Friday 31 August 2012

মূকান্ন

শুধু ভাত
গরম গরম, ধোঁয়া ওঠা ভাত!
সারাদিন রাস্তার মোড়টাতে,
বেওয়ারিশ কুকুরগুলোর সাথে পড়ে থাকি;
ঘুমের ঘোরে পাই ভাতের গন্ধ,
আর, কত বিচিত্র সব স্বপ্ন

কাল দেখি মা,
ঠিক পরিষ্কার মনে পড়ে না
মায়ের মুখটা;
শুধু মরচে খাওয়া ঝাপসা স্মৃতিতে
মা'র দলা মাখা ভাতের
স্বাদটা খোঁজার চেষ্টা করি।

এখানে কেন আছি
ঠিকঠাক বুঝিনা কিছুই,
কেন এত শীত, আর জ্বলন্ত ক্ষুধা
কত লোকের আসা যাওয়া দেখি,
সামনে ওই ওটা কি
মাঝে মাঝে বাসি পচে আসা
কিছু ভাত,
মুখের সামনে ফেলে দিয়ে যায় কেউ,

গোগ্রাসে গিলে ফেলি,
ভেতরে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি!
কিন্তু সেই স্বাদটা; সেই স্বাদটা পাইনা!
নেই সেই গন্ধটাও!
মা'র দলা মাখা ভাতের স্বাদ!
গরম ওম ওঠা ভাতের গন্ধ;

-তবুও, পঙ্গু অথর্ব এক মানুষ বেঁচে থাকে,
ঘরহীন কুকুরের মত ফুটপাতে।
বাক-শ্রবণ বিচ্যুত,
বুদ্ধিশূন্য কোন প্রতিবন্ধী টিকে যায়;
বিবেকশূন্য মানুষে্‌র,
করুণার খোরাকে!


---------------------------------------------------------------------------------

(কিছুদিন আগে একটা নিউজ দেখে থমকে গিয়েছিলাম, একটি প্রতিবন্ধী মেয়েকে কেউ বা কারা রাস্তায় ফেলে দিয়ে যায়, পর পর কয়দিন তাকে একইভাবে সেই রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। বিষয়টা নিয়ে অনেক আলোচনা ব্লগিং-এর পর তার স্থান হয়তো কোন আশ্রম বা প্রতিবন্ধি পুনর্বাসন কেন্দ্রে হয়। জানিনা এখন সে কেমন আছে!)

Tuesday 28 August 2012

সমুদ্রাভিলাষ















বেরিয়ে পড়লাম আজ হারিয়ে যাব ভেবে,
উপচে পড়া বাসি আবর্জনার বিন;
তেল চিটচিটে বাসন জমানো মরচে বেসিন,

আয়রন ছাড়া ঠাসানো কাপড়ের স্তুপটা ফেলে।

ডানা মেললাম এই রঙিন ফানুস হয়ে,
চোখের নিচে জমে থাকা কালচে কষ্ট;
দীর্ঘশ্বাস আঁকড়ে রাখা চাপা হৃৎপিণ্ড,

রক্ত শুকিয়ে আসা নীলচে মেরুন স্বপ্ন যাক বয়ে।

সাগর আমার নাম নিয়েছে মানছি নাতো নিষেধ!

 য্ত্নহীন পোড়া রান্না;
সকালে টিফিন দুপুরের লাঞ্চ, নিয়ম মেনে ৯টা ৫টা,

চুকে বুকে যাক রোজকের এই হিসেব!

ঠিক এভাবেই যাচ্ছি এখন ভাসবো সাগর নীলে,
পুরনো টপস, ফিকে হওয়া জিন্স;
মেকআপ ছাড়াই মনটা রঙ্গিন,

দেখবো শুধু আকাশ কোথায় মিলছে সাগর জলে!

ছুটছি আমি, ছুটছি কেবল ঝড়ো হাওয়ার মত,
সবুজের ঘ্রান, পাখির মিছিল;
উড়ন্ত সীগাল, থেমে থাকা ঝিল;
উফ! টানছে সাগর, ছুটছি আমি, পিছে ফেলে সব কত!

বাংলাদেশ

আজকে অনেক কিছু লিখব ভেবে বসেছিলাম, অথচ কেন জানি উপরে শিরনামটা লিখেই হাত থেমে গেছে! যদিও এটা আমারই দোষ, চরিত্র মাফিক রাগ-জেদ, আহ্লাদ, আব্দার সব বাজে স্বভাব খুব সহজে বাড়াবাড়ি মাত্রায় প্রকাশ করতে পারলেও, কখনো নিজের ভালোবাসার কথাটাই সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে পারিনা! কখনো বলা হয়না আমার সবচেয়ে আপন মানুষটি কে, কার প্রশান্ত মুখের কাছে পৃথিবীর সব সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়, কোথায় অস্থির ভীত আমি সবচেয়ে নির্ভরতার আশ্রয় খুঁজে পাই, কোন নির্মল চেনা গন্ধে আমি বুক ভরে শ্বাস নিতে পারি! না, কখনোই বলা হয়নি! অথচ আজ এতটা বড় হয়েছি তারপরেও যখন রাতে ঘুমের মাঝে শীত শীত লাগে, মনে হয় মা এসে চাদরটা গায়ে তুলে দেবে। নানা কাজের মাঝে প্রায় সময়মতো খাওয়া হয়না, তারপর হঠাৎ যখন খিদেটা চাড়া দিয়ে ওঠে আবার আলসেমি কাটিয়ে নিজে থেকে খেতেও ইচ্ছা করেনা, মনে হয় মা এসে প্রথমে খুব একচোট বকে পরে আদর করে দুই গাল খাইয়ে দেবে। ফেসবুকে দেখি সবাই মা দিবসে মাকে শুভেচ্ছা জানায়, অনেক অনেক ভালবাসার কথা বলে, আমি অবাক হই, এটা ভেবে মায়ের জন্যে কি আলাদা দিন থাকা লাগে! মনে মনে কিছুটা লজ্জাও পাই, আমার তো কখনো এত সুন্দর করে মাকে কিছু বলা হয়না। আমার ছেলে মা দিবসে স্কুল থেকে আমার জন্য কার্ড বানিয়ে আনে, ভাবি আমরা স্কুল থেকে মায়ের জন্যে পড়া ছাড়া কোনো উপহার আনতে পারিনাই! অই অতটুকু বয়সে আমরা জানতামই না মা দিবস বলে কিছু আছে! তাই হয়তো ফরমালি মাকে ভালবাসার কথা বলতে শিখি নাই! তবুও তো মা আমার কাছে মা-ই, অস্তিত্বের সাথে মিশে থাকা একটা নাম! যে নামের কাছে পৃথিবীর লক্ষ কোটি সুন্দর শব্দের মনে হয় কোনো মূল্য নেই! তেমনি অস্তিত্বের সাথে মিশে থাকা আর একটি নাম ‘মাতৃভূমি’, আমার বাংলাদেশ!


কান্তনগর মন্দির, দিনাজপুর।

দেশের কথাই যখন বলছি, তো নিজের জন্ম শহরের ঐতিহ্য দিয়েই শুরু করলাম! তবে এটাকে আমার অঞ্চলভিত্তিক পক্ষপাতিত্ত্ব ভাবার কোন কারণ নেই, ছবিগুলো সাজাতে গিয়ে মনে হচ্ছে লেখাটা পরের আরোও দুই একটা পর্বে ছড়াতে পারে, সেখানে লেখা বেশ সিরিয়াস হবারও সম্ভাবনা আছে, তাই শুরুটা একটু হালকাভাবে বাড়ির পাশের গল্প দিয়েই হোক না! “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দুইপা ফেলিয়া; একটি ধানের শিষের উপর একটি শিশির বিন্দু!” যদিও এই মন্দিরটি আমার অদেখা ছিলোনা, তারপরেও ঘর থেকে দুইপা-র দূরত্বের অনেক কিছুই মানুষের বরাবরই অদেখা থেকে যায়। এই আক্ষেপ দুর করতে বাংলাদেশ ঘুরাঘুরির উপর এই পোষ্ট, দেশে দেখা আরোও কিছু অঞ্চল ও ঐতিহ্য নিয়ে লেখার ইচ্ছা আছে, যেগুলো পরের পর্বে দিতে পারব আশা করছি।


কান্তনগর মন্দিরটি উপ-মহাদেশের মধ্যযুগীয় মন্দির স্থাপত্যের একটি অপুর্ব নিদর্শন। মন্দিরটি নির্মান করেন প্রখ্যাত জমিদার মহারাজ প্রাণনাথ। ১৭০২ সালে এটির নির্মান কাজ শুরু হয়ে ১৭৫২ সালে তা শেষ হয়। এটি একটি নবরত্ন মন্দির।





পুরো মন্দিরের বাইরের দিক উৎকৃষ্ট পোড়ামাটির ফলকচিত্র দ্বারা অলংকৃত। যার প্রতিটি ফলক আলাদা ছাঁচে তৈরি হয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে জ্যামিতিক নকশায় বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী, রামায়ণ, মহাভারত এবং সেসময়ের সামাজিক ও অবসরবিনোদনের চমৎকার চিত্র তুলে ধরে।





এবার প্রায় ৭ বছর পর এই প্রাচিন স্থাপত্যটিতে যাওয়া হলো, কদিন আগে আমার একমাত্র ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে বাসায় এত অধিক মাত্রায় আত্মীয়ের সমাগম ঘটেছিলো যে, যাত্রীবোঝাই বাসের মত অতিথি-বোঝাই বিয়ে বাড়িটিতে নড়াচড়ার মত অবস্থাও ছিলোনা! ঘরে মানুষ, উঠানে মানুষ, বারান্দায় মানুষ, বাথরুমে মানুষ সবখানেই শুধু মানুষ আর মানুষ! যা দেখে দেশে জনসংখ্যা আধিক্যের নমুনা নিজ বাড়িতেই একদম হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছিলো। আর জন্মহারের উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সদ্য ডিম ফুটে বের হওয়ার একটু পর থেকে শুরু করে ন্যাদা-প্যাদা, ইঁচড়ে পাকা সবসাইজই তখন খুঁজে পাওয়া সম্ভব ছিলো, এই এক বাড়িতেই। তো এভাবেই দীর্ঘ চার পাঁচ দিনের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ও জুনের আম পাকা গরমে আমাদের অবস্থা যখন আমসত্ত্ব-প্রায়, তখন ঠিক করা হলো একটু ঘুরে আসা যাক!

যথারীতি আবার এক দঙ্গল পোলাপান, নতুন জামাই-বউ, আর আপু-দুলাভাইসহ দুইটা গাড়িতে চাপা-চাপি করে আমরা বেড়িয়ে পরলাম। দুইটা গাড়িতে চাপাচাপি বলাটা বোধহয় ঠিক হলনা, কারণ দুইটা গাড়িতে জনসংখ্যার চাপ সমান ছিলোনা। যেহেতু সামনের ছোট গাড়িটিতে ভাই তার নুতুন বউ নিয়ে যাবে তাই তার সম্মানার্থে সে গাড়িটি বলতে গেলে অন্য গাড়িটির তুলনায় ফাঁকাই যাচ্ছে, শুধু চিফ গেস্ট হিসাবে আপু দুলাভাই সে গাড়িতে। আর বাদবাকি পনেরো ষোলো জন উচ্ছিষ্ট জনতাসহ আমার জায়গা হলো বারো সিটের মাইক্রোটাতে। এই মাইক্রোবাসটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো একটু খানাখন্দ, উঁচুনিচু রাস্তা পেলেই চ্যাং মাছের মত লাফিয়ে লাফিয়ে চলা। অবশ্য এতে পেছনে বসা যাত্রীরা কিছুক্ষনের মধ্যেই মুফতে রোলার কোস্টারের আনন্দ পেতে শুরু করলো, আর কে কার গায়ে পড়লো এই নিয়ে হাসাহাসির দমক বয়ে যেতে লাগলো।






যেহেতু কান্তজীর মন্দির দিনাজপুর শহর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দুরে, তাই ঠিক করা হলো আমরা ভেতর দিয়ে কিছুটা ঘুরে গ্রামগঞ্জ দেখতে দেখতে ২০ মিনিটের রাস্তা এক ঘন্টা বা দেড় ঘন্টায় যাবো। যে সময় পরে ক্রমাগত বেড়ে গিয়েছিলো সামনের গাড়ির খানিক পর পর আচমকা ব্রেক কষায়, যেখানে থেকে নতুন বউ বের হয়ে আসে পেছন পেছন নতুন জামাইও। জামাইয়ের চোখে মুখে দুঃখ দুঃখ ভাব, হাতে পানির বোতল ও বমির পলিথিন। জানা গেলো আমাদের নতুন বউয়ের গাড়িতে উঠলে মাথা ঘুরায়।

বমি বিরতির ফাঁকে ফাঁকে গ্রাম বাংলার কিছু রুপ-



আসমানিরা!



লজ্জাবতী!

