Wednesday 20 March 2013

উপন্যাসের প্রিয় চরিত্রগুলো (তৃতীয় পর্ব)

দীপার সাতকাহনঃ



আসামের চা বাগান, গাছগাছালি, বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদীটার উপর রাতের জোনাকীর খেলা, চাঁপার ঘ্রাণ আর খুব ভোরে শিউলি কুড়ানো - দীপার গল্প যেন প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা প্রতিটি মেয়ের গল্প। মায়ের চোখরাঙ্গানি, পিটুনি, ঠাকুমার নিষেধ উপেক্ষা করে সে ছুটে যায় বার বার খোলা মাঠ, পথ-ঘাট পেরিয়ে - কখনো ফুল কুড়োতে তো কখনো বড়শী নিয়ে বন্ধুদের সাথে মাছ ধরতে। আশ্চর্য! প্রকৃতি তো বাছবিচার করে না তার অকৃত্রিম-অফুরন্ত রং-রূপ ঢেলে দিতে ছেলে অথবা মেয়ের। তার বন্ধু খোকন আর বিশু ছেলে, তাতে কি! ওদের কাছেও তো আঙরাভাসা নদীটা নীল আর চা বাগানগুলো সবুজ, একই রঙ একই গন্ধ। তাহলে কেন মা-ঠাকুমার যত বিপত্তি তার মেয়ে হয়ে বাইরে যাওয়ায়। খোকন, বিশুরা ফড়িং বা মাছ ধরতে যেতে পারলে সে পারবে না কেন? ওরা হাঁটুর উপরে প্যান্ট পরলে কোন দোষ নেই - অথচ দেয়াল টপকে পার হতে, গাছে উঠতে বা কোছা ভরে ফুল কুড়োতে তার যদি একটু হাঁটু বের হয়েই যায়, তাতেই বা কি এমন দোষ? এরকম চারপাশের প্রকৃতির প্রতি একটি শিশুর সরল-সহজাত আকর্ষণ, আর পদে পদে বাধা পেয়ে অন্ধকারে নিত্য আলোর শিখা খুঁজতে থাকার মতই তার ছোট মনে দানা বেঁধে উঠতে থাকা মেয়েদের উপর সমাজ আরোপিত নানা বিধিনিষেধের প্রতি প্রশ্ন। যার উত্তর একটাই - সে মেয়ে!

দুঃস্বপ্নের মত দীপার জীবনে সেই তের বছরেই জড়িয়েছিল এক নিষ্ঠুর অতীত। শুধুমাত্র উত্তরাধিকারের জন্যে এক আত্নকেন্দ্রিক ধনী পরিবারের রোগাক্রান্ত, মৃতপ্রায় ছেলের সাথে তার বিয়ে দেয়া হয়। কিছু ভয়ানক অভিজ্ঞতা বুকে নিয়ে সেদিন পালিয়ে বেঁচেছিল সে। এই অপরিনামদর্শি, জীর্ন বাঁধন নিশ্চিতভাবেই তার ভাগ্যে রেখে যায় বিধবার কালো দাগ। জীবনের এই নির্মম অধ্যায় মুছে ফেলে সে শুরু করতে চেয়েছে নতুন জীবন। পুঁজি ছিল প্রতিকূলতায় হার না মানা তার দৃঢ় মনোবল। কঠোর পরিশ্রমে গড়ে নিতে চেয়েছে নিজের ভাগ্য। সাথে তার স্রোতের মত গতিশীল মনে ঝড় তুলত নানা প্রশ্ন, যার উওর সে পায়নি কারুর কাছে - বিধবারা পেয়াজ, ডিম, মাছ-মাংস খেলে কি হয়? কেন মেয়েদের পদে পদে কঠোর অনুশাসনের মধ্যে না চললে ভগবানের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে? কোন ভগবান? কি তার নাম? ধর্মের এই একচোখা নিয়মগুলোর বিরুদ্ধে এভাবেই তার ভেতরে ফুটে ওঠে প্রতিবাদী স্বাধীনচেতা এক রূপ।

দীপাবলী এমন এক চরিত্রের নাম, যাকে ভাগ্যদেব সুপ্রসন্ন হয়ে কখনো নিরবিচ্ছিন্নভাবে কিছু দেয়নি। বেঁচে থাকার জন্য, সমাজে নিজের জায়গা করে নেয়ার জন্য যাকে প্রতিটি মুহূর্ত লড়ে যেতে হয়েছে - কখনো পারিপার্শ্বিকতার সাথে তো কখনো নিজের সাথে। কঠোর পরিশ্রমে অর্জন করে নিয়েছে আয়করের চাকুরী, সম্মান, প্রতিষ্ঠা, বেছে নিয়েছে জীবনসঙ্গী। তারপরেও তার লড়াই থেমে থাকে নাই। আত্নমর্যাদা ও আদর্শের লড়াই আপনাআপনি কখনো থামে না, তার উপর দীপা নারী, আর নারী মাত্রই তো এসব ঠুনকো অনুভূতি বিসর্জন দিতে দিতে প্রাণহীন কাঠপুতুল হয়ে টিকে থাকা, নয়তো বা নিছক ঐ এক আত্নমর্যাদা আঁকড়েই জীবনে চরম কিছুর মূল্য দেয়া। দীপা আপোষ করার মেয়ে নয়। স্বপ্নপূরণ ও মুক্তির আশায় সে কারুর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে না। আপনজন, কাছের মানুষের আত্নকেন্দ্রিক লোভী চেহারাগুলো তাকে ক্ষতবিক্ষত করলেও নিজের নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে সে থেকেছে অনড়। এবং সবশেষে সে আপোষহীন, অবিচল ও একা।



লেখক সমরেশ মজুমদার তার জনপ্রিয় উপন্যাস 'সাতকাহন' এর দীপাবলী-কে এঁকেছেন আপোষহীন সংগ্রামী এক নারী চরিত্র হিসেবে। কেন দীপাবলীর মত এমন একটি চরিত্রটি তার মনে এল এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন - "আমি এগারো বছর বয়সের একটি বিধবা মেয়ে দেখেছিলাম। সে আমাদের চা বাগানের। তাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল এত সুন্দর, কোমল, নিষ্পাপ একটি মেয়ে কেন এভাবে হারিয়ে যাবে? শেষ হয়ে যাবে? সাতকাহন লেখার সময় সেই মেয়েটিকেই আমি আমার মতো করে রূপ দিয়েছি। তাকে সমাজ, সংসারের বেড়াজালের ভেতর দিয়ে আমি পরিপূর্ণ মানুষ করে তুলতে চেয়েছি।" দীপাবলীর একা থেকে যাওয়াটা অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি, এব্যাপারেও লেখকের বক্তব্য স্পষ্ট - "বাংলাদেশের মেয়েরা যে আত্নমর্যাদাসম্পন্ন এটা আমাদের শ্রদ্ধার সঙ্গেই মনে রাখা দরকার।" একাধিকবার এই দীপাবলিকে টেলিভিশন ও সিনেমার পর্দায় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে, তবে তা উপন্যাসের দীপার মত করে আদৌ কারো মনে দাগ কাটতে পেরেছে কিনা সন্দেহ!

দীপার জীবনের সাতকাহনের মাঝে আমি শুধু আমাকে নয়, বরং চেনা-অচেনা অসংখ্য মেয়েকে দেখতে পাই, পুরো দুