Saturday 2 March 2013

উপন্যাসের প্রিয় চরিত্রগুলো (প্রথম পর্ব)

জীবনটা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়া উপন্যাসের কোনো চরিত্র না। যেখানে সুখ-দুঃখ, ভালোলাগা-মন্দলাগা, হাসি-কান্নার মত ছোটবড় প্রতিটি অনুভূতির গাঁট ধরা থাকবে অভিজ্ঞ কোন হাতের যাদুকরীতে। জীবনের প্রতিটা বাঁক বরং আরো অনেক বেশি বর্ণিল, আপেক্ষিক, অনিশ্চিত ও বৈচিত্র্যময়। কোথাও চরম আবার কোথাও নির্মল যা আগে থেকে অনুমান করা কঠিন। তারপরেও ভালো লাগা উপন্যাসের প্রিয় কোন চরিত্রের মাঝে প্রায়শই আমরা ফুটে উঠতে দেখি নিজের প্রতিচ্ছবি। অবাক হয়ে ভাবি এও কি সম্ভব! নিজের ভেতরের স্বপ্ন, ইচ্ছে, চেপে রাখা না বলা কথাগুলো নির্জীব কাগুজে ক'টা পাতায় কেমন করে এত সহজে প্রাণ পেয়ে গেল। আজ এরকমই কিছু উপন্যাস ও তার চরিত্র নিয়ে লিখতে বসলাম। যার ভেতরে অসংখ্যবার ভিন্ন সময়ে ভিন্ন আঙ্গিকে আমি আয়নার মত প্রতিবিম্বিত দেখেছি আমার চারপাশটা, প্রিয়-অপ্রিয়-চেনা-অচেনা মানুষ, কখনো নিজেকে...

 পার্ল এস. বাকের মাঃ 

মা হলো গ্রামের অতি সাধারণ পরিশ্রমী বর্গাচাষী নারীদের একজন। গ্রামীণ জীবনধারা, পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ, কঠোর পরিশ্রম এসবকিছুর সাথে একজন নারীর মনের কল্পনাবোধ, স্বপ্ন, মমতা, রাগ-ক্ষোভ-ঈর্ষা এরকম অনেক চেনা অনুভূতির অদ্ভুত সংমিশ্রণ ফুটে ওঠে এই এক চরিত্রের মধ্যে দিয়ে। পুরো উপন্যাস জুড়ে যে চরিত্রটিকে লেখিকা সম্বোধন করে যান কেবল 'মা' নামেই। মা ছাড়া অন্য নাম চরিত্রটির সাথে যায় না। 

এই সাধারণ গ্রামীন কৃষক রমণীর ভেতরের স্বপ্ন, সাধ, আকাংখাগুলোও আর দশটা মেয়ের মতই অতি সাধারণ। বর্গা নেয়া জমিটুকুতে সকাল-সন্ধা ঘাম ঝরিয়ে শস্য ফলানো, পুরো দিনমান বীজ বুনে সন্ধায় ঘরে ফেরার পথে কল্পনায় সে বীজ শীঘ্রই অঙ্কুর হয়ে চারা বের হবে এই ভাবনা তার মনকে অদ্ভুত সুখানুভূতিতে আচ্ছন্ন করে রাখে। ঘরে ফিরে সন্তানদের মুখে তৃপ্তির অন্ন তুলে দিয়ে তার সমস্ত ক্লান্তি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। মায়ের কোমলমতি মনের ভাগ থেকে বাদ যায় না বাড়ির কুকুর বা অন্য পোষা প্রাণীগুলোও, যাদের খাইয়েও মা সমান তৃপ্তি পায়। তারাও সন্তানের মতই দিনভর মায়ের ফেরার পথ চেয়ে থাকে। মায়ের অকৃত্রিম ভালবাসা ভরা মনটার প্রকাশ পায় এভাবেই নিজের সন্তান, শাশুড়ি ও বাড়ির প্রতিটি জীব যারা মাকে নির্ভর করেই বেঁচে থাকে তাদের প্রতি তার নিরলস দায়িত্ববোধ ও মমতা থেকে। সাথে নানা কাজের মাঝেও অন্ধ হয়ে আসা মেয়েটার ভাবনা মাকে অস্থির করে তুলে।