যাইহোক ফিরে আসি আবার যাত্রা পর্বে, এরই মধ্যে আমাদের মাইক্রোবাসে চলমান হাসাহাসি, কিছুটা কিলঘুষিতে টার্ন নেয়া শুরু করেছে, আমি আসন্ন দাঙ্গার আভাস পেয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে গান গান (আন্তাকশিরি) খেলার প্রস্তাব করলাম, আফটার অল অলস মস্তিস্ক শয়তানের আড্ডাখানা! যথারীতি মেয়েদের টিম আর ছেলেদের টিম আলাদা করা হলো, আমার টিমে আমি তিনজন সংগীত শিল্পী আর একজন নৃত্য শিল্পী পেয়ে বেশ গর্ববোধ করছিলাম, আর আসন্ন জয়ের কথা চিন্তা করে মনে মনে বেশ পুলক অনুভব করছিলাম। যদিও আমার স্বপ্নে ভাটা পরতে বেশি সময় লাগে নাই, কারণ কিছুক্ষনের মধ্যেই আবিষ্কার করলাম আমার শিল্পীবৃন্দের গানের গলা, সুর, তাল, লয় যতই উচ্চমার্গীয় পর্যায়ে হোকনা কেন, তাদের গানের ভাণ্ডার মোটেও সেই পর্যায়ে সমৃদ্ধ নয়, আর বৈচিত্রের ব্যাপারে আরও বেহাল দশা! আমাদের অবস্থা হলো এরকম যে, যেটা জানি তো সবাই জানি, যখন কোন অক্ষর দিয়ে গান পাচ্ছিনা তো কেউ পাচ্ছি না! অন্যদিকে ড্রাইভার সেকান্দার ভাইয়ের ভরসায় ছেলেরা আমাদের থেকে অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থায় পৌছে গেলো। সেকান্দার ভাইয়ের গানের ভাণ্ডার যে আমাদের চেয়ে বিস্তৃত ছিলো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ইতিমদ্ধে সে গফুর বাদশা বাঞ্চা পরি, গোলাপি এখন বিলেত, ও প্রিয়া তুমি কোথায় ইত্যাদি গান গেয়ে, দেশীয় সংগীত ও সঙ্কৃতিতে তার অবাধ দখলের নমুনা দেখিয়ে আমাদের রীতিমত তাক লাগিয়ে দিলো! উপায় না দেখে বললাম, সেকান্দার ভাই আজকাল মাইক্রোবাস অনেক বেশী এক্সসিডেন্ট হচ্ছে, আপনার গান গাওয়া লাগবে না ঠিকমতো গাড়ি চালান। কিন্তু সে ততক্ষণে ছেলেদের টিমের মেইন ভোকাল ও ক্যাপ্টেন পর্যায়ে চলে গিয়েছে, তাকে থামানো আর সম্ভব নয়, অগত্যা আন্তাকশিরিই থামাতে হলো।







অবশেষে ঐতিহ্যবাহী কান্তনগর মন্দিরে পৌছানোর পর সেকান্দার ভাই আরেকদফা তার জ্ঞান ও সূক্ষ্য বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে বলল, “আফা হেন্দুরা মন্দিরে পূজা করে হেই মন্দির মুসলমানদের জন্যে কোন দেখার বিষয় হইলো! কোনদিন হুনছেন হেন্দুরা মুসলমানদের মসজিদ দেখবার যায়?”

বললাম, ভাইরে পুরা রাস্তা মেলা মাথা খাইছেন, এইবার একটু থামেন। হিন্দুর মন্দির, মুসলমানের মসজিদ এগুলা বাদ দিয়ে পারলে আপনিও ভেতরে এসে দেখেন, আসলেই কি দেখার আছে!

“আমারে কেউ লাখ টাকা দিলেও হেন্দুর মন্দির না দেখি”, বলে সে তার মোবাইলে ধারণকৃত আলিফ লাইলার অংশ বিশেষ দেখা শুরু করলো। করুণা হলো এই চোখ বন্ধ রেখে অন্ধ থাকতে চাওয়া মানুষটার প্রতি!

১৯৬০ সালে কান্তনগর মন্দির সরকার কতৃক সংরক্ষিত প্রাচীন কীর্তি হিসাবে ঘোষণার পরও হীন সাম্প্রদায়িকতার কারণে ঐতিহাসিক নিদর্শন এই মন্দিরটি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান আর্মি ধ্বংসের চেষ্টা চালায়!

ভাবতে চাই -আমারা স্বাধীন সকল গোঁড়ামি ও ভিত্তিহীন সাম্প্রদায়িক মানসিকতা থেকে! ভালোবাসি নিজের দেশ, নিজের ঐতিহ্যকে!

------------------------------------------------------------------------------------------------

হারিয়ে গিয়েছে চেনা গাছে, চেনা পথ!




ছোট বেলার ঝাপসা স্মৃতি থেকে ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ওঠা মুহূর্তগুলো, আমার বেড়ে উঠার সাক্ষী রাখা সেই ছোট্ট শহর, চিরচেনা পথ-ঘাট, মাঠ-পুকুর, ঝুম বৃষ্টিতে উঠানে দাপাদাপি, গ্রীষ্মে আম খাওয়া ছুটি ও শীতে পিঠা খাওয়া- যদিও কিছুই আর আগের জায়গায় নেই। বদলেছি আমিও, বদলেছে আমার অবস্থান, তবুও স্মৃতির পটে বহু যত্নে এঁকে রাখা সেই মুহুর্তগুলো বদলায় না কখনো, ধুলো জমেনা এর কোনায়, ফিকে হয়ে আসেনা এর কোন রঙ! ছেলেবেলার কথাই বলছি, যখন বাইরের পৃথিবী বলতে আমাদের কাছে ছিলো শুধু গরমের ছুটিতে নানু বাসায় যাওয়া, শীতে্র ছুটিতে দাদু বাসায় যাওয়া। যেকারনে অতি আগ্রহ ও আনন্দের এই ছুটিগুলো আমাদের কাছে ছিলো রীতিমত অমূল্য! ছোট বেলার সরল তীক্ষ্ণ অনুভূতিতে সব কিছুই যেমন বেশী মাত্রায় বড় আর আপন লাগে। তেমনি এই ১২ থেকে ১৪ কিলোর ছোট রাস্তাও তখন আমাদের কাছে ছিলো অনেক বড় এবং তা নিয়ে আমাদের প্রস্তুতিও ছিলো যথারীতি বড়! আর এই পথগুলো ছিলো আমাদের গন্তব্যের মতই অতি আপন। চেনা ছিলো এর প্রতিটি বাঁক, ছোট ছোট দোকান-পাঠ লোকালয়, ফসলের ক্ষেত, আর দুধারে দাঁড়িয়ে থাকা অতি প্রাচীন অভিভাবকের মত বিশাল বিশাল সব গাছ।

ছোট শহরটি থেকে বেরুবার পর থেকে প্রতিটি গাছই যেন আমাদের দেখে আনন্দের অভিবাদন জানাত, আর আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম সেগুলোর দিকে। মুগ্ধ হতাম তাদের বিশালতা দেখে। প্রতিটা গাছই আলাদা করে ঠিক চিনতাম, যেটার ঠিক মাঝে একটা গোল গর্তের মত ছিল সেখানে একদিন একটা কাঠাবেড়ালী উঁকি দিতে দেখেছিলাম, তাই ধরে নিয়েছিলাম গাছটার ভেতর ওই কাঠবেড়লীটার বাসা, কল্পনায় নানা ভাবে তার ঘরদোর দেখে নিতাম। প্রতিবার গাছটা পেরুবার সময় সেই গর্তে উঁকি দিতাম, যদিও আর কখনো কাঠবেড়ালীটার দেখা মেলেনি। আরো দুটো বাঁক পেরিয়ে, পথ থেকে কিছুটা দুরে ছিলো বিশাল এক বটগাছ, যার কাণ্ড আর শাখা আলদা করে চেনা যেতো না। আর গোড়ার দিকে এবড়োখেবড়ো আমগাছটা দেখে আপু বলতো গাছটার ছোট বেলায় বুঝি ঘা হয়েছিলো, তাই ওরকম হয়ে গিয়েছে দেখতে। জোড়া তালগাছে ঝুলে থাকা বাবুই পাখির বাসাগুলো বাতাসে তালপাতার শব্দে কেমন নেচে নেচে দুলতে থাকত, অসংখ্য পাখির কিচির-মিচির শব্দে কানে প্রায় তালা লেগে যেত! খানিক পর পরই আসতো বিশাল বিশাল সেগুন, মেহগনি, শিমুল আরোও নাম না জানা অসংখ্য সব গাছ। শীতকালে লাল শিমুল ফুলে ভরে থাকতো পথ। ছোটমামা বলেছিলো শিমুল গাছে ভুত থাকে, তাই ভয়ে গাছগুলোর দিকে তাকাতাম না। কিন্তু পথে ছড়ানো ফুলগুলো দেখে মন আনন্দে ভরে উঠত, মনে হত আমাদের জন্যেই বুঝি গাছগুলো তার ফুল বিছিয়ে অপেক্ষা করছে। পুরো পথ নিমেষেই শেষ হয়ে আসত বিচিত্র সব গাছে্র ভিন্ন রঙ, রূপ আর ঘ্রাণ চোখ ও মন ভরে দেখতে দেখতে! যেন এখনও চোখ বন্ধ করে ফিরে পাই সে অনুভূতি।

মাঝে অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। জীবনের তাগিদে আমাদের শুধু সামনেই ছুটে চলতে হয়, পেছন ফিরে তাকানোর অবসর খুব কমই মেলে। এবার অনেক দিন পর যাওয়া হয়েছিলো সেই চেনা পথে। কিন্তু হায়! কোথায় আমার ছোট্টবেলার ফেলে আসা সেই স্মৃতিপট! কোথায় আমার কাঠবেড়ালীর বাসাওয়ালা বুড়ো আম গাছটা! কোথায় এবড়োখেবড়ো ঘা-ওআলা গাছটা, কোথায় সেগুন আর শিমুল, কোথায় ফুল, কোথায় গন্ধ! নেই কোনো রঙের ছড়াছড়ি, নেই কোথাও রূপের বৈচিত্র! দুধারে শুধু একঘেয়ে আগাছার মত লকলকিয়ে বেড়ে উঠেছে দীর্ঘকায় ইউক্যালিপটাস-এর জঙ্গল! এ কোন পথ ধরে চলেছি, আমি চিনিনা। আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে! অনেক কষ্টে এই জঙ্গলের ফাঁকে খুঁজতে থাকি, একটু আশা- হয়ত অন্তত একটা চেনা গাছ পাবো, কিন্তু নাহ! কোথাও নেই! মনে পরে গেলো ক্লাস ফাইভে সামাজিক বিজ্ঞানের সালাম স্যারের কথা, "বাংলাদেশ বনায়নের গাছ চুরির নব্য কর্মসূচি চালু হয়েছে, আমাদের সব ভালো ভালো পুরোনো গাছে কেটে সেখানে আগাছা লাগানো হচ্ছে। আগাছা চেনো তো? যা মাটি থেকে অতিরিক্ত পানি ও সার শুষে নিয়ে নিজে দ্রুত বেড়ে ওঠে, ফলে ফসল অর্থাৎ উপকারি গাছগুলোই আর বাড়ার সুযোগ পায়না! অথচ বিনিময়ে আমরা এর থেকে কিছুই পাইনা!" স্যারের আশংকাই সত্যি হয়েছে, অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম কিভাবে ২৫% বনায়ন কর্মসূচী সফল করতে, আগাছায় ভরে ফেলা হচ্ছে পুরো দেশ! অদ্ভুত সে দেশ যেখানে খাবারে অবাধে মেশানো হয় বিষ, পানিতে প্রকাশ্যে ঢেলে দেয়া হয় শিল্প-কারখানার বর্জ্য কেমিক্যাল, বাতাসে কার্বন মনো-অক্সাইড আর মাটিতে লাগানো হয় ক্ষতিকর ইম্পোর্টেড আগাছা!

না, আমি কোনো পরিবেশবাদী বা গাছ বিশারদ নই! দেশে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির আওতায় অন্তর্ভুক্ত কোনো নির্দিষ্ট গাছের গ্রহনযোগ্য পরিসংখ্যান ও উপকারিতা অপকারিতা নিয়ে গবেষণা করার মত যথেষ্ট জ্ঞানী ও সচেতন মানুষ দেশে আছে বলেই আমি মনে করি, এব্যাপারে আমার জ্ঞানের শীমাবদ্ধ স্বীকার করেই বলছি- যেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে বৃক্ষরোপণ দিবস উদযাপন করেন দেশীয় ফলজ গাছ লাগিয়ে, এবং সাধারণ মানুষকেও এসব উপকারী ফলজ গাছ লাগানোর পরামর্শ দেন। সেখানে একটা প্রাপ্তবয়স্ক ফলজ বা পরিবেশ-অনুকূল স্বজাতীয় গাছের শেকড় উপড়ে কেন দশটা বিদেশী আগাছা লাগানো হচ্ছে, এটা বুঝতে আসলেই আমার কষ্ট হয়!

