Wednesday 23 January 2013

ভগ্নাংশ

গাড়ি চলছে ঝড়ের গতিতে। বাতাস চিরে বেরিয়ে যাওয়ার শাঁ শাঁ শব্দ আর ইঞ্জিনটার একঘেয়ে গোঙ্গানি। উইন্ডস্ক্রিনে আছড়ে পড়া কুয়াশা আর চোখের কোণে জমে থাকা মেঘ, সামনে দমবন্ধকর ঘোলাটে রহস্য। বার বার ওয়াইপার ঘুরিয়ে কাঁচটা পরিষ্কার করার ব্যর্থ চেষ্টা করে দীপ্ত। ভেজা পথ দ্রুত মাড়িয়ে যেন মুহূর্তে পৌঁছে যেতে চায় আবেগ থেকে দুরে, বাস্তবতার কাছাকাছি। ক'টা মাসে জমে থাকা অনেক কাজ সারতে হবে। তারপরেও এই চেয়ে নেয়া বিরতি স্বস্তি এনে দিচ্ছেনা কিছুতেই। পিছনে কিছু একটা ছুটে যাওয়ার অনুভূতি আঁকড়ে বসছে বুকে, কিছুতেই তাড়াতে পারছে না সেটা। পাশের সিটে বসে আছে খেয়া। "গাড়ি থেমে আছে কেন?!" - অস্থিরতা ফুটে উঠে তার কণ্ঠে?

"হানড্রেড ফরটি।" নির্লিপ্ত জবাব দীপ্তর।


বছর পাঁচেক আগে এক ব্রিটিশ কোম্পানির কাজ নিয়ে দেশ ছাড়ে দীপ্ত। তার প্রায় দুই বছর পর অনেকটা আত্নবিশ্বাস আর স্বপ্ন নিয়ে মাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। ছোট ভাইয়ের কাছে মায়ের অবস্থার বিবরণ পেতে পেতে ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠতো সে। প্রথমে বিশ্বাস হতে চাইতো না, যে মানুষটি জীবনের সব প্রতিকূলতার মোকাবেলা করে একাই তিনটি ছেলে মেয়ে বড় করলো, সে কিভাবে এত দ্রুত অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়তে পারে! তবে মায়ের যে কিছু অস্বাভাবিকতা আগে থেকেই ছিলো, এটা অস্বীকার করতে পারে না সে। তারপরেও তাদের একমাত্র নির্ভরতার আশ্রয় সেই মায়ের অস্বাভাবিকতাগুলোকে কিছুটা স্বাভাবিক জ্ঞান করেই তারা বেড়ে ওঠে। অহেতুক সেসব ঘাঁটতে যেয়ে তাদের কষ্টের জীবনে বাড়তি বোঝা বাড়ানোর দুঃসাহস হয়নি কখনো।

ধীরে ধীরে মায়ের সেই জটিলতাগুলোই প্রকট হতে থাকে। একটু একটু করে সে ভুলতে থাকে অনেক কিছু - ছেলেমেয়েদের নাম, বাড়ির ঠিকানা এমন কি নিজের সিগনেচার। সাথে তার পূর্বের কিছু সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে, যেমন - সবসময় বাড়িতে কাল্পনিক কাউকে দেখতে পাওয়া, যে তাকে অনুসরণ করছে অথবা তার অতি মূল্যবান কিছু চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে, তাকে নিয়ে কেউ বাজে কথা বলছে বা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, অনবরত কল্পনায় এরকম উদ্ভট কিছু দেখতে বা শুনতে শুনতে এগুলো নিয়ে সে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়া শুরু করে। ধীরে ধীরে তার উদ্বিগ্নতার পরিমাণ এতই বেড়ে যেতে থাকে যে তাকে সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। চিৎকার করে সে অদৃশ্য কারো সাথে ঝগড়া শুরু করে অথবা টিভিতে কোনো নাটক বা সিনেমা দেখতে দেখতে সেই চরিত্রগুলোর সাথে কথা বলা শুরু করে, আবার কখনো আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের সাথে তর্ক করতে থাকে। প্রথম প্রথম এরকম পরিস্থিতিতে খেয়া কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে দীপ্তকে ফোন করতো, ভয়ে কেঁদে ফেলতো। মাকে যুক্তি দিয়ে কখনোই কিছু বোঝানো যায় না দেখে তারা অসহায় বোধ করতো, পরে বুঝতে পারে কোনো প্রকার যুক্তি আসলে মায়ের ভেতর পর্যন্তই পৌছায় না।

