ন্যাক্সে মেতে যায় মিস্টার জামশেদের একমাত্র ছেলে এগার বছরের ডালিম অন্যদের তার খেলনার লটবহর দেখানোর নাম করে নিজের প্লেরুমে নিয়ে যায় সেখানে সে তার থল থলে শরীর নিয়ে হাচরে পাঁচরে চার তাকের এক সেলফএ উঠে তারপর ওটা থেকে পাশের ইয়া উঁচু আলমিরার মাথায়, তারপর সেখান থেকে এক লাফে একদম নিচে মেঝেতে। সে তার হুলুস্থুল শরীর নিয়ে সার্কাস দেখিয়ে সবাইকে তাক লাগানোর পরও ক্ষান্ত হয়না বরং কে তারমত এক বিন্দুও সামনে না ঝুকে সেই উঁচু আলমিরা থেকে লাফিয়ে জাস্ট দুপায়ে সোজা হয়ে দাড়াতে পারবে, এই চ্যালেঞ্জ সে ছুড়ে দেয় অন্যদের কাছে

বাচ্চাদের আয়োজন আলাদা হলেও স্টিভ জনসনের ছোটে ছেলে একটু বেশি আদরের ছয় বছরের জাস্টিনকে কোন এক অদ্ভুদ-অজানা মোহে এক মুহূর্তের জন্যেও মিস্টার জামশেদের কোল ছাড়া হতে দেখা যায় না তাকে তিনি পোষা বানরটার মত সেধে সেধে মুখে তুলে কখনো চকোলেট, কখনো আইসক্রিম, তো কখনো ভরা গ্লাস থেকে এক সিপ জুস, নিদেনপক্ষে বাদাম নয়তো বা চিপস খাইয়ে যেতে থাকেনহতভাগা ছেলেটা হঠাত হেন আদর-আতিথেয়তায় ভরকেই গিয়েছিল বুঝিকি করবে বুঝে উঠতে না পেরে ডিনার টাইমের বহু আগেই মিঃ জামশেদের দামি স্যুটের পরওয়া না করে তার গায়ে হরহর করে বমি করে দেয়আচামকা চিফ গেস্টের সবচেয়ে আদরের ছানাটির এই দুর্দশায় পার্টির রঙ্গমঞ্চ কিছুটা ভঙ্গ হয়। সবাই ছোট জাস্টিনকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েমিঃ জামশেদেরই বা দোষ কি নিজের ছেলে-কে তিনি সেই ন্যাঁদ্যাকালে কুচিৎ কদাচিৎ কোলে নিয়ে ছিলেন কিনা এখন আর তা অনুমান করা সম্ভব না। তারুপর শিশুদের খাদ্য ধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে তার জ্ঞান আর নাপিতের ময়রা জ্ঞান প্রায় এক কথা। ছেলের খাওয়া-পরার সাথে জড়িত অর্থনৈতিক যে দিকটা আছে সেটা তিনি নিজ দায়িত্ব বলে মনে করলেও এর সাথে জড়িত দীর্ঘ যে কায়িক একটা দিক আছে সেটা তিনি মেয়ে লোকের অর্থাৎ স্ত্রীর উপযুক্ত কাজ বলেই মনে করেছেন আজীবন

চারদিকে একটা বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়, দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। মিঃ জামশেদের সারা গায়ে বমির গন্ধ। কাপড় পাল্টাতে তিনি দ্রুত শোয়ার ঘরে চলে যান, কিন্তু আলমিরা খুলে সেখানে পার্টিতে পরার উপযুক্ত একটাও কাপড় পেলেন না। গতকালই মিসেস জামশেদ আজকের পার্টির স্যুটটা আলাদা রেখে বাকিগুলো ড্রাইওয়াশে দিয়েছেন। সময় চলে যাচ্ছে। ডিনার টাইমের আগেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে। স্ত্রী-কে ঘরে ডেকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে কাপড় ঠিকমত না রাখার অপরাধে কোষে দুঘা দিলেন। এতে মনের অস্থিরতা কিছুটা কমলেও পুরোপুরি ঠাণ্ডা হলো নাএরপর জোরে শব্দ না করে বিশেষ দক্ষতায় সিংহের মত চাপা গর্জনে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগলেন, “ছোটলোকের বাচ্চা! এরপর যদি আমার কাপড় ঠিকঠাক না পাই তো তোর বাপ-কে ডাকিস এখান থেকে বিদেয় হতে!“

পার্টি শুরু বিকেল চারটা থেকে হলেও শেষ হতে হতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। বাচ্চারা সোফায়, যেখানেসেখানে ঘুমে ঢলে পড়েসবাই যে যার মতো একে একে বিদায় নিতে থাকেযাওয়ার সময় সভ্য কালচারমতে পার্টির নানা গুণমুগ্ধ প্রশংশার ফুলঝুরি বের হয় একেকজনের মুখ দিয়ে। তবে একটা ব্যাপারে প্রায়ই সবাই একমত ছিল এবং অন্তত একবার হলেও জানাতে ভুলে নাই তাহলো, ডাল। ডালটা তাদের আসলেই ভাল লেগেছিল। স্টিভ পত্নী জেন সাথে সিনিয়ার স্টাফ পচাত্তর বছরের বৃদ্ধ ডেভ তো গোঁ ধরে বসলো এই ডাল রন্ধন প্রণালী তাদের শিখাতেই হবে!