আমাকে শুধু তাড়ায় আমার চেনা গাছগুলোর দীর্ঘশ্বাস! ভাবতে পারিনা কতটা নিরব অভিমান বুকে নিয়ে তাদের চলে যেতে হয়েছিলো! তাদের বাঁচাবার জন্য কোথাও কোনো প্রতিবাদ হয়নি, তাদের শূন্যতা অনুভব করে কারো চোখে নেমে আসেনা দুফোঁটা অশ্রু! অথচ এই স্বার্থপর মানবজাতি এবং পৃথিবী নামক গ্রহটার ঋণ তাদের কাছেই বরং অনেক বেশী ছিলো। কোন মফস্বল শহরের অজপাড়ার পথের কিছু বুড়ো গাছের খোঁজ নাহয় কেউ নাই রাখলো। আমার বিস্ময় আরোও বাড়ে যখন দেখি বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটা হাইওয়েতে শুধু ইউক্যালিপটাসের দৌরাত্ব! শুধু হাইওয়ে নয় একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় কিভাবে গ্রামের মেঠো পথ, স্কুল-কলেজ, পকুর পাড়, ধান ক্ষেত সর্বত্র ভরিয়ে ফেলা হয়েছে এই বিদেশী গাছ দিয়ে। তাহলে কি এসব জায়গা থেকেও অবাধে উপড়ে ফেলা হয়েছে প্রাচীন সব স্বদেশী গাছের শেকড়! বিভিন্ন সাইজের এই গাছ দেখলে সহজে অনুমান করা যায়যে এ প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত রয়েছে।

স্বাভাবিকভাবেই কিছু প্রশ্ন মনে আসে,
ইউক্যালিপটাস বা এই প্রজাতির গাছগুলোর কি এমন মহত্ব ও গুরুত্ব আছে যে কারণে এই এক টাইপ গাছ দিয়ে পুরো বাংলাদেশ ভরে ফেলা হচ্ছে? এটা বাংলাদেশের জলবায়ুর প্রেক্ষিতে এটি একটি উপযুক্ত প্রজাতি কিনা? এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী স্বদেশী গাছগুলো রক্ষা ও বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বনবিভাগের কোন নীতিমালা আছে কিনা, থাকলেও তা কতটা কার্যকর?

(এই প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুর পাক খাচ্ছিলো অনেকদিন। শেষে নিজেই এর উত্তরের আশায় কিছুটা ঘাটাঘাটি করে যা পেলাম, তা আমার মত করে নিচে তুলে ধরলাম। আগেই বলেছি আমি কোন পরিবেশবাদী বা বৃক্ষ গবেষক নই, বাংলাদেশের জলবায়ুর প্রেক্ষিতে ইউক্যালিপটাস বা এই প্রজাতির গাছের উপকারিতা বা অপকারিতার ব্যাপারে তেমন কোন নির্দিষ্ট তথ্য আমি পেলাম না, আশা করছি আপনাদের বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও তথ্যে বিষয়টি আরোও পরিষ্কার হবে।)
যদিও বাংলাদেশে প্রকৃতি ও জলবায়ুতে নির্দিষ্টভাবে ইউক্যালিপটাস এর প্রভাব এখনো অবধি কোন গবেষণার আওতায় আনা হয়নি, শুধু ধরে নেয়া হয় যেহেতু পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এই গাছরোপণ কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলে নাই তাই বাংলাদেশের জলবায়ুতেও অনুরূপভাবে এর প্রভাব একই থাকবে। FAO এর দেয়া তথ্য মতে, মানুষ প্রতি দশ হেক্টর প্রাকিতিক বন উজাড় করে কেবল এক হেক্টর কৃত্রিম বনায়ন করছে, সেক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশ গুলোতে ক্রমবর্ধ্মান জনসংখ্যার খাদ্য, জ্বালানী ও আশ্রয় চাহিদা পুরনে ইউক্যালিপটাসের মত দ্রুত বর্ধ্মান এবং পারিপার্শিকতার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম গাছকে বিকল্প হিসেবে প্রস্তাব করা হয়। অন্যদিকে বৃক্ষরোপণ অভিযানে নোবেল লরিয়েট কেনিয়ার Wangari Maathai এর মতে, শুধু মাত্র বাণিজ্যিক কারনে এই আগন্তুক গাছকে অতিউৎসাহিত করা হয়েছে। তিনি ইউক্যালিপটাসকে 'ওয়াটার ড্রিংকার' এবং অন্য প্রজাতির প্রতি শত্রুভাবাপন্ন একটি ক্ষতিকর গাছ বলে আখ্যায়িত করেন। তার মতে, “When you go into these monoculture plantations, they look like dead forests because it’s only them, you don’t see birds, butterflies, other trees, animals—anything other than them because they don’t allow any other growth.” কেনিয়াতে ইউক্যালিপটাস রোপণ সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে এবং জলাশয় বা নদীর তীরবর্তী অঞ্চল থেকে এই গাছ তুলে ফেলতে সরকারী নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, সাউথ আফ্রিকাতেও এই প্রজাতির গাছগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

মাথাই এর ভাষায়, “God had a reason to put some species somewhere so that we have appropriate habitats for particular parts of the world, so when you bring eucalyptus from Australia, you are killing yourself.” যেমন আফ্রিকার পথে প্রান্তরে সবত্র প্রকাণ্ড ভুতুড়ে বাওবাব গাছগুলো শত শত বছর ধরে নিজের ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। সেখানে বাংলাদেশে সর্বত্র বিভিন্ন সাইজের আগন্তুক এই ইউক্যালিপটাস দেখে মনে হয় যেন এটাই বাংলাদেশের আদি ও একমাত্র গাছ! গেলো বিদেশী গাছের কথা, শেষ করি আমার নিজ দেশের ছোট থেকে দেখে আসা চিরচেনা প্রিয় গাছ আর প্রিয় পথগুলোতে- রূপবৈচিত্রে ভরা এই বাংলাদেশ, যার প্রতিটি ঋতুর সাথে সাথে পথে প্রান্তরে ফুটে উঠে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ও তার গন্ধ। কবির ভাষায়, "পলাশ ঢাকা কোকিল ডাকা আমার এই দেশ ভাইরে" অথবা "পলাশ ফুটেছে শিমুল ফুটেছে এসেছে প্রিয় মাস", কোকিলের ডাক শুনিনা বহুদিন! বাংলাদেশের পথে ঘাটে এখন আর পলাশ-শিমুল ছড়ানো থাকেনা, বটতলিতে বটগাছ নেই যেমনটি কাঁটাবনে কাঁটাগাছ নেই; আমাদের পরের প্রজন্মের কাছে এসব রূপকথার গল্প নয়তোবা শুধুই নাম হয়ে থাকবে!

--------------------------------------------------------------------------

স্কটল্যান্ড




ভোরে কুয়াশায় চাদরে ঘুমিয়ে থাকা পাহাড়গুলো, যেন অদ্ভুত ধোঁয়াটে রহস্যময়তায় ঢেকে রাখতে চায় পুরো জগৎ!





এরপর একটু একটু করে ছড়িয়ে পরে সকালের নরম আলো বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠে, আনন্দে ঝলমলিয়ে উঠে ঘাসের ডগায় ক্রিস্টালের মত জমে থাকা তুষার বিন্দুগুলো!




সকালের আলোর সাথে সাথে; দুর কোন ফার্মের ডেন থেকে বেড়িয়ে আসে ভেড়ার পাল। অফুরন্ত কচি ঘাসের মাঝে আয়েশে চড়ে বেড়াবে তারা দিনভর।

স্কটল্যান্ড। বৃটিশ অঙ্গরাজ্য এই দেশটির নামের সাথে কেন জানি আমার মনে উঠে আসে সেই তের শতাব্দীর স্কটল্যান্ড এর প্রকৃত কিংবদন্তি, প্রবল দৃঢ়চিত্তের পুরুষ উইলিয়াম ওয়ালেসের ছবি। যাকে বলা হত 'গার্ডিয়ান অফ স্কটল্যান্ড'।


সাত ফুট উচ্চতা, সুগঠিত শরীর ও শক্ত পেশীর একজন প্রকৃত হিরো উইলিয়াম ওয়ালেস। যদিও তার মনের শক্তি ছিলো পেশীর শক্তির চেয়ে হাজারো গুন বেশী!

উইলিয়াম ওয়ালেস, স্কটল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং স্কটিশ ফ্লুট এর মন উদাস করা সুর, এগুলোর সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় মেল গিবসনের সাবলিলভাবে অভিনীত এবং পরিচালিত মুভি 'ব্রেভ হার্ট' এর মাধ্যমে। যেখানে দেখানো হয় স্কটিশদের উপর ইংরেজদের চালানো পাশবিকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাবা ও ভাইয়ের মৃত্যু্র পর ছোট্ট ওয়ালেসকে তার এক চাচা এসে সেখান থেকে নিয়ে যায়। বড় হয়ে সে ফিরে আসে নিজ মাতৃভূমিতে। দেখা হয় ছোট বেলার ফেলে যাওয়া বন্ধু ম্যারনের সাথে, সেই পুরনো ভালোলাগার সাথে যুক্ত হয় নতুন অনুভূতি ভালোবাসা, কিন্তু তাদের এই নির্মল স্বাভাবিক অনুভূতিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তথাকথিত ইংলিশ শাসন ব্যবস্থা, যেখানে প্রচলিত ইংলিশ আইন অনুযায়ী নববিবাহিত স্কটিশ মেয়েদের ব্রিটিশ লর্ডের বিছানায় প্রথম রাত কাটাতে হবে। উপায়ান্তর না দেখে তারা লুকিয়ে বিয়ে করে, যদিও দ্রুতই ম্যারন ইংলিশ সৈন্যদের কুনজরে পড়ে, প্রিয়তমাকে সৈন্যর লালসা থেকে রক্ষা করতে ছুটে আসে ওয়ালেস, অস্ত্র ছাড়া একাই ঠেকাতে থাকে তাদের, ম্যারনকে পালিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় যেতে বলে। কিন্তু পালাতে পারেনা ম্যারন, ইংরেজদের ধূর্ততার সাথে পেরে উঠেনা নিরপরাধ মেয়েটি, বিচারের নামে ‘রাজার সৈন্যের অবমাননার রাজার অবমাননারই সামিল’ এই অজুহাতে ম্যারনকে নিজ গ্রামই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়! ওয়ালেস ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। যা ছড়িয়ে পড়তে থাকে সাধারন মানুষের মধ্যে, গড়ে উঠে ওয়ালেস এর নিজস্ব সৈন্যবাহিনী। এভাবেই নানা ঘটনা ও ওয়ালেসের একাগ্রতায় ভীত ও নড়বড়ে হয়ে পড়তে থাকে ইংরেজ শাসকের ভিত। নানাভাবে তাকে অনুগত করার চক্রান্তে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে জনসম্মুখে অসহনীয় নির্যাতনের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় তার। তৎকালীন রাজদ্রোহীদের শাস্তি হিসেবে যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হত তা কোন সাধারন উপায়ে দণ্ডিত মৃত্যু নয়। ডিস-এমবোয়েলমেন্ট দ্বারা তাকে যখন নারকীয় যন্ত্রনা দেয়া হচ্ছিলো, তখন উপস্থিত জনতার মধ্যে থেকে আকুল হয়ে ওয়লেস এর জন্য দয়া ভিক্ষা চাওয়া হয়। তাকে শেষবারের মত সুযোগ দেয়া হয় ইংরেজ শাসনের কাছে নতিস্বীকার ও দয়া ভিক্ষার জন্য, পরিবর্তে তাকে দেয়া হবে অধিকতর সহজ মৃত্যু এবং জবাবে মনে পড়ে মেল গিবসনের সেই পর্দা কাঁপানো, প্রতিটি রোম কোষ জাগানো আওয়াজ - "ফ্রিইডম"!