সবসসময় কল্পনায় ধুলো খুঁজতে থাকা মানুষটি নিজেই আটকে পড়ে চারপাশের কাল্পনিক ধুলো-ময়লার জগতে। গায়ের জামার কোণা তুলে ঘন্টার পর ঘন্টা সে কল্পনায় দেখতে পাওয়া ধুলো ঝাড়তে থাকে, কখনো উপুড় হয়ে বসে হাতের তালু দিয়ে ঘষে ঘষে সারাদিন মেঝে পরিষ্কার করতে থাকে, ক্লান্তিতে তার গা দিয়ে ঘাম ঝরতে থাকে, চোখ বুঁজে আসে, অথচ তাকে তুলতে গেলে সে বিরক্ত হয়ে, গায়ের সব শক্তি দিয়ে ঠায় বসে থাকতে চায় সেখানেই, খেয়া তাকে তুলতে পারতো না, কখনো খুব বেশি ক্লান্ত হলে মা মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়তো।

ডাক্তারের মতে মায়ের মধ্যে দেখা দিচ্ছে একসাথে মানসিক জটিলতার নানা দিক। দীর্ঘদিন লালন করা সিজোফ্রেনিয়ার সাথে ভুলে যাওয়ার রোগ ডিমেনশিয়া, যে কারণে তার ব্রেনের সেলগুলো খুব দ্রুত ড্রাই হয়ে যাচ্ছে। সে এখন পরিণত হয়েছে এমন একজন মানুষে যে কল্পনা আর বাস্তবের মধ্যে তফাৎ করতে জানে না। ভুলে গিয়েছে নিজের নিত্তনৈমিত্তিক প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতে, ভুলে গিয়েছে অতি আপনজন এমনকি নিজের ছেলেমেয়েকে পর্যন্ত। মানসিক পঙ্গুত্ব শারীরিক পঙ্গুত্বের চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর হতে পারে, যখন একটা শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সক্ষম ব্যক্তি নিজেকে কল্পনার জগতে আটকে একটি শিশুর চেয়ে বেশি অবুঝ ও অক্ষম হয়ে যায়। যারা হয়তো তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে প্রতি মুহূর্তে চেষ্টা করে যাচ্ছে, তার অত্যাবশ্যকীয় কাজগুলো করে দিচ্ছে, তাদের প্রতিই সে হয়ে ওঠে অসহনশীল বা কখনো কখনো আক্রমণাত্মক।

মাঝে মাঝে জীবনের নির্মমতায় হতবাক হয়ে যায় খেয়া, এরই মাঝে নিজের মা হবার ক্ষণিকের অনুভূতিতে নেচে উঠেছিল সে, যা তার ভেতরে রয়ে গিয়েছে শুধুই যন্ত্রণার ছাপ হয়ে। ভয়ানক মানসিক চাপ আর দুর্বল শরীর নিয়ে জীবনটা তার কাছে তখন হয়ে উঠেছিল অর্থহীন। বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে একঘেয়ে ঘড়ির কাঁটার শব্দ, আর চারপাশের অন্ধকার যেন তাকে গিলে ফেলছিল প্রতি মুহূর্তে। গাদা গাদা ঘুমের ওষুধ দিয়ে তখন তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হতো, ঘুমের মধ্য অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখতো খেয়া, ভাইয়ের সাথে তাদের বাড়ির পেছনের মাঠটাতে ছুটছে সে, ছুটছে তো ছুটছেই, একসময় ছুটতে ছুটতে আকাশে ভাসতে শুরু করে, ছোট-বড় অদ্ভুত গোলমেলে সাইজের রঙবেরঙের প্রজাপতি বা পাখি ঠিক স্পষ্ট মনে পড়ে না সব তাকে ঘিরে তার সাথে শূন্যে ভাসতে থাকে... হ্যালুসিনেশন বা কল্পনা যে কিভাবে একটা মানুষের কাছে বাস্তবতার চেয়ে বেশি প্রিয় হতে পারে, তা এভাবেই বিছানায় শুয়ে শুয়ে অসহায়ের মত নিজেকে দিয়ে যাচাইয়ের সুযোগ পেয়েছিলো খেয়া। যখন নিজের ক্লান্তি আর কষ্ট থেকে পালাতে সে লুকোতে চাইতো হেলুসিনেশনের জগতে।