মা তার স্বামীকে ভালবাসতো। কারণ স্বামীর কারণে সে পেয়েছে সন্তানধারণের মত গর্ব। নিজের মাতৃত্বের ক্ষমতায় মা একজন গর্বিত নারী। স্বামীর আত্নকেন্দ্রিক সভাব, আড্ডা-জুয়া-বিলাসীতা, সংসার ও কাজের প্রতি অনীহা কারণে কখনো ভেতরের ক্ষোভ চেপে রাখতে না পেরে মা ফেটে পড়তো, এরকম সামান্য এক ঘটনার পর স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়, আর ফিরে না। দিনের পর দিন মা অপেক্ষা করে থাকে স্বামীর জন্যে, ভালো রেঁধে তুলে রাখে। সংসারের এতগুলো মানুষের দায়িত্ব এসে পড়ে মায়ের কাঁধে, যা সে একাই পরিশ্রম ও দক্ষতার সাথে পালন করতে থাকে। কিন্তু পৃথিবীর সবখানেই বুঝি কোন মেয়েকে তার স্বামী ছেড়ে যাওয়াটা সমাজের চোখে স্বামীর বা পুরুষের দ্বায়িত্বজ্ঞানহীনতার চেয়ে সেই মেয়েরই দোষ বুঝায়। আর অন্যেরাও তখন নিজের কাজ ফেলে সেই মেয়ের দোষ ঘাটতে অতিউৎসাহী হয়ে পড়ে। নিশ্চয়ই তার কোন দোষ আছে নাহলে স্বামী তাকে ছেড়ে যাবেই বা কেন, এরকম প্রশ্নে মায়ের নারীসত্ত্বা, অহমকে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে। যেকারণে মানুষের নানা প্রশ্নের নানা কটূক্তির জবাবে সে মিথ্যে বলা শুরু করে। গ্রামের মানুষের মুখ বন্ধ করতে শহরে গিয়ে স্বামীর নাম করে নিজের ঠিকানায় চিঠি লিখিয়ে নেয়া শুরু করে যে, স্বামী তার শহরে ভালো চাকুরী করছে। সবার মুখ বন্ধ হয়, মায়ের ভেতরের হাহাকার রয়েই যায়।

দ্বিগুণ পরিশ্রমে মাঠের কাজ, সংসারের ভরণপোষণে লেগে যায় মা। শরীর ও মনের জোরে হয়তো সে একজন পুরুষের চেয়েও বেশি ফসল ফলায়, সন্তানের মুখে ভালো খাবার তুলে দেয়, কিন্তু তারপরেও সে অন্যের চোখে রয়ে যায় একজন নারী হয়েই। যে কারণে খুব সহজে জমিদারের নায়েবের কুনজরে পড়ে এই স্বামী পরিত্যক্তা নারীটি। এখানে বলে রাখা ভালো যে, লেখক মা-কে ধরাছোঁয়ার বাইরে দোষগুণের উর্দ্ধে কোন দেবীর আসনে নেননি। মা-কে তিনি এঁকেছেন সাধারণ একজন নারী অথবা মানুষ হিসেবে। আর মানুষের আচরণে নিশ্চিত করে কিছু বলা মানে তার উপর জোড় করে কিছু চাপিয়ে দেয়া। যেখানে মানুষের আচরেন নিশ্চিত বলে কিছু নেই। ততদিনে স্বামী ফিরার আশাও মা বাদ দিয়েছে। উপরুন্ত স্বামীর ছেড়ে যাওয়ায় তার ভেতরে যে অপমানবোধ, যে ক্ষোভ জমেছিলো, তার শোধ নিতে চেয়েছে নায়েবের সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে। কিন্তু এখানেও মা প্রতারিত, লোভী নায়েবের পুরুষ দৃষ্টি যে শুধু মায়ের নারী শরীরটাকে চেয়েছিলো, তা বুঝে প্রথমবারের মতো সন্তান ধারণ তার কাছে গর্বের চেয়ে পাপবোধ ও আত্নানুশোচনার জন্ম দেয়। এ পাপ থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে সে শরীরের উপর চিরস্থায়ী যন্ত্রনার ছাপ নিয়ে।

মা একসময় বুড়িয়ে যায়, তার ছেলে সমর্থ হয়। ঘড়ে বউ এসে মায়ের স্থান নিতে থাকে, সেখানে চলতে থাকে ছেলের বৌয়ের সাথে চলে মায়ের কর্তৃত্বের সংঘাত। সংসারে তার স্থান অন্য কেউ নিয়ে নিচ্ছে তা মেনে নেয়া মায়ের কাছে কষ্টকর হয়ে পড়ে। উপন্যাসের শেষে মায়ের সবচেয়ে ছোট ছেলের জমিদারের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার মধ্যে দিয়ে চীনের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটে। জনসম্মুখে মায়ের চোখের সামনে নিজের প্রিয় সন্তানের মৃত্যদন্ড, চরম মানসিক বিপযস্থ অবস্থায়ও এক নব জাতকের কান্নার আওয়াজ মায়ের ভেতরে সব হারানোর মাঝেও কিছু পাওয়ার অনুভূতি জাগায়।