বার বার পরাজিত এবং ইংরেজদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে আত্নগোপনকালে, মাকড়শার জাল বোনা দেখে অধ্যবসায়ি হবার শিক্ষা গ্রহনকারী রবার্ট ব্রুসের গল্প তো সবার জানা। নীতিগত কারনে ব্রুস ওয়ালেস কে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সহায়তা করে এবং ওয়ালেস এর মৃত্যুর পর 'গার্ডিয়ান অফ স্কটল্যান্ড' এ পরিণত হয় ! পরবর্তিতে সে সফল স্কটিশ গেরিলা আক্রমন দ্বারা এই ভূমি থেকে রাজা দিত্বীয় এডওয়ার্ড এর অধীন বৃহৎ ইংলিশ সৈন্য হটিয়ে, পুনরায় স্কটিশদের রাজত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হয়।


এডিনবরা ক্যাসেল।

প্রাচীন কোন অগ্ন্যূৎপাত দ্বারা উদগীর্ণ শিলা খণ্ড, নাম বিখ্যাত এডিনবরা রক। এই এডিনবরা রক এর উপরই অসীম দম্ভের সাথে হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে ঐতিহাসিক এ ক্যাসেলটি দাড়িয়ে আছে। যার নামেই নামকরন করা হয়েছিলো স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরার। নগরীর সর্বাধিক প্রাধান্য বিস্তারকারী অতুলনীয় এই ক্যাসেলটি বছরে এক মিলিয়নেরও বেশী ভ্রমনকারী পরিদর্শন করেন, যা লন্ডন টাওয়ার বাদ দিলে নিসন্দেহে যুক্তরাজ্যের সর্বাধিক প্রদর্শিত প্রাচীন স্থাপনা।






কেলভিনগ্রোভ আর্ট গ্যালারী মিউজিয়াম, গ্লাসগো।

স্কটল্যান্ডের ভ্রমন আকর্ষণগুলোর মধ্যে দিত্বীয় স্থানে আছে কেলভিনগ্রোভ আর্ট গ্যালারী মিউজিয়ামটি, যেখানে মুহূর্তে হারিয়ে যাওয়া যায় স্কটিশ প্রাচীন জীবনধারায় - সেখানকার নাগরিক পুরাতত্ত্ব থেকে প্রকৃতির রাজ্য, পার্ল ফিশিং থেকে রবার্ট ব্রুস সব কিছুই যেন কল্পনায় জীবন্ত হয়ে উঠে। মিউজিয়ামটিতে সুসজ্জিত রয়েছে প্রাণীজগতের নানা প্রজাতির সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে ছোট প্রাণীটির স্টাফ ও প্রাচীন ফসিল কালেকশন, জাঁকালো সব আর্ট কালেকশন, পৃথিবীর অন্যতম মধ্যযুগীয় অস্ত্রসস্ত্র কালেকশন ইত্যাদি। বছরে দশ লক্ষ-এরও বেশী দর্শনার্থী সমাগিত এই স্থানটি লন্ডনের বাইরে যুক্তরাজ্যের সর্বাধিক পরিদর্শিত একটি মিউজিয়াম।








প্রাচিন নগরী এডিনবরা।



রাজধানী এডিনবরা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী এবং ইউরোপের প্রধানতম অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলোর একটি। আঠারো শতাব্দীতে স্কটিশ আলোকউজ্জল অধ্যায়ে এডিনবরা কেন্দ্রিয় ভুমিকা পালন করে। যা স্কটলান্ডকে ইউরোপের বাণিজ্যিক, বুদ্ধিবিত্তিক ও শিল্পভিত্তিক ‘পাওয়ার হাউজে’ পরিণত করে।



গ্লাসগো সিটি চেম্বার। স্কটলান্ডের বৃহত্তম নগরী গ্লাসগো। এবং পৃথিবীর অন্যতম বানিজ্যিক শহর গুলোর একটি।


সিনে প্লেক্স। পৃথিবীর উচ্চতম সিনেমাহল!


উচ্চতা পরিমাপের চেষ্টায়।


গ্লাসগোর পথে।


আর্থার'স সিট, এডিনবরা।

এডিনবরা শহরের ঠিক মাঝখানে এক গুচ্ছ পাহাড়ের শিখর হলো এই আর্থার’স সিট। যেখান থেকে শহরের চমৎকার এক প্যানারোমিক ভিউ ফুটে উঠে। সন্ধ্যা হয়ে আসায় ছবিটা ঠিক মন মত হয় নাই।


ফোর্থ রোড ব্রিজ। দেশটির চার প্রান্ত থেকে ছুটে আসা চারটি পথের সংযোগ পারাপার এই ব্রিজটি।


ফলকার্ক হুইল, ফলকার্ক, স্কটল্যান্ড।

পৃথিবীর প্রথম এবং একমাত্র ঘুর্নায়মান বোর্ট এলিভেটর। যা 'ফোর্থ অ্যান্ড ক্লাইড ক্যানেল' ও 'ইউনিয়ন ক্যানেল' নামে দুটো বিশাল খা্লের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করছে, প্রকৃতির গতিকে বাধাগ্রস্ত না করে। এই ক্যানেলগুলো একটি থেকে আরেকটি ৩৫ মিটার উপরে অবস্থিত। মধ্য স্কটল্যান্ডের প্রান চাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনতে এই ক্যানেল দুটোকে সংযুক্ত করা জরুরি হয়ে পড়ে যার ফলাফল আজকের এই ‘ফলকার্ক হুইল’। আর্কিটেকচারাল, মেকানিক্যাল সাইন্স মোদ্দা কথা টেকনোলজির এক আশ্চর্য নিদর্শন স্কটল্যান্ডের এই ফলকার্ক হুইল। একটু কল্পনা, মাটি থেকে ৩৫ মিটার উপরে নৌকো চেপে শূন্যে ভাসতে ভাসতে; চারপাশের মনোরম প্রকৃতি দুচোখ ভরে দেখা যেন অনেকটা ছোটবেলার ময়ূরপংখীর সাধ পূরন হবার মত!








শিশুদের কিছু আনন্দ দেখে প্রায়ই একটা কথা মনে হয়, আহা! আমি কেন শিশু হলাম না!


লক লমন্ড, বামাহা, স্কটলান্ড।

লেক কে স্কটিশ ভাষায় বলা হয় 'লক'। অথ্যাৎ এখানে 'লক লমন্ড' বলতে 'লেক লমন্ড' বোঝানো হচ্ছে, অথবা 'লমন্ড লেক' এভাবেও বলা যায়। তা নামটা যেভাবেই বলিনা কেন, কবির ভাষায় বললে- প্রকৃতির অকৃতিম মায়াময়তা, প্রতিটি কণা উজাড় করে ঢেলে রাখা শুধু মুগ্ধতা; লোকালয়-কোলাহল থেকে কয়েক ক্রোশ দূরে, স্নিগ্ধ-স্থির, ছোট ছোট দ্বীপ ও সবুজ পাহাড় ঘেরা স্বচ্ছ জলরাশি, এতোটাই স্বচ্ছ যেন প্রেমিকার চোখে জমে থাকা ভালবাসা!





লক লমন্ডের প্রধান আকর্ষন হচ্ছে, বোটিং। ছোট ছোট নৌকা নিয়ে এই আবাধ প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়া, আর একটু দুরে হাতছানি দিয়ে ডাকছে যে দ্বীপগুলো, কাছে গিয়ে তাদের ছুঁয়ে দেয়া! বোটিং শেষে কিছুটা সময় দেয়া যায় এখানকার ইকো পার্কটিতে, এছাড়াও একটু কষ্ট করে পাহাড়ে উঠে স্বর্গের জানালায় অন্তত একবার উঁকি না দিলে শুধুই আফসোস!





এ অঞ্চলে লেকের এর প্রসঙ্গে যখন আসাই হলো, তখন বলে নেই আমরা আসলে ‘লক লমন্ডে’ গিয়েছিলাম ভুল করে। আমাদের যাওয়ার কথা ছিলো 'লক নেস' লেকে 'নেসি' নামে এক বহুল আলোচিত মনস্টারের খোঁজে। 'লক নেস মনস্টার' এর গল্পটা যদিও অনেক প্রাচীন। ষষ্ঠ শতাব্দীতে একজন ধর্মযাজকের লেখায় প্রথম এই দানব সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। এরপর নানা জন নানা ভাবে এই লেক এবং তার আশেপাশে অঞ্চলে নেসিকে দেখে থাকলেও, তাকে প্রথম ক্যামেরাবন্দি করা সম্ভব হয় ১৯৩৩ সালে। তবে তার কিছুটা স্পষ্ট অবয়ব ফুটে উঠে ১৯৩৪ এর দিকে ড. উইলসন এর বিখ্যাত শট 'সার্জন'স ফটোগ্রাফ' এ। যেখানে এই ‘চার ফুট উঁচু, ২৫ ফুট লম্বা, হাতির শুঁড়ের মত ক্রমে সরু গলা ওয়ালা দানব’-টাকে (যারা দেখেছে বলে দ্বাবি করে তাদের ভাষায়) দেখে আমি রীতিমত সাপ খুড়তে গিয়ে কেঁচো পাওয়ার মতই হতাশ হই! এটাকে আমার কাছে একটা পাতিহাঁস বা খুব বেশী হলে রাজহাঁসের ঝাপসা ছবি ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। অথচ তারপরেও এই তথাকথিত অদ্ভুত দর্শন প্রাণীটির চাক্ষুষ দর্শকের দ্বাবীদার দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। কল্পশিল্পীরা মনের মাধুরি মিশিয়ে এই মনস্টারের ছবি আঁকছে, যেখানে দেখা যায় বিশাল ডাইনোসরের মত শরীর আর হাতির শুঁড়ের মত গলা, মুখের দিকে খানিকটা রাজহাঁসের মত টাইপ এক জন্তু ‘লক নেস’ এর ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! কেউ আবার দুই ডিগ্রি বেশি মাথা খাটিয়ে একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে এভাবে, এটা Plesiosauria এবং সীল মাছের সঙ্গমে উদ্ভূত কোন হাইব্রিড প্রাণী। অথচ যেখানে গবেষকরা পুরো লেক কয়েকদফা ছেনেও এই কল্পিত বাবাজীর লেজটিও খুজে বের করতে সক্ষম হয়নি, এবং শেষে বিষয়টিকে ‘মডার্ন মিথ’ বলে ক্ষান্ত দিয়ে বোধহয় ‘Occum's Razor’ দর্শন বেছে নিয়েছেন। দর্শনটা হলো, "যখন কোন বিষয় নিয়ে একাধিক হাইপোথিসিস চলে আসে, তখন তাদের মধ্যে যেটা সবচেয়ে কম অনুমানভিত্তিক, সেটা গ্রহন করাই যুক্তিযুক্ত" (খুব সাধারণ হলেও বহুল কার্যকরি এক দর্শন)। কিন্তু এই অসামান্য মনস্টার নিয়ে এত বেশি হাইপোথিসিস তৈরি হয়েছে যে, Occum সাহেবের Rajor পদ্ধতিও নিত্য হিমশিম খাচ্ছে সন্দেহ নাই! আমিও 'এলিয়েন অটোপসি', 'তুংগুশকার বিস্ফোরনের' মত 'লক নেস মনস্টার'কেও আপাতত এক্স-ফাইলেই তুলে রাখি।

--------------------------------------------------------------------------------------------

শুভ্র শরৎ

আমার নেইবার এক সুইস মহিলা এখানে একটা রেস্টুরেন্ট চালায়। যার নাম 'মামা'স রেস্টুরেন্ট' বা মায়ের হোটেল। সবাই তাকে মামা ডাকে, সত্যি বলতে তার আসল নাম আমি এখনো জানিনা। সেই রেস্টুরেন্টই তার বাসা, উপরে একটা ঘরে সে থাকে। তার সাথে পরিচয় প্রায় তিন বছর আগে আমার এক বার্থডে তে তার রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলাম। আমরা তখন কেবল এখানে এসেছি, তখনো জানতাম না যে রেস্টুরেন্টটা তার, আমদের পাশের একটা টেবিলে সে দুটো কালো বাচ্চাকে খুব যত্ন করে খাওয়াচ্ছিল, বাচ্চাগুলোর একটার বয়স ২ থেকে ৩ বছর আরেকটা ৮ থেকে ৯ বছর। একসময় সে আমাদের কাছে এলো এবং জানতে চাইলো আমরা ডিনার এনজয় করছি কিনা। আমার ছেলে টুকুনের বয়স তখন আড়াই বছর, তার সাথে সে নানা কথা বলার চেষ্টা করলো, ওকে কিছু চকলেট দিলো। আমাদের সাথে টুকটাক আলাপ পরিচয়ে যখন জানলো যে আমরা নতুন এসেছি, তখন আমাকে জিজ্ঞেস করলো- তোমার ছেলেকে কোনো কিন্টারগার্ডেনে দিয়েছ কিনা?
আমি বললাম, আমি কিছুই চিনি না, তাছাড়া আমাদের গাড়ি এখনো নেয়া হয় নাই।

সে বলল- আমার এই ছোট মেয়েটা একটা নার্সারিতে যায়, তুমি চাইলে ওখানে ওকে দিতে পারো, আমিই একসাথে ওদের দেয়া-নেয়া করতে পারবো।

আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না এত্তো ছোট বয়সে ছেলেকে স্কুলে দেয়ার কোনো ইচ্ছা আমার ছিলোনা!
আমার মনের অবস্থা বুঝেই হয়তো সে বলল, কালকে তুমি আমার সাথে চলো, স্কুলটা দেখে আসো, যেহেতু তোমরা এখানে নতুন এসেছ ছেলেকে স্কুলে দিলে সে তার বয়সী আর কিছু বাচ্চার সাথে মিশতে পারবে, যা একটা নতুন এনভারমেন্টে দ্রুত এডজাস্ট হতে ওকে সাহায্য করবে।

পরদিন সকাল নটায় সে আমাদের নিতে চলে এলো, আমি আর টুকন তার সাথে গেলাম বলাবাহুল্য যা ছিলো টুকুনের জীবনের প্রথম স্কুল যাওয়া। সেখানকার রংবেরঙ-এর খেলার জিনিস দেখে ছেলে এতটাই মুগ্ধ যে খুব অল্প সময়ে সে সেখানে মেতে গেলো, আমি পরীক্ষামূলক তাকে দুঘণ্টার জন্য সেখানে রেখে এলাম। যেটা ছিলো সব মায়েদের মতই আমার জীবনের একটা উল্লেখজনক ঘটনা, সেই অনুভূতিটাকে কিসের সাথে তুলনা করবো এই মুহূর্তে ঠিক বুঝতে পারছিনা, পুরো রাস্তায় আমি মামার সাথে কোন কথা বলতে পারি নাই, জানি ছেলে ভাল আছে তারপরেও গলার কাছে একটা কান্না দলা বেঁধে আছে, মাঝে মাঝে যা চোখ গড়িয়ে নেমে আসছে।

মামা আমাকে বললো, "আমি তোমার অবস্থা বুঝতে পারছি আসলে সব মায়েদের জন্যেই এটা একটা কঠিন পরীক্ষা সময়, আমিও এটা এক সময় পার করেছি! বাট ট্রাষ্ট মি ইওর সন ইউল বি ফাইন, অ্যান্ড মামা'স হার্ট পেইনস মোর দেন দা বেবি'স!"