--------------------------

তাদের একটা ব্রেক দরকার ছিল। ব্রেক শুরু হলো, হঠাৎ করেই যেন সব ব্যস্ততা থেমে গেল, ঢেউয়ের তালে তালে দুলতে থাকা ভেলাটি আচমকা ঢেউ থেমে গেলে যেমন খানিকটা দিগজ্ঞানশুন্য বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তাদের অবস্থাও এখন কিছুটা তেমন। দীপ্তর বড় বোন এসেছিল, মাকে নিতে। সামনে ছ'মাস মেয়ের সাথেই থাকবে সে। তিন বছরে এই প্রথম এতো দীর্ঘ সময় মা দীপ্ত আর খেয়াকে ছাড়া কোথাও থাকবে।

যে কোনো কষ্ট ভুলতে বাবার স্মৃতি হাতড়ানো ছোট থেকে দীপ্তর একটা নেশার মত। যেমন - এই মুহুর্তে বাবা থাকলে কি করে তাদের বিবর্ণ ধূসর দিনগুলো রঙে ভরে যেত, কোন যাদুবলে তাদের সব কষ্টগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে যেত, এসব ভেবেই কেন জানি মনটা ভালো হয়ে যেত তার। যদিও চার বছরের ছোট্ট স্মৃতিতে খুব বেশি থাকার কথা নয়। তবু আধো-অন্ধকার, ঝাপসা স্মৃতি অথবা বাবাকে নিয়ে শোনা গল্প সব তার ছোট্ট মনের কল্পনায় গুলিয়ে চোখের সামনে দেখা রঙিন অতীত বলেই ধরা দেয়। কাঠের ফ্রেমে লাল-হলুদ ডোর দেয়া শক্ত খদ্দরের কাপড় আঁটানো ইজি চেয়ারটাতে বাবা রাতের খাবার পর বিশ্রাম নিতো, শীতের রাতে ছোট্ট দীপ্তকে নিজের গায়ে জড়ানো চাদরটার ভেতর ঢুকিয়ে বুকের কাছে নিয়ে চার্লিস এঞ্জেলসের টিভি সিরিস দেখতো। এতো ছোট বেলার কথা তার মনে থাকার কথা নয়, কিন্তু আশ্চর্য, মায়ের কাছে শোনা এই গল্পটা তার মাথায় এমন ভাবে গেঁথে আছে, যেন এখনো চোখ বন্ধ করলে সে বাবার গায়ের উষ্ণতা পায়। একদম জীবন্ত লাগে কল্পনায় অসংখ্যবার টেনে টেনে দেখা খুব প্রিয় সেই স্মৃতিটাও - যেখানে বাবার মুখ ভরা সাদা ফেনা, খুব যত্ন করে শেভ করছে সে, ছোট দীপ্ত অবাক হয়ে তা দেখছে। বাবার চোখ তার দিকে পড়তেই, আচমকা আঙ্গুলে করে একদলা ফেনা তার গালে মাখিয়ে দেয়। সে কেঁদেছিল কিনা মনে নেই, শুধু মনে পড়ে বাবা হাসছিল। কেন জানি সেই হাসি বার বার তার কাছে উচ্ছাসে ভরা, প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। যখনি এ স্মৃতি মনে পড়ে মানুষটাকে অসম্ভব ভালো লাগে তার। কল্পনায় সবসময় বাবার মুখে সেই একই হাসিটা দেখতে পায় দীপ্ত, শিশুর মত সরল সে হাসি।

বাবার মৃত্যুর স্মৃতি খুব বেশি ভাবতে চায় না দীপ্ত। জানে অসম্ভব মেরিটোরিয়াস এই ভাল মানুষটিকে নিয়ে সবাই খুব গর্ব করতো। বিলেত থেকে পড়ে এসে দেশের জন্যে যে ভাল কিছু করবে, সবাই তা জানতো। তাই দুই ছেলে-মেয়ে ও অন্তসত্ত্বা স্ত্রীকে রেখে উচ্চ শিক্ষা তাগিদে বিদেশে যেতে বাধ সাধেনি কেউ। কিন্তু মানুষের অনেক প্রত্যাশাই ভয়ঙ্করভাবে অপূর্ণ থেকে যায়। দীপ্তর মনে পড়ে কেমন করে একটি ফোন তাদের জীবন উলটপালট করে দিল। ঘরভর্তি মানুষ, হুলস্থুল ব্যাপার, প্রায় সবার চোখ সেদিন ভেজা ছিল। কেবল স্থির পাথরের মূর্তির হয়ে বসে ছিল মা। বাবা যে আর ফিরে আসবে না, এটা তখনো বুঝে উঠে নাই সে, শুধু মায়ের রক্তশূন্য ফ্যাকাশে মুখটা তাকে অস্থির করত। এখনো সে মুখ তাকে অস্থির করে। 

