Monday 11 February 2013

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে



































বাসায় একসময় একটা টিয়া পাখি আনা হয়েছিলো, তখন ছিল বাকের ভাইয়ের যুগ। মানে বিটিভিতে হুমায়ূন আহমেদের 'কোথাও কেউ নেই' নাটকের সময়কাল। তাই ওটার নাম রাখা হলো 'বাকের ভাই'। পাশের বাড়ির মীমরাও আমাদের দেখে একটা টিয়া কেনার জেদ ধরলো, শেষে সফলও হলো। ওদেরটার নাম রাখা হলো 'বদি'। তো বাকের ভাই আর বদি সারাদিন একসাথেই থাকে, কারণ মীম, মুন দু'ভাইও সারাদিন আমাদের বাসায় থাকে, স্কুলের সময়টা বাদ দিয়ে। আপুর খুব শখ বাকের ভাই আর বদি-কে দিয়ে 'তুই রাজাকার' বলাবে। সে শখ পূরণ করতে সারাদিন আমাদের পাখি দু'টোর খাঁচার সামনে বসে বলা লাগত - তুই রাজাকার, তুই রাজাকার... যদিও কাজের কাজ কিছু হয়নি, বাকের ভাই আর বদি 'তুই রাজাকার' বলায় কোনো আগ্রহ দেখানি। ওরা ওদের মত ক্যাঁ ক্যাঁ করেই যেত।

বদি ছিলো কিছুটা শান্ত স্বভাবের আর বাকের ভাই ছিলো পুরা দস্যি, অস্থির আর ছটফটে। মাঝে মাঝে অকারণেই সে তার গলা ফাটিয়ে ক্যাঁ ক্যাঁ করে চিৎকার শুরু করে দিত। আব্বা ভাবলো ছোট খাঁচায় বুঝি ওদের কষ্ট হচ্ছে, তাই বাঁশ দিয়ে ওত্যন্ত মেহনত আর দক্ষতার সাথে অসম্ভব সুন্দর দু'টো খাঁচা বানিয়ে দিলো। খাঁচাগুলো এতো সুন্দর হয়েছিলো যে সবাই এসে পাখি না দেখে মুগ্ধ হয়ে খাঁচাই দেখতো। আফসোস! তখন আমাদের কোনো ক্যামেরা ছিলো না, নাহলে হয়ত অন্তত একটা ছবি থাকতো সেই খাঁচা সাথে বাকের ভাই আর বদির! যাই হোক সুন্দর খাঁচায়ও বাকের ভাইয়ের অস্থিরতা কমে না। আব্বা আবিষ্কার করল যখন অন্য টিয়ারা ক্রমাগত চিৎকার করতে করতে ঝাঁক বেঁধে আকাশ দিয়ে উড়ে যায়, তখনই আমাদের বাকের ভাই অস্থির হয়ে ওঠে, চিৎকার করে অন্যদের জানাতে চায় যে সে আটকা পড়ে আছে। সেও তো একটা পাখি, খোলা আকাশটা তাকেও টানে পাখিদের মতই! এটা জানার পর থেকে আমাদের কষ্ট লাগা শুরু হলো তার জন্য। শেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো ওকে ছেড়ে দিব। মীম, মুন প্রথমে যদিও রাজি হয়নি শেষে ওরাও ওদের পাখিটাকে ছেড়ে দিয়েছিলো। 

যেদিন বাকের ভাইকে ছেড়ে দেয়া হলো, সেদিন আমাদের তিন ভাই-বোনের মনের অবস্থা ভাষায় প্রকাশ করার মত ছিলো না। সকাল থেকে খাঁচার দরজাটা খুলে রাখা হয়েছিলো, অথচ বাকের ভাই বের হচ্ছিলো না। হয়ত মানুষের নির্মমতায় অভ্যস্ত পাখিটি আকর্সিক এই মহানুভতার কোনো অর্থ খুজে পাচ্ছিল না। অন্যদিকে আমারা ভাবলাম সে হয়তো আমাদের ভালোবেসে ফেলেছে, তাই ছেড়ে যেতে চাইছে না। তারপরেও আব্বা তাকে খাঁচা থেকে বের করে উড়িয়ে দিলো, প্রথমে ও অল্প একটু উড়ে উঠোনের পেয়ারা গাছটাতে গিয়ে বসলো। শাটা এবার জোরেশোরে বুকে চেপে বসলো। আমি মনে মনে বলতে থাকলাম, বাকের ভাই যেয়ো না, যেয়ো না, প্লিজ... একসময় ও ঠিকই চলে গেল। আমাদের আশা তবুও কাপের তলানীর অবশিষ্ট চায়ের মত রয়েই গেল - মনে মনে ভাবতাম যখন ওর আমাদের কথা মনে পড়বে তখন ঠিক ফিরে আসবে। রোজ সকালে উঠে উঠোনের পেয়ারা গাছ, আশেপাশের সব ক'টা গাছে খুঁজতাম। আমাদের বাকের ভাই আর ফিরে আসেনি, ফিরে আসেনি মীমদের বদিও। শুধু টিয়াপাখিদের শেখানোর চেষ্টায় অনবরত আওড়ানো - 'তুই রাজাকার' আমাদের মগজে গেঁথে থাকলো। এরপর 'তুই রাজকার' অনেকদিন আমাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল বাজে কোনো গালি হিসেবে। যদিও 'রাজাকার' শব্দের ভেতরের প্রকৃত বীভৎসতা আমি বুঝেছিলাম আরো অনেক পরে।

 















আজ ছোট বেলার প্রিয় বাকের ভাইয়ের কথা খুব বেশি মনে পড়ছে, পাখিটার কষ্টটা এতদিনে আমি নিজের ভেতরে স্পষ্ট উপলদ্ধি করছি - যখন হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে প্রকাণ্ড অচিনপুরের লাল ধুলোর সাথে মিশে তাদের শ্লোগান -"রাজাকারের ফাঁসি চাই" আমার কাছে পৌছায়... আর খাঁচায় আটকে পড়া পাখির মত ডানা ঝাপটে ছটফট করা ছাড়া আমার কিছুই করার থাকে না। একই শ্লোগান তো আমারও ভেতরে। তাই চোখ বন্ধ করে আমিও তাদের সাথে সুর মেলাই। এই মিছিলে, এই কাতারে মিশে যেতে চাই। 

এ অক্ষমতার মাঝেও যে ভাবনা আমাকে অনেক বেশি স্বস্থি দিচ্ছে, তাহলো - চারপাশে এ শ্লোগানের রবে আমাদের পরের প্রজন্মের মগজে রাজাকার ও রাজাকারের ক্ষমার অযোগ্য পাপের চেহারাটা গেঁথে যাচ্ছে একই সাথে। আন্দোলনের এই অর্জনটাও আমার কাছে কম মনে হচ্ছে না।

 















রাজাকার তো রাজাকার, রাজাকারের শেকড়বাকড়, ফলপাকড়, বীজঅঙ্কুর পর্যন্ত মুক্ত সত্যিকারের স্বাধীন একটা বাংলাদেশ উপহার দিবো এই হোক পরের প্রজন্মের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার!

(ছবিগুলো সংগৃহীত)

No comments:

Post a Comment