এভাবেই জীবনের একটা স্পর্শকাতর মুহুর্তের সাথে মামা-কে আমার একটু একটু করে জানা শুরু, যে কিনা আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে আফ্রিকা ভ্রমনে বের হয়েছিলো, পিছুটান বলতে তখনো কিছু ছিলোনা তার, স্বামী মারা গেছে তারও অনেক আগে, আর ছেলে মেয়রা সব বড় হয়ে যে যার মত ব্যস্ত, পৃথিবীটাকে নিজের মতো করে দেখার, জীবনটাও নিজের মতো করে কাটাবার এইতো সময়! ঘুরতে ঘুরতে একসময় সে আসে ছোট্ট দেশ গাম্বিয়ায়, অজানা কারণে ভাল লেগে যায় তার এই দেশটি, থেকে যায় এখানে। তার কাছ থেকেই জেনেছি যখন সে এখানে আসে জঙ্গলে ভরা ছিলো পুরো দেশটি, তারপরেও তার নিজের দেশ সুইজারল্যান্ড থেকে সম্পূর্ন বিপরীত আবহাওয়া, প্রকৃতি, পরিবেশের একটি দেশে সে কেন রয়ে গেলো তা শুধু সে-ই জানে! এখানে আসার তিন বছরের মাথায় তার বাবা মারা যায় বার্ধক্যজনিত কারণে। তার সাথে এসে থাকা শুরু করে তারই ছোট বোন নেলী, হয়ত নেলীর নিজের জীবনের নিঃসঙ্গতা কাটানোর আকাঙ্ক্ষাও ছিলো এর পেছনে আর একটা কারণ। কিন্তু সে সঙ্গও বেশি দিন উপভোগ্য হয় নাই তাদের দুবোনের কাছে। বাবার মৃত্যুর পর ক্যান্সার আক্রান্ত বোনটির চলে যাওয়াও সে মেনে নেয় প্রবল দৃঢ় মানসিকতার সাথে!

একদিন সে আমার বয়স জানতে চেয়ে হেসে বলেছিলো, আমার গ্র্যান্ড ডটার তোমার থেকে বড়। মামার বয়স আনুমানিক ৭০ থেকে ৭৫, কিন্তু তাকে আমি বৃদ্ধ বলতে পারিনা, কারণ তাকে বৃদ্ধ বললে আমার নিজেকে মৃত বলা লাগে অনেক আগেই! তার রেস্টুরেন্টের এমন কোনো কাজ নেই সে করে না, ভোর ৬ টায় উঠে সে দিনের প্রথম সিগারেট ধরায় এবং কাজ শুরু করে, সে একজন চেইন স্মোকার। গুনে গুনে ফোন করে সবজিআলা, মাছওয়ালা আর গোশওয়ালাকে, এছাড়াও খাতায় লিখে রাখা রুটিন মাফিক প্রতিটা কাজ সে করে নিয়মমতো।

কখনো সকালে সারা গায়ে রং মেখে টুকুনকে স্কুলে নিতে চলে আসে, আমাকে অবাক দেখে হয়তো অপ্রস্তত হয়ে বলে, "সকাল থেকে বাইরের দিকের ওয়াল গুলা পেইন্ট করছি, দেখতো বর্ডারের রংটা কেমন লাগছে? অনেস্টলি বলো! ওদের স্কুলে দিয়ে এসে দ্রুত বাকীটা শেষ করবো!"

যদিও এখানে যেকোন কাজের জন্যে লোক পাওয়া যায় খুব সহজে, কিন্তু তাদের অপেক্ষায় সে বসে থাকে না কখনো। বরং তাদের সাথে সমানে হাত লাগিয়ে তাদের চেয়ে বেশি কাজ সে নিজেই করে ফেলে। একাধিকবার তাকে আমি বাগানে কাজ করতে, সমানের রাস্তা বা ঝোপ পরিস্কার করতে, ছেড়ে রাখা পোষা কচ্ছপ খুঁজে বেড়াতে দেখেছি! বিকেলে প্রতিটা টেবিলে গিয়ে কাস্টোমারের সাথে কথা বলা, খাওয়া কেমন লাগছে জানতে চাওয়া। খাওয়া হয়ে গেলে ওয়েটারকে ডাকার বদলে নিজেই হাতের কাছের এঁটো প্লেটগুলো তুলে নিয়ে যাওয়া, সবকিছুই সে করে দিগুণ উৎসাহের সাথে। প্রতিদিন প্রচুর লোক আসে তার রেস্টুরেন্টে, শুধু খাওয়া নয় বরং মামার সাথে দুটো কথা বলে মনে শান্তি পেতে বা বলা যায় মামার সঙ্গ পেতে!
আবার যখন ওকে খুব ক্লান্ত লেগেছে, জিজ্ঞেস করেছি, তুমি ভাল আছ তো? তোমাকে অসুস্থ লাগছে কেন?

হেসে বলেছে, আমার এই মেয়েটা খুবই খারাপ বেবি, এখনও তাকে আমার কোলে নিয়ে ঘুমিয়ে দেয়া লাগে, যখনি মনে হয় ও ঘুমিয়ে পড়েছে বিছানায় শোয়ায় দিই, ব্যস! অমনি আবার জেগে যায়, ও সারারাত আমার কোলেই ঘুমাতে চায়! জানো, আমার আগের কোনো বেবি এত্তো দুষ্টু ছিলোনা! আবার আমাকে জিজ্ঞেস করে, তোমার ছেলে তোমার ঘুমের ডিস্টার্ব করে নাতো! বলা হয়নাই, যে দুইটা বাচ্চাকে সে পালছে তারা আসলে তার রেস্টুরেন্টে কুক এক মেয়ে, তার বাচ্চা। দুটাকেই সে অ্যাডপ্ট করেছে, তাদের থাকা-খাওয়া, ভাল স্কুলে পড়া সব কিছুই সে করছে নিজের সন্তানের মতই, ছোটটা দুই মাস বয়স থেকেই মামার কোলে ঘুমায়। প্রায় বিশ বছরে সে এখানকার চারটা নেটিভ বাচ্চা পালছে একদম ছোট থেকে, আগের দুইটাকে গ্রাজুয়েশনের জন্য ইংল্যান্ড পাঠিয়েছে নিজের চালানো রেস্টুরেন্টের সামান্য সঞ্চয় থেকে। কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম তার সাথে দেখা করতে, দেখি আর একটা ছোট নেওটা কোথা থেকে যোগাড় করেছে, কোলের মধ্যে নিয়ে বসে আছে, নাক দিয়ে যথারীতি ঝোল গড়াচ্ছে সেটা নিয়ে মামাকে তেমন বিচলিত মনে হচ্ছেনা। আমাকে দেখে উৎফুল্লের সাথে বলে ওঠে, দেখ এইটা আমার পাঁচ নাম্বার গাম্বিয়ান বেবি!

আসলে মানুষটাকে যত জেনেছি তত বিস্ময়ে অনুভব করেছি বেঁচে থাকার আসল সংজ্ঞা। বলতে গেলে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে একজন প্রকৃত সুখী মানুষকে। না, কোনো লাক্সারিয়াস জীবন, দামী গাড়ি, বাড়ি, কাড়ি কাড়ি টাকা, সন্তান-সন্ততি, আপনজন অথবা খ্যাতি, গতানুগতিক কোন কিছুরই পরোয়া করেনা তার সুখ! বরং নিজের পরিশ্রম এবং ভালোবাসায় গড়ে তোলা ছোট্ট একটা পেশা, সারাদিন তাতেই ব্যস্ত সময় কেটে যাওয়া, সেখানেই খুঁজে নেয়া আপনজনের মাঝে ভালোবাসা বিলিয়ে দেয়া, দিন শেষে হিসেবের বইটাতে খুচরো কিছু অংক, তারপরেও রাত্তিরে শ্রান্তির প্রগাঢ় ঘুম দেবার অবকাশ নেয় না সে! জীবনের জটিলতা, বয়স, একাকীত্ব সবকিছুকেই বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত সে যেন উপভোগ করছে শুধু নিজের মতো করে। হয়ত একেই বলে বাঁচা!

আমার আগের লেখা একাকীত্ব ছিলো নিঃসঙ্গতার জটিলতা নিয়ে একটা গল্প, আমাদের সমাজের বাস্তবতা নিয়েই লেখার চেষ্টা করেছিলাম, একটা উদাহরণ খুঁজছিলাম জীবনের প্রতি শক্ত ইতিবাচক মানসিকতাসম্পন্ন একজন ব্যক্তিত্বের, আমার চোখের সামনে ‘মামা’র চেয়ে ভালো উদাহরণ বুঝি আর পাওয়া সম্ভব না, আমাদের সমাজে যা বিরল! কেন একজন মানুষ ছেলে মেয়ে বড় করে, গতানুগতিক সব কাজের অবসরের পরে, নতুন করে শুধু নিজের জন্যে বাঁচতে পারবে না? সেসব কিছু করতে পারবে না যা সে আগে করার ফুরসৎ পায় নাই? জীবন তো ততদিন যতদিন মানুষের মনটা বেঁচে থাকে, কেন শরীরের অবসরের আগেই মনকে অবসর নিতে হবে! কেন বয়সের বেড়াজালে আগে মনকেই বেঁধে ফেলতে হবে! প্রতিটা বয়সের একটা নিজস্ব সৌন্দর্য্য আছে যেমনটা ফুটে উঠে নির্মলেন্দু গুণের কবিতায়- “যৌবনের শেষে শুভ্র শরৎকালের নেয় একটি গভীর, প্রশান্ত, প্রগাঢ় বয়স আসে; যখন জীবনের ফল ফলিবার এবং শস্য পাকিবার সময়।“

আমার মনে হয়, একজন মানুষের প্রয়োজন পৃথিবীতে কখনো ফুরায় না, যতদিন না সে নিজে তা মনে করে বরং সবসময় তার পৃথিবীকে দেয়ার বাকি কিছু থেকেই যায়---

(লেখাটি আমার বাবাকে উৎসর্গ করলাম)

একাকীত্ব


400x 

পর পর তিন রাত জেগে প্রজেন্টেশনটা প্রায় শেষ করে ফেললো আবীর। এটা নিয়ে তার তিনটি প্রজেন্টেশন হবে যা সে কোম্পানির হয়ে রেডি ও রিপ্রেজেন্ট করছে, আগের দুবার বেশ ভালো করায় এবারও বস তার ঘাড়েই এটা চাপালো। যদিও অফিসে কদর বাড়ছে ব্যাপারটা খারাপ না, তবে চিন্তা মাকে নিয়ে! কাজের প্রেশার বাড়লেই মা কেমন জানি অভিমানি হতে থাকে যদিও মুখে কিছু বলে না, কিন্তু আবীর বুঝে। মায়ের মলিন মুখটা দেখলে বুকের মধ্যে কোথায় যেন খচ খচ করে। একটা অপরাধবোধ ভর করে, ভাবে 
প্রেজেন্টেশনের ঝামেলাটা গেলে মাকে নিয়ে কোথাও বেড়িয়ে আসবে। আবার ভাবে মা রিটায়ারমেন্টটা কেন এত তাড়াতাড়ি নিতে গেল, কাজের মধ্যে থাকলে সে ভাল থাকত। থাক! আপাতত প্রেজেন্টেশন নিয়ে ভাবা যাক!

এলার্মটা ঠিক ছটায় বেজে উঠলো, ঝটপট উঠে পড়ে আবীর। এলার্ম বাজার সাথেই উঠা তার একটা অভ্যাস। শাওয়ার নিয়ে মায়ের ঘরে যায়, মা ঘুমোচ্ছে। পর্দার ফাঁক দিয়ে সকালের কোমল আলো এসে পড়েছে মায়ের মুখে, মাকে যেন একটা নিষ্পাপ ছোট্ট ঘুমন্ত মেয়ের মত লাগছে, মা মেঝেতে ঘুমোচ্ছে, সে মেঝেতে শুতেই বেশী পছন্দ করে। ধীরে ধীরে শব্দ না করে মায়ের কাছে গিয়ে বসে আবীর, মায়ের গালে আলতো করে হাত রাখে, পৃথিবীর সবচেয়ে মায়াবী মুখটি এ মুহূর্তে সে দেখছে চোখ ভরে! অজান্তে চোখ ভিজে উঠে তার, মা চোখ খুলে দেখে ফেলে এই ভয়ে দ্রুত উঠে পড়ে, নিজের ছেলেমানুষিতে নিজেই লজ্জা পায়!