সবাই সেদিন মাকে কাঁদতে বলেছিল, বলেছিল বুকের ভার হালকা করতে। 'আল্লাহ্‌ যা করে ভালোর জন্যে করে' - এসব বলে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কোন সান্তনাই তাদের আর সেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিতে পারে নাই। দীপ্ত জানে মানুষটাকে কেড়ে নিয়ে সৃষ্টিকর্তা তাদের সাথে অবশ্যই ভালো কিছু করে নাই বরং অবিচার করেছে। সে ও তার বছর চারেক বড় বোন আর বাবা ইংল্যান্ড যাবার মাস কয়েক পর পৃথিবীর আলো দেখা ছোট ভাইটার জন্যে বাবার আকস্মিক মৃত্যু কোনো ভালো কিছু ছিল না। তিনটে অবুঝ শিশু নিয়ে জগতের বৈরী জল-বাতাসের বিরুদ্ধে একা টিকে থাকার যুদ্ধও তাদের মায়ের জন্যে ভালো কিছু ছিল না। সে জানে মানুষটা থাকলে তাদের সবার জীবন অন্যরকম হতো - সারাক্ষণ নিজেকে নিয়ে মেতে থাকা বোনটার জীবন, বাবার এক টুকরো স্মৃতি কপালে না জুটা ছোট ভাইটার জীবন, কিছুটা আত্নভোলা চাপা স্বভাবের তার নিজের জীবনও অন্যরকম হতে পারতো। আর সবচেয়ে অন্যরকম হতো, তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে সারাজীবন নিরপত্তাহীনতায় ভুগা, পৃথিবীর সব মানুষের প্রতি সন্দেহ আর অবিশ্বাসের দৃষ্টি পোষণ করা, উদ্বিগ্নতা আর উৎকণ্ঠা নিয়ে অদ্ভুত সব নিয়মের বেড়াজালে নিজেকে বেঁধে ফেলা তাদের মায়ের জীবন। ছোট বেলায় দীপ্তর উদ্ভট কিছু নেশা ছিল, তার মধ্যে একটি ছিল - দাদীর ছেড়ে রাখা পোষা মুরগীগুলোর পেছনে ছোটা। তাদের মধ্যে কোনটার যখন ছানা থাকতো, তখন তারা ভয়ঙ্কর রকম আক্রমণাত্নক হয়ে উঠতো। মুরগী তাড়াতে যেয়ে একবার এরকম এক মা মুরগীর তাড়া খেয়ে সে নিজেই ড্রেনে পড়ে গিয়েছিল। যখন অন্যদের সাথে মায়ের ঝগড়া বাঁধতো, তখন মায়ের ভয়ংকর আক্রমণাত্মক রূপ প্রায়ই দীপ্তকে সেই মা মুরগীটার কথা মনে করিয়ে দিতো।

কর্কশ একটা হর্ন দিয়ে প্রায় গা ঘেঁষে পাশ কাটিয়ে গেল বেশ বড় একটা কাভার্ড ভ্যান। ধাতস্ত হতেই খেয়াল হলো, বাড়ির টার্নটা বহু আগেই পেছনে ফেলে হাইওয়ে ধরে সোজা চলে এসেছে অনেকখানি। পাশে খেয়া বসে আছে নির্বিকার। সামনে একটা ইউটার্ন নিয়ে পিছে ফিরে আসার পথ খুঁজছে দীপ্ত... ক্রমে স্পষ্ট হয়ে আসছে ট্রাফিক লাইট, একদম ডানের রাস্তাটা ধরে দুটো বাক পেরলেই তাদের ঘর।

দীপ্তর কাঁধের কাছটা আলতো করে খামছে ধরে, প্রায় অস্পষ্ট সরে খেয়া বলে ওঠে - আস্তে যাও প্লীজ!

মানুষের প্রতিটা আচরণের আসলেই কি কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব, একটু আগেই যে অবস্থা থেকে দ্রুত আরো দ্রুত পালাতে চাইছিলো সে, গন্তব্যের খুব কাছে এসে সে গতিই কমাতে চাইছে প্রানপনে। ঘরের খুব কাছে এসে তার উপলদ্ধি হয়, ঘর ছুটে যাচ্ছে আস্তে আস্তে...

----------------------

No comments:

Post a Comment