  
'মা' চরিত্রটিকে লেখিকার নিজের মূল্যায়নঃ পার্ল এস. বাক তার বিশাল উপন্যাস 'দা গুড আর্থ' এর পরপরই 'দা মাদার' লিখেন, যা লিখে তিনি নিজে খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। বিষয়টা আমার কাছে 'চোখের বালি' উপন্যাসে বিনোদিনী চরিত্রটির সাথে ন্যায় করতে না পারায় রবীন্দ্রনাথের ভেতরে যে আত্ননুশোচনা রয়ে গিয়েছিলো খানিকটা সেরকম লেগেছে। রবীন্দ্রনাথ যেমন সেকালের সমাজের বেড়াজাল থেকে হিন্দু বিধবা স্ত্রী বিনোদিনী-কে বের করতে পারেন নি, বাকও তেমন চীনের সে সময়ের সমাজ ব্যবস্থায় একটি নারীর একা থাকার যে যন্ত্রণা, সমাজের নিয়মকানুন পারিপার্শ্বিকতায় সে যন্ত্রণা আরো আরো তীব্র হয়ে ওঠা থেকে এই চরিত্রটিকে বের করতে পারেননি।

পুরো চরিত্রটির ভেতর লেখিকা নিজে নারী হিসেবে তার অনেক অনুভূতি, উপলদ্ধি ও চিন্তাভাবনা অকপটে লিখে গিয়েছেন যা একটু খেয়াল করলেই আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়, যেমন - মাতৃত্ব নিয়ে বাকের নিজের যে ভাবনা ও অব্যক্ত হতাশা তাও এই 'মা' চরিত্রটির মধ্যে স্পষ্ট ফুটে ওঠে।

মায়ের প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়নঃ প্রকাশক Peter Conn যিনি পরবর্তীতে বাকের দ্বিতীয় স্বামী ছিলেন, তিনি এই উপন্যাসটিকে “Pearl S. Buck: A Cultural Biography” বলে উল্লেখ করেন। 'মা' সম্পর্কে Peter Conn লিখেন - “veered perilously close to a personal confession, an unguarded glimpse into the secrets of her sexual and maternal frustration”। পার্ল এস. বাকের 'দা মাদার' উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৪ সালে। বলা হয়ে থাকে এই উপন্যাসটির মাধ্যমে বিশ্ব-সাহিত্যের পটে চীনের গ্রামীণ সমাজে নারীর অবস্থানের যথাযথ নিখুঁত চিত্রায়ণই তাকে এনে দিয়েছিলো ১৯৩৮ সালে নোবেল অর্জনের মত দুর্লভ খ্যাতি।

মা চরিত্র ও উপন্যাসটি আমার মূল্যায়নের দুঃসাহসঃ যদিও মায়ের স্বামীর তুচ্ছ ঝগড়ার জের ধরে রাগের বশে চলে যাওয়াটা বুঝা গেলেও, একবারে ফিরে না আসাটা আমার কাছে রহস্যই থেকে গেছে। তারপরেও এটা অস্বীকার করার উপায় নাই 'দা মাদার' উপন্যাসটি পড়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত এর কেন্দ্রীয় চরিত্র মা আমার ভেতরে আসে ঘুরেফিরে, বার বার। একজন স্ত্রী বা জননী হিসেবে নয় বরং একজন নারী হিসেবে এ চরিত্রটি আমাকে ভাবিয়েছে অনেক বেশি। বলতে গেলে আমার আশেপাশের অনেক জটিলতা, সমাজে নানা অবস্থানের নারীদের সীমাবদ্ধতা, প্রাপ্তি ও হতাশাগুলো চিনতে শিখিয়েছে নতুন করে, সম্মান করতে শিখিয়েছে নিজ নিজ অবস্থানে নিত্য টিকে থাকার চেষ্টারত প্রতিটি নারীকে। সাথে অবাক হয়েছি লেখিকার চরিত্রটির ভেতরে ঢুকে তা বিশ্লেষণের ক্ষমতা দেখে, তাই ভেবেছি হয়ত তিনি নিজেও একজন নারী ছিলেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। চীনের সেকালীন গ্রাম্য সমাজের রীতিনীতি ও কাঠামো পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণও লেখিকার নিখুঁত দৃষ্টি ও একটি প্রান্তিক সমাজের সাথে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা আমাকে মুগ্ধ করেছে।

No comments:

Post a Comment