রেডি হয়ে দুকাপ চা বানায়। মায়ের চা-টা সাবধানে পিরিচ দিয়ে ঢেকে মায়ের পাশে রাখে, একটা কাগজে যত্ন করে লিখে, "মা, আজ প্রেজেন্টশন আছে, দোয়া করো, আর সময়মতো খেও। ভালো থেকো, লক্ষ্মী মা।" কাপের তলায় কাগজটা রেখে চলে আসে, শব্দ না করে দরজা খোলা এবং লাগানোর কাজটা ঠিক মত করতে পারে সে। নেমে আসে নিচে অভ্যাসবশত তিনতলার বারান্দায় তাকায়, মা দাড়িয়ে আছে চোখে ঘুম, চুলগুলো খোলা, মাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। হাত তুলে বাই বলে আবীর, মা-ও হাত তুলে, দুজনেই হাসে। নিজের উপর বিরক্ত হয় সে, দরজা লাগানোর সময় হয়তো শব্দ হয়েছিলো! আবার ভাবে, ভালোই হলো মায়ের হাসি মুখটা দেখে যেতে পারছে, দিনটা শিওর ভালো যাবে।

----------------------------

মি. খালেক প্রসন্নমুখে বসে আছে আবীরের পাশে। প্রেজেন্টেশনে সে এতটাই মুগ্ধ যে নিজের উপর গর্ব হচ্ছে এবারও এটা আবীরকে দিয়েই করানোর জন্য। এই শান্ত, ধীরস্থির এবং গোছানো ছেলেটির প্রতি একটা ভালবাসা জন্মে গেছে তার। যদিও তাদের সাথে আর এক কোম্পানিকে ডাকা হয়েছে, কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতায় মি. খালেক জানেন কাজটা তারাই পাবে।

পরের কোম্পানির হয়ে প্রেজেন্টেশনে এলো একটি মেয়ে, স্মার্ট, উচ্ছল, প্রাণবন্ত আর চোখে চোখ রেখে কথা বলে। তারা যদিও আহামরি কিছুই হাইলাইটস করতে পারে নাই, তারপরেও কাজটি দুই কোম্পানিকেই দেয়া হলো।

আবীর ফিরছিলো লম্বা করিডোরটা দিয়ে, পেছন থেকে কেউ একজন ডাকলো, এক্সকিউজ মি, আপনার একটু সময় হবে?
ইয়েস, প্লিজ!
আমি কণা, আসলে আপনার সাথে পরিচিত হতে চাচ্ছিলাম। যেহেতু কাজটা আমাদের দুকোম্পানিই পেয়েছে, তো আমাদের একটু চেনা জানা থাকা উচিৎ,।
রাইট! আমি আবীর।
আমি জানি।
দুজনেই হাসল। আবীর ভাবছিলো কি বলবে এরপর, কিন্তু তার আর ভাবা লাগলো না। কণাই হেসে বলল,
কফি?
নো প্রবলেম।
এরপর কাজের কথা।

এবং তারপর,
কণা - প্রবলেম!
আবীর - সল্ভড!
কণা - হ্যালো!
আবীর - ইয়েস!
কণা - বলা
আবীর - শোনা
কাজের কথা, অকাজের কথা, শুধু কথা এবং একটু একটু করে যেন অনেকখানি জানা!


কণার কথা, ওর হাসি, ওর চঞ্চলতা বার বার ছুঁয়ে যায় আবীরকে। কণা ভালোবাসে ফুল, ও ভালোবাসে বই পড়তে, মুভি দেখতে কিন্তু হরর মুভি সে একদম পছন্দ করে না! ও প্রাণবন্ত, হাসি-খুশি, স্পর্শকাতর ওর ভেতরের অনুভূতি গুলো যেন এক নিমেষেই দেখা যায়, এতটা স্বচ্ছ ওর মন! কণার সাথে কোথায় জানি মায়ের সাথে মিল পায়, আবীর। কোথায় জানি একটা স্নিগ্ধ মায়া আছে ওর মধ্যেও! নিজের অজান্তেই আবীরের মন অপেক্ষা করতে থাকে কণার ফোনের জন্য, কিন্তু সে নিজে থেকে ফোন করতে পারে না, সবসময় একটা সংকোচ কাজ করে ভেতরে! কণা মাঝে মাঝে অভিমানী হতে থাকে, আশ্চর্য একটা মানুষ তো! নিজে থেকে একটা ফোনও করে না, খুব ভাব! যদিও সে কখনোই অভিমান ধরে রাখতে পারেনা, সব ভুলে নিজেই ফোন করে আবার। মায়ের সামনে কণার ফোন ধরতে অস্বস্তি লাগে আবীরের, সে উঠে বারান্দায় যায়। মা ছেলের সব কিছুই খেয়াল করে, আবীরের পরিবর্তনের ছোট্ট একটা আভাও বাদ পড়ে না মায়ের চোখ থেকে। মাঝে মধ্যে সময়-অসময় কণার ফোন করাটা ভালো চোখে নেয়না সে, নিজের মনেই বিরক্ত হয়, ভাবে আচ্ছা বেহায়া তো মেয়েটা!

-----------------------------------

কণা আবীরের বিয়ে হলো। কণার মনে বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দ! 

আবীরের মনে দায়িত্ববোধ ও ভাবনা মা-ও সমান খুশি তো! সে কি পারলো মায়ের কষ্টের সাগরে সুখের অন্তত একটা ঢেউ যোগ করতে!

আর মা, যদিও প্রচুর উৎসাহের সাথে সে ছেলের বিয়ে দিলো, সবার মুখে বউয়ের প্রশংসা শুনে গর্বে বুক ভরে গেলো, তারপরেও মনের মধ্যে কোথায় জানি একটা অজানা ভয় বাসা বাঁধল!

মায়ের আচরনে দিন দিন পরিবর্তন আসতে থাকে। দ্বিগুন উদ্দীপনার সাথে সে ছেলের যত্ন-আত্তিতে মেতে ওঠে। ছেলের যত্নে কোথাও যেন এক ফোঁটাও কমতি না হয় এ ব্যাপারে সে অস্থির থেকে অস্থিরতর হতে থাকে! ছেলের সকালের নাস্তা, দুপুরের টিফিন, জুতো পলিশ, কাপড় আয়রন এসব ব্যাপারে অতিমাত্রায় সচেতন হয়ে ওঠে। আবীর মায়ের অস্থিরতার কারণটা বুঝে, মাকে আগের চেয়ে আরও বেশী সময় দেয়ার চেষ্টা করে, তার মন থেকে সব আশংকা মুছে ফেলতে চায় নিবিড় মমতায়। অশেষ নির্ভরতায় তাকে আশ্বস্ত করতে চায়, ভয় নেই মা এইতো আমি আছি, হারাইনি কোথাও!

অফিস থেকে ফেরার সময় আবীর ফুল আনে মায়ের প্রিয় ফুল দোলনচাঁপা, যত্ন করে সাজিয়ে রাখে মায়ের ঘরে, আর কিছু ফুল আলাদা রাখে কণার জন্য, মায়ের চোখে লাগে। রাতে মায়ের পাশে অনেকক্ষণ বসে থাকে আবীর, মা টিভি দেখতেই থাকে তার ঘুমোতে যাওয়ার কোন তাড়া থাকে না।

আবীর সাবধানে বলে, মা আমি ঘুমাতে যাই অফিস আছে।


মা বলে, যাও।


আবীরের উঠে যাওয়া, দরজা লাগানো, অকারণেই আঘাত দেয় তার মনে!

এভাবেই চলতে থাকে, মায়ের মনের আশংকা যেন দিন দিন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে, সে যেন স্পষ্টই দেখতে পায়, এই মেয়ে তার ছেলেকে কেমন করে গ্রাস করছে, কেমন করে আবীরের জীবনে থেকে তার মার স্থান কেড়ে নিতে চাচ্ছে। কিন্তু এত সহজে এটা সে হতে দেবে কেন, ফলে প্রতিনিয়ত সে মেতে ওঠে প্রতিযোগিতায়, দমিয়ে রাখতে চায় কণাকে তার অন্যায় উদ্দেশ্য থেকে!
এদিকে ভীষণভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়া কণার স্বপ্নগুলো হাঁসফাঁস করতে থাকে! মাঝে মাঝে আবীরকেও অচেনা লাগে খুব! চেষ্টা করে সবকিছুর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে, কিন্তু ঝরণার মত কলকল করে বেয়ে যাওয়া কণার প্রকৃতি শুধু হোঁচট খেতে থাকে বারবার! প্রায়ই মনে হয় মানুষটির সমস্ত পৃথিবীই তো মাকে ঘিরে, এখানে আসলেই তার জায়গা নেই কোথাও! এত দিনের গল্প-উপন্যাস বা মুভিতে দেখা ভালোবাসার সব সংজ্ঞাগুলো মিথ্যে হয়ে যেতে থাকে!

আবীর পারে না কণার মনে কোন স্বান্তনা এনে দিতে, সে আসলেই অসহায়! সে পারে না স্বার্থপরের মত শুধু নিজের সুখ নিয়ে মেতে থাকতে। এতটা দীর্ঘ সময় যে মা জীবনের সব ঘাত প্রতিঘাত একাই সয়ে নিজের সবটুকু উজাড় করে তিল তিল করে শুধু তাকেই দিয়েছে, সে চায় না তার দেয়া কোনো অবদান খাটো করতে। তার মনে পড়ে যায় যখন মায়ের অফিসের কোনো প্রোগ্রাম, পিকনিক বা কারো বার্থডেতে যেত তখন সবার সাথে বাবা মা দুজনেই থাকত, তার সাথে থাকত শুধু মা। যখন স্কুলের প্যারেন্টস-ডেতে সবার বাবা-মা আসত, সেখানেও তার জন্য আসতো শুধু মা। তার মনে পড়ে কত রাতে জ্বরে যখন ঘুমোতে পারত না, তার পাশে সারারাত ভয়ে আতঙ্কে অস্থির হয়ে থাকতো মা। কখনও মাথায় পানি ঢালে, কখনও গা মুছে দেয়, কখনও থার্মোমিটারে জ্বর মাপে, আবার কখনও আজানা আতঙ্কে তাকে আঁকড়ে ধরে রাখে বুকের মধ্যে। এভাবেই কেটেছে তাদের কত অসংখ্য রাত, আবীরের টুকরো স্মৃতিতে আজও সব জীবন্ত। মায়ের সেই রাত জাগা ক্লান্ত চোখ আজও আবীরকে তাড়ায়, বার বার আবীর মাকে ভরসা দেয়ার চেষ্টা করে ভয় নেই মা, আমি আছি, হারাবোনা কখনও! মা-র যে আর কেউ নেই, ছিলনা! সারাটা জীবন মা একা, কেন! শুধু তার জন্য। মা চাইলে তো পারত সেই ভালবাসার ভাগ অন্য কাউকে দিতে, কিন্তু সেতো তা করেনি!

---------------------

আবীর মাকে নানা ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে! কণাকেও যাতে মা আবীরের মত করেই নিতে পারে সে চেষ্টা করতে থাকে। কণাকে দিয়ে মাকে বিভিন্ন বিষয়ের বই উপহার দেয়ায়, পড়ার এবং ব্যস্ত থাকার জন্য। তারা তিন জনে একসাথে সময় কাটায়, গল্প করে, ভাল ভাল মুভি দেখে, কখনও বাইরে খেতে যায়! উপরন্তু কণাকে দিন দিন মার আরও বেশী অসহ্য লাগতে থাকে, সব কিছুর মধ্যে কণার উপস্থিতি মা সহ্য করতে পারে না মোটেও! সে যেন আবার সেই আগের আবীরকে ফিরে পেতে চায়, যেখানে শুধু মা-ই ছিলো একমাত্র তার জীবনে আর কেউ না! তার শুধু মনে হতে থাকে কণা ষঢ়যন্ত্র করছে তার বিরুদ্ধে, আবীরকে কেড়ে নিতে! ভুলে যায় নীতিবোধ; রাতে চুপিসারে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করে কি বলছে ডাইনীটা, তার ছেলের মন ভোলাতে! কণার অনুপস্থিতিতে তার ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে ষঢ়যন্ত্রের কাল্পনিক কোনো চিহ্ন! এতো সহজে যেন সে ছেড়ে দিতে চায়না তার বুকের ধনকে, অন্যের কাছে! আবীরের কাছে কণাকে পদে পদে হেয় করতে সে সুযোগ খুঁজতে থাকে, তার প্রতিটা কাজের খুঁত বের করতে থাকে। তার কথা, কাজ এমনকি কাপড় পরার ধরণ নিয়েও শুরু করে সমালোচনা, বন্ধ হয়ে যেতে থাকে কণার আত্মীয় বা বন্ধুর সে বাড়ীতে আসা! স্বাধীনচেতা মেয়ে কণা ধীরে ধীরে অবাধ্য হতে থাকে, প্রতিবাদ করে। আবীরের সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। মায়ের অনেক আচরণের ব্যাখ্যা চায় কণা আবীরের কাছে, কিন্তু আবীর চুপ থাকে, কারন ব্যাখ্যা তার নিজের জানা নাই। মায়ের অনেক কথার প্রতিবাদ সে আশা করে আবীরের কাছ থেকে, কিন্তু আবীর চুপ থাকে, কারণ সে মাকে কষ্ট দিতে পারে না।