শিওর, মাই ওয়াইফ উইল বি ভেরী গ্ল্যাড টু টিচ ইউ দ্যাট। শি গট দা ম্যাজিক! ম্যাজিক টু ডিল পিপল, ম্যাজিক টু নো দেয়ার টেস্ট! ম্যাজিক টু নো এভ্রিথিং... হা হা হা!” মিঃ জাহাঙ্গীর তখন প্রশংসার আগুনে প্রকৃতই মোমের মত গলে গলে পড়তে লাগল।

মিসেস জামশেদের মুখে তখন লটকে ছিল একদম মাপা আড়াই ইঞ্চি খানেক চওড়া এক হাসি। এক সিমি কম বা বেশি নয়। বিগলিত, তোষামুদে বা হুজুরে হাজির কোনোটার সাথেই যায় না সে হাসিম্যালারিয়া প্রোজেক্টে ফান্ডিং টানাটানির সময়, দাতা গোষ্ঠীকে রোগ-শোকে জর্জরিত পশ্চিম আফ্রিকায় নজর দিতে আকুল আহোবান জানাতে গেল সেমিনারে অ্যামেরিকায় গিয়ে মিঃ জামশেদের প্রজেক্টরই টাকা বাঁচিয়ে আনা এক্সক্লুসিভ ডায়মিন্ড নেকলেসটাও সেই ঠায় লটকে থাকা বিসৃত হাসিতে প্রাণ যোগাতে পারেনি, কোনোভাবেই কে জানে কলোনিয়াজমের ছাপ রাখা এ আরেক কালচারই হবে কিনা, যেখানে হাসিও কারো ভেতরের হাহাকার, দৈন্যতা-কে ফুটিয়ে তুলতে পারে আরো স্পষ্ট! যেন অন্তত চপোঘাত হয়ে তা সেঁটে যায় কারো কারো নিয়তিতে, তারপর মুছে ফেলা অসম্ভব। সভ্যতার বাসে, ট্রেনে, এয়ারপোর্টে, মলে, পাঁচতারা হোটেল বা ব্যস্ত পথে হাজারো মানুষের ভিড়ে এরকম কৃত্রিম-চওড়া-সুখহীন হাসিগুলোকে আমরা ঘুরে বেড়াতে দেখি হরহামেশায় 
পুরো সময়টাতে একবারো হোস্টের নাম আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়নি যদিও আহসান জুনিয়র প্রোজেক্ট অফিসার হিশেবে নিজ দায়িত্বে সবার সাথে পরিচিত হয়েছিল পার্টি শেষে মাঝরাতের খানিক পর স্টিভ ও জামশেদের সাথে পাল্লা দিয়ে মাতাল হওয়ার আগ পর্যন্ত তার ভেতরে মিতার শব্দহীন মুখটা আতলান্টিকের ঠেউএর সাথে আছড়ে পড়ছিল। বার বার।

যে কিনা পার্টি ছেড়ে চলে গিয়েছিল বহু আগেইকাউকে কিছু না বলে, শুধু আহসানকে শব্দহীন ছোট্ট একটা ভতসনা দিয়ে। এতো হট্টগোলের মাঝে তার খোঁজ অবশ্য কেউ করেনি। ভিনদেশে এসে অবিরাম এতসব আয়োজন আর অচেনা মানুষের ভিড়ে বাস্তবেই সে হারিয়ে গিয়েছেআজ শুক্রবার রাত, ভরা পুর্নিমা। এদেশে এই দিনটিকে বিশেষ অশুভ মানা হয়। প্রেত্নাতারা চাঁদের শক্তিতে খাঁচা ভেঙ্গে বেড়িয়ে শিকারের আশায় পুরো আকাশ জুড়ে উন্মাদনা করে বেড়ায়, রাতভর ভাইবোনেরা ওকে সবসময় ভিতুর ডিম ডাকতঅনেকদিন পর্যন্ত তিন ভাইবোন যখন এক খাটে ঘুমাত, তখন রাতে হঠাত ঘুম ভেঙ্গে গেলে ভয়ে কারো না কারো গায়ের সাথে লেগে থাকা ছিল তার অভ্যাস ছোটটি ছিল বলে কেউ বকত না। বরং বড় দুজন অসীম নির্ভরতায় তাকে বুকে আগলে নিত সবসময়

আজ মিতা জ্যোৎস্না দেখবে। ঐ বড় খাঁখাঁ মাঠটায় প্রকাণ্ড বাউবাব দানবটার সাথে সারারাত, একা



2 comments:

  1. আপনার পিসির জন্যে ফ্রিতে ডাউনলোড করুন $79.99 ডলার মূল্যের এন্টিভাইরাস সফটওয়্যার avira internet security 2015 with serial key একদম ফ্রি! আর পিসিকে করুন সম্পূর্ন ভাইরাস মুক্ত। ডাউনলোড করতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন www.techtobd.blogspot.com

    ReplyDelete
  2. আপনার পিসির জন্যে ফ্রিতে ডাউনলোড করুন $79.99 ডলার মূল্যের এন্টিভাইরাস সফটওয়্যার avira internet security 2015 with serial key একদম ফ্রি! আর পিসিকে করুন সম্পূর্ন ভাইরাস মুক্ত। ডাউনলোড করতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন www.techtobd.blogspot.com

    ReplyDelete