এক পর্যায়ে কণা আবীর আলাদা থাকতে শুরু করে, তাদের গড়া ভালবাসার নীড় পূর্নতা পাবার আগেই ভেঙে যায়! তাদের কোনো হিসাব মিলে নাই, তাদের কোন চেষ্টা সফল হয় নাই! আবীর শুধু ভাবে, এতদিন পর তাদের জীবনে একটা সুখী হবার অবলম্বন আসলো, তাও সইলো না! বরং কষ্ট শুধু বেড়েই গেলো! মাকে সে কখনই দায়ী করতে পারে না। দায়ী শুধু ভাগ্য! যেখানে তাদের জন্যে কোন সুখ লেখা হয় নাই! সেখানে শুধুই কষ্ট! ক্লাস সেভেন এ থাকতে মায়ের দেয়া জন্মদিনের উপহার সেই কলমটা যখন হারিয়েছিলো স্কুলে, সেটা জানার পর মা তার সাথে নির্মমভাবে আচরণ করছিলো, তারপরও সে মায়ের উপর রাগ হতে পারে নাই। শুধু লুকিয়ে কেঁদেছিল খুব! নিজের অপরাধবোধে দগ্ধ হয়েছিলো তার কিশোর মন! মায়ের মনের জলন্ত আগুন এমনিভাবে তাকে পুড়িয়েছে অসংখ্যবার! মায়ের দেয়া প্রতিটা উপহার সে যত্ন করে রেখেছে। মায়ের মুখে একটু হাসি দেখতে সে দিন রাত এক করে পড়েছে, মায়ের হাতে তুলে দিয়েছে স্কুলে প্রথম হওয়া উপহারের সব বই গুলো! যদিও স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে পড়তে যাওয়ার কথা সে ভাবতে পারে নাই কখনো, যেখানে তার বন্ধুরা একে একে সব বাইরে চলে যায়, সে রয়ে যায় মাকে আগলে!

-----------------

স্মৃতির পাতায় আরো দুটি শূন্য বছর যোগ হয়, কণা অতীত ভুলতে কিছুটা পড়াশুনা ও কিছুটা কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করে। এদিকে আবীরের জীবন মাকে নিয়ে আরো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, মায়ের অবস্থা দিন দিন অস্বাভাবিক হতে থাকে। মা কখনোই বাড়িতে উটকো মানুষজন বা কাজের লোক পছন্দ করতো না কারণ হলো সে বাইরের লোককে কখনোই বিশ্বাস করতে পারতো না, তার সব সময় মনে হত তারা কিছু চুরি করছে নয়তোবা কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। যে কারণে বাসায় কোনো কাজের মানুষ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি কখনো। মা এখন তাদেরই কারো কারোর কাল্পনিক অস্তিত্ব বাসায় টের পায়, যেমন- তারা বাসায় এসে লুকিয়ে থাকছে, মায়ের সব যত্নের জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে, মাকে দেখে হাসছে, মাকে নিয়ে নানান ধরণের বাজে কথা বলছে। মা কখনও প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে নয়তো বা প্রচণ্ড রেগে যাচ্ছে, কখনো জোরে জোরে তাদের বকাবকি করছে! লুকিয়ে তাদের কথা শোনার চেষ্টা করছে। রোজ সে এসব নিয়ে আবীরের কাছে অভিযোগ করছে, আবীর ওদের কিছু বলছে না দেখে আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে! মায়ের বড় বোন যিনি কিনা প্রায় এক যুগ আমেরিকায় আছেন, মা হঠাৎই জানালা দিয়ে আবিষ্কার করে, সে পাশের বাসায় বেড়াতে আসে অথচ তার কাছে আসে না, মা আবীরের কাছে অভিযোগ করে, প্রচণ্ড দুঃখ ও অভিমানে ফেটে পড়ে! আবীরের কোন যুক্তি সে মানে না! আবীর ফোনে বড় খালার সাথে মায়ের কথা বলিয়ে দেয়, কিন্তু তাতেও কাজ হয় না! 

বাইরে কোথাও গেলে মা বাসার ঠিকানা ভুলে যাচ্ছে, সামনে দিয়ে বারবার রিক্সা নিয়ে ঘুরছে অথচ চিনতে পারছে না নিজের বাড়ি, এক সময় ক্লান্ত হয়ে আবীরকে ফোন দিচ্ছে! মা তার সিগনেচার ভুলে গেছে! কখনো ভুলে যাচ্ছে আবীরের নাম, এমনকি তার নিজের নাম! 

আবীর মাকে বাসায় একা রাখতে পারছে না, অফিসে সে সারাক্ষণ অস্থির থাকে! কারো কাছে মায়ের অবস্থা বর্ণনা করতে পারে না, বসের বা কলিগের অনেক প্রশ্নের উত্তর সে এড়িয়ে যায়। চায় না মাকে নিয়ে মানুষের মধ্যে নানা আলোচনার সৃষ্টি হোক! মাকে সারিয়ে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে! নানাভাবে তার চিকিৎসা করাতে থাকে, মাকে একজন মানসিক ডাক্তার রিকমেন্ড করা হয়। ধাক্কা খায় আবীর সে মেনে নিতে পারে না তার একমাত্র অবলম্বন যে মা, যাকে নিয়ে তার জীবনের সব পথ চলা, সেই মা কি পাগল হয়ে যাচ্ছে!

-------------------

পি. জির সাইকিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র অধ্যাপক ড. সামাদ ইবনে আবদুল্লাহ। ষাটোর্দ্ধ মাঝারি গড়নের মানুষ, উজ্জ্বল চেহারা। বসে আছেন হাতে এক কাপ ব্ল্যাক কফি। কিন্তু তার কফির পেয়ালায় চুমুক দেয়ার কোনো তাড়া নেই, তিনি তাকিয়ে আছেন আবীরের দিকে, যেন কথা ছাড়াই শুধু সেই দৃষ্টি দিয়েই আবীরের ভিতরের সমস্ত শূন্যতা তিনি স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছেন! খানিকটা চিন্তার ছাপ যেন ফুটে উঠে তার কপালে, এভাবেই কাটলো অনেকক্ষণ! শেষে তিনি বললেন, মি. আবীর আপনি পাশের রুমটাতে বসুন, আপনার মায়ের সাথে আমি কিছু কথা বলতে চাই!

আবীর উঠলো, মা অসহায়ভাবে আবীরের দিকে তাকায়, আবীর চোখ দিয়ে মাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে যার অর্থ, 'ভয় নেই মা, আমি আছি!'

ড. সামাদ শুরু করেন এইভাবে, আপনি মিসেস. শিরিন আহমেদ। বয়স ৫৭। আপনি দির্ঘদিন কাজ করেছেন একটি প্রাইভেট ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসাবে, তাই তো? মা কোন উত্তর দেয় না, চুপ থাকে।

ড. সামাদ এবার মাকে প্রশ্ন করেন, মিসেস. আহমেদ আপনি আমাকে আপনার জীবনের একটি উল্লেখজনক ঘটনা বলবেন, আপনার হাজবেন্ড, মি. তারিক আহমেদ কীভাবে মারা গিয়েছিলেন?


মা, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, যেন লোকটা কেন এই অবান্তর প্রশ্ন করছে তা বুঝতে পারছে না!


ড. সামাদ কিছুটা সহানুভূতি প্রকাশ করে বলে, আমিই সত্যিই দুঃখিত, এই প্রশ্নটা করার জন্যে! কিন্তু আমাকে এটা জানতে হবে আপনার কাছ থেকে, আমি শুনেছি ইংল্যান্ডে তার একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিলো।


মা দৃঢ় ভাবে বলে উঠে, নাহ! তাকে খুন করা হয়ছিলো! 


খুন! আপনি কি নিশ্চিত?


মা বলতে থাকে, তার চোখে মুখে স্পষ্ট সে ঘটনার প্রতিবিম্ব ফুটে উঠতে থাকে, যেন পুরো ঘটনাটা ঘটেছে তার সামনে, মাত্র কিছুক্ষণ আগে! 


মায়ের পুরো বর্ননা ডাক্তার শুনে যায় চুপচাপ, কোথাও কোনো প্রশ্ন করে না। মাকে স্বাভাবিক হবার সময় দিলেন খানিকক্ষণ। তারপর বললেন, মিসেস. আহমেদ আপনি যদি অনুমতি দেন এবার আমি আপনার ছেলের সাথে কিছু কথা বলতে চাই? দয়াকরে আপনি ভয় পাবেন না, আমি তার কোন ক্ষতি করবো না। 

ড. সামাদ আবীরের সংকোচ কাটাতে স্নেহমিশ্রিত গলায় বলে, আমি তোমাকে তুমি বলি, আফটার অল, তুমি আমার ছেলের মতই। আবীর তুমি যদি মনে কর আমি সত্যি তোমাদের কোনো সাহায্য করতে পারি তো আমাকে আগে তোমার জীবন সম্পর্কে কিছুটা জানতে হবে। একটু থেমে তিনি আবার যোগ করেন, এটাতো তুমিও বোঝো যে তোমার জীবন আর তোমার মায়ের জীবন আলাদা নয়, আশা করছি তুমি আমাকে তোমার পূর্ণ সহযোগিতাটাই করবে!
আবীর বলা শুরু করে, আবীরের ছোট থেকে বড় হওয়া, মায়ের আদর, শাসন, তাদের সুখ-দুঃখ, হতাশা, একাকীত্ব কোনোটাই বাদ পড়ে না ড.সামাদের তীক্ষ্ণ অভিজ্ঞ দৃষ্টি থেকে।

আবীরের বেলায় ড. প্রয়োজনীয় প্রশ্ন করে সব যথাযথ বিস্তারিত জানার চেষ্টা করে - তোমার স্ত্রীর সাথে তোমার ডিভোর্স হয় কবে?


আবীর বলে, আমাদের ডিভোর্স হয় নাই। আমরা দু বছর আলাদা আছি।


তুমি কি মনে করো, সে এখন কেমন আছে?


আমি মনে করি সে এখন প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে পারছে!


আর তুমি?


আবীর একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলে, আমি ভাল আছি। একটা দমবদ্ধকর অবস্থায় তাকে দেখতে বরং আমার বেশী কষ্ট হতো, যা আমি আপনাকে বলেছি!


আমি কি তোমার স্ত্রীর এড্রেস বা নাম্বার পেতে পারি?


দু বছর তার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ বা কথা হয় না, আবীর বলে কিছুটা বিব্রত গলায়।


ড. সামাদ এবার খানিকটা জোরাল গলায় বলে, দেখো আবীর, তোমার মা দীর্ঘদিন যাবত একটা মানসিক জটিলতায় ভুগছেন। সেটা নিয়ে আমি পরে কথা বলবো। এখন যে বিষয়টা আমার কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ন মনে হচ্ছে তা হলো, তোমার মায়ের রোগটা সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত করেছে তোমাকে, অর্থাৎ তার এই মানসিক অসুস্থতার প্রত্যক্ষ শিকার তোমার নিজের জীবন! তাই আমি আগে তোমাকে এটেনশন দিতে বাধ্য হচ্ছি! Her isolation shouldn't cause your life!

------------------

তীব্র ঝড়ে অন্তঃসারশূন্য শুকনো গাছটি যেমন সবটুকু শক্তি দিয়ে, মাটিতে তার দূর্বল শেকড় আঁকড়ে শুধু টিকে থাকার চেষ্টা করে, দীর্ঘ দুবছর পর আবীরকে ঝড়ে প্রানপণে টিকে থাকার চেষ্টারত সেই গাছটির মতই মনে হয় কণার কাছে! তার শুকনো বিবর্ণ মুখ, রাতজাগা ক্লান্ত চোখ যেন বলে দেয় অনেক না বলা কথা! আঘাত করতে থাকে কণার প্রতিটি সত্ত্বায়, অথচ এখনও সে চোখে আছে সেই একই মুগ্ধতা, একই ভালোবাসা! 

কণা শুধু জিজ্ঞেস করে, কেমন আছ?

আবীর উত্তর দেয়, ভাল। 


এরপরে আজ আর কোনো কথা খুঁজে পায় না তারা দুজনেই!


পাশের ঘরে মি. সামাদ অলসভাবে বইয়ের পাতা উল্টিয়েই চলেছে আপাতত কণা আবীরের কাছে যাওয়ার তার তেমন কোন ইচ্ছে নাই। খানিকবাদে ব্যস্ত ভঙ্গিতে সে ঘরে ঢুকে, আহা! আমি বোধহয় তোমাদের অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম! উত্তরের অপেক্ষা না করেই সে বলতে থাকে, একটা লোমহর্ষক থ্রিলার পড়ছিলাম বুঝলে, যেখানে সুন্দরী নায়িকা প্রেমে পড়ে এক সুদর্শন মনোরোগ চিকিৎসকের, যার কাছে সে আসে নিজের একটা সমস্যা নিয়ে, এরপর ঘটতে থাকে একটার পর একটা খুন, চরম থ্রিল! শেষ না করে উঠতে পারছিলাম না!

এনিওয়ে, প্রথমে তোমাদের দুজনকে ধন্যবাদ আসার জন্য! আজ আমি তোমাদের যে কারণে ডেকেছি তা হলো আমি তোমাদের সাথে একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই, তোমাদের দুজনের সাথেই! আমরা বরং কফি খেতে খেতে কথা বলতে পারি, আমার এখানে ব্ল্যাক কফি আছে, চলবে?

আমার আলোচনার বিষয়টা হলো একটা রোগ। একটা মানসিক রোগ বা মানসিক অসুস্থতা। ড. সামাদ শুরু করেন, মানসিক জটিলতাগুলোকে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা বা পার্থক্য করা বেশ কঠিন, কারণ এগুলো অন্যান্য শারীরিক রোগ যেমন ধরো ক্যান্সারের মত না, যেখানে তার জীবাণুগুলোকে ল্যাবে নিয়ে চোখে দেখে নির্দিষ্ট করা বা পার্থক্য করা যায়। মানসিক রোগগুলোর ক্ষেত্রে সে অবকাশ নেই। তাই বলে যেকোন শারীরিক রোগের চেয়ে এর ভয়াবহতা কিন্তু কোন অংশে কম না, বরং বেশী! যেখানে রোগীর নিজের জীবনের সাথে আশেপাশের জন, হয়ত তার সবচেয়ে কাছের এবং প্রিয় মানুষটির জীবনও সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে! অথচ আসল কারণটা থেকে যাচ্ছে সবার চোখের আড়ালে।

আবীরের মা মিসেস. শিরীন আহমেদ দীর্ঘদিন যাবত এমনি একটি মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন, যার নাম Schizophrenia। যাকে বলা যায় একটা মানসিক অস্থিরতা, মনের একটা ভয়ংকর জটিলতম অবস্থা, একটা অস্পষ্ট দ্বিখণ্ডিত ব্যক্তিত্ব এবং কিছু ব্যাখ্যার অতীত আচরণ, যাকে নির্দিষ্টরূপে সংজ্ঞায়িত করা সত্যি খুব কঠিন কাজ! মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, সিজোফ্রেনিয়া একটা দীর্ঘস্থায়ী মানসিক ব্যাধি, যাকে চরিত্রায়ন করা হয় ব্যক্তির চিন্তা, আচরণ এবং সামাজিক সমস্যাগত উপসর্গ থেকে। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক পারসেন্ট, অর্থাৎ একশ জনে একজন মানুষ এই রোগটি দ্বারা আক্রান্ত। যেখানে কেবল মাত্র United States এ এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দুই মিলিয়নের বেশী, সেখানে আমাদের দেশের মত সামাজিক সমস্যাসঙ্কুল একটি দেশে এ রোগীর সংখ্যা নেহায়েত কম না, এটা সহজে অনুমান করা যায়! আমাদের দেশের মত উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এই রোগগুলো সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা। শিক্ষিত হোক আর অশিক্ষিতই হোক, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে মানুষ জানেই না ঠিক কোন কোন উপসর্গগুলোর ক্ষেত্রে আমাদের চিকিৎসার জন্যে একজন মানসিক ডাক্তারের শরনাপন্ন হওয়া উচিত! উপরন্তু মানসিক রোগ মানেই পাগল, আর এর চিকিৎসা মানে পাগলের চিকিৎসা এধরনের ভ্রান্ত ধারনার কারণে এবং সামাজিক নানা জটিলতায় ছোটখাটো উপসর্গ যা হয়ত শুরুতে দমন করা সম্ভব, তা প্রাথমিক পর্যায়ে রোগী বা পরিবারকর্তৃক গোপন করা হয় বা গুরুত্ব দেয়া হয় না। যতদিনে তারা বুঝতে পারে যে চিকিৎসা প্রয়োজন ততদিনে আসলেই দেরী হয়ে যায়!

সিজোফ্রেনিয়ার কারণ - চিকিৎসাশাস্ত্রে আজো অব্দি এই রোগের কোন নির্দষ্ট কোনো কারণ আবিষ্কার হয়নি। কিছু জেনেটিক, মানসিক ও পারিপার্শ্বিক জটিলতার ফলস্বরূপ এই রোগ ধরে নেয়া হয়। বলা হয়ে থাকে শতকরা চল্লিশ ভাগ ক্ষেত্রেই এই রোগ মানুষ পারিবারিকভাবে বহন করে যা অনুকূল পরিবেশে বিস্তার লাভ করে। অনুকূল পরিবেশ বলতে সামাজিক বিছিন্নতা, কাজের মধ্যে না থাকা, মানসিক একাকীত্ব, কোনো উল্লেখজনক ঘটনা ইত্যাদি, ধরে নেয়া যায় আবীরের বাবার আকস্মিক মৃত্যু তার মায়ের মধ্যে এ রোগ বিস্তারে অনুকূল পরিবেশ তৈরী করছিলো।

সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ - একজন সিজোফ্রেনিয়াগ্রস্ত রোগী দীর্ঘদিন এ রোগের লক্ষণগুলোর আশঙ্কাজনক বহিঃপ্রকাশ না ঘটিয়েও দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারে, অনেকটা সুপ্ত আগ্নেয়গিরি ভেতরে ধারণ করার মত, আবার যখন এর লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে শুরু করে, তখন দ্রুতই অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে! যে লক্ষণগুলো দ্বারা এই রোগ চিহ্ণিত করা যায় তা হলো-
অতি মাত্রায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাতিকগ্রস্ত বা শূচিবাই
সামাজিক বিছিন্নতা
প্রচন্ড রাগ, অস্বাভাবিক ভয়
ইনসোমনিয়া অথবা ওভারস্লীপিং
সন্ধেহপ্রবনতা- মানুষকে বিশ্বাস করতে না পারা, সবসময় একটা ধারণা পোষণ করা যে অন্যরা তার বা তার আপন জনের ক্ষতি করবে। মানুষকে তার সাভাবিক আচরনের জন্যে প্রশ্ন করা!
হেলুসিনেশন বা ডিলিউশন- এমন কিছু দেখা বা শোনা যার বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নাই। প্রায়ই কারো কথা শুনতে পাওয়া, যারা তাকে নিয়ে কথা বলছে বা ষঢ়যন্ত্র করছে। বাসায় এমন কাউকে বা কিছু দেখতে পাওয়া যার প্রকৃত কোনো অস্তিত্ব নাই! 


কোন ঘটনাকে সাধারণত নিজের মত করে যুক্তিসঙ্গত ভাবে ব্যাখ্যা করা, যার সাথে সত্য বা বাস্তবতার সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। সাধারণত এই রোগি নিজেকে তার কল্পনার জগতে বন্দি করে ফেলে, কোন ব্যক্তি, বিষয় বা ঘটনা সম্পর্কে সেভাবেই ব্যাখ্যা করে যেভাবে সে সেটা কল্পনা করতে চায়। তার এই কল্পনার বিপক্ষে কোনো যুক্তি সে গ্রহণ করেনা। যেমন, আবীরের মা তার হাসবেন্ডের মৃত্যু সম্পর্কে যে গল্প বলেছেন, সেটা সম্পূর্ণই তার কল্পনা থেকে। তার মনের কোন সন্দেহ থেকে সে নিজেই সেই গল্প বানায়। নিজের বানানো গল্প সে নিজে এমনভাবে বিশ্বাস করে, যেন ঘটনাটা ঘটেছে তার সামনেই, যেন সে এখনো তা দেখতে পায়! অথচ যেখানে মি. আহমেদ এর মৃত্যু হয় ইংল্যান্ডে আকস্মিক এক রোড এক্সিডেন্টে এবং সে সময় মিসেস. শিরীন তার চার বছরের সন্তান আবীরকে নিয়ে বাংলাদেশেই ছিলেন। 

বিষয়টা এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, প্রথম দিকে রোগীর মধ্যে দুইটা সত্ত্বা বা ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি হয়। একটা কাল্পনিক আর একটা বাস্তব। কাল্পনিক সত্ত্বা সবকিছু নিজের মত করে ব্যাখ্যা করতে চায়, আর বাস্তব সত্ত্বা সেই কল্পনাকে বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য করানোর চেষ্টা করে, ধীরে ধীরে এই কল্পনা আর বাস্তবের লড়াইয়ে বাস্তব সত্ত্বা আত্নসমর্পণ করে, রোগী আটকা পড়ে তার নিজের তৈরি কাল্পনিক গোলকধাঁধায়, যেখান থেকে বের হবার আর কোনো পথ থাকে না!

ধীরে ধীরে এই লক্ষণগুলো বাড়তে থাকে, হেলুসিনেশন প্রকট মাত্রায় বেড়ে যায়, রোগী কল্পনা ও বাস্তবের মধ্যে কোনো পার্থক্য করতে পারে না। অসংলগ্ন কথা বা হাসি এবং ধীরে ধীরে কথা বলা কমিয়ে দেয়া বা ভুলে যাওয়া, জড়ানো অস্পষ্ট কথা, পড়তে বা লিখতে ভুলে যাওয়া, নিজের দেখাশুনা, প্রাত্যহিক কাজ গুলো করতে না পারা, যার ফলে রাগ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়া, যারা সাহায্য করতে চেষ্টা করে তাদের উপর ক্ষিপ্ত হওয়া, সহযোগিতা না করা বরং আক্রমণাত্বক হয়ে উঠা! পরিণামস্বরূপ Paranoia, Dementia, Stroke, Paralysis ইত্যাদি।

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে মানসিক এই রোগগুলো শুধু সামাজিকভাবেই অবহেলিত নয়, চিকিৎসাশাস্ত্রেও এগুলো প্রয়োজনের তুলনায় এখন পর্যন্ত অতি সামান্যই গুরুত্ব পেয়েছে। মানুষ মারার জন্যে এক একটা যুদ্ধে প্রতিনিয়ত যে পরিমান অর্থ ব্যয় হয়, অথবা মানুষের প্রসাধনী নিয়েও যে পরিমান গবেষণা হয়, এই রোগ গুলোর পেছনে তার সিকি পরমান অর্থ বরাদ্দ অথবা গবেষণা হয়না! এই রোগগুলোর যথাযথ ওষুধ এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয় নাই, যে ওষুধ দিয়ে রোগীকে পুণরায় আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া অথবা সম্পূর্ন স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। আমারা আশা করি, হয়ত আজ থেকে ১৫ বা ২০ বছর পর এমন কোন ওষুধ আবিস্কার করা হবে যা এই রোগ সারাতে ব্যবহৃত হবে! বর্তমানে যে ড্রাগগুলো এ রোগের ট্রিটমেন্ট হিসাবে দেয়া হয়, সেগুলো মূলত রোগী মানসিকতা (রাগ, আতংক, উদ্বিগ্নতা) কে দমিয়ে রোগীকে শান্ত ও স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে, এব্যাপারে কিছু সাইকোথেরাপিও সাহায্য করতে পারে। সত্যি বলতে পারিবারিক থেরাপি বা কেয়ারের বিকল্প কিছুই নাই!

এই মুহূর্তে ড. সামাদ কণার দিকে তাকায় এবং বলে, একজন মানুষের ভেতরের একাকীত্ব থেকে অদ্ভুত এই রোগটি জন্ম নেয়, নাকি এই রোগটির জটিলতার কারনেই ক্রমান্বয়ে সে একা হয়ে পরে, তার সঠিক উত্তর আমার জানা নেই। তবে এতটুকু জানি, আমাকে কেউ প্রচণ্ড ঘৃনা করে এবং অন্যদিকে আমার নিজের ভালবাসার মানুষটির জীবনেও আমার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই, এটা মেনে নেয়াই যেমন যথেষ্ট কারো জীবন থেকে দুরে সরে যাওয়ার জন্য, তেমনিভাবে একজন মানুষ ভয়ংকর অসুস্থ এবং সাথে আমার সবচেয়ে আপন মানুষটির জীবনে এক চিলতে আশ্রয়ের জন্যেও কেবল আমাকেই প্রয়োজন, এটুকু কম না ফিরে আসার শক্তির যোগাতে।

ড. সামাদ এবার আবীরের কাছে যায়, আবীরের মাথায় হাত রাখে, বলে, কণা! তুমি কি সেই পাখিটার গল্প জানো? যে পাখিটা কখনো খোলা আকাশে মুক্ত ডানা মেলে অন্যদের মত নিশ্চিন্তে উড়তে পারেনা! কারণ তার মন পরে থাকে নীড়ে, যেখানে তার রুগ্ন মা আছে, যে মায়ের ডানা বহুকাল আগেই এক ঝড়ে ভেঙ্গে গিয়েছিলো, সে ক্ষতটা রয়ে গিয়েছে এখনো! তুমি কি সেই পাখিটার মনের ভালবাসার ক্ষমতা অনুভব করতে পারো?

কণা কাঁদছে, আবীরের চোখে জল!

---------------------------------------------------------------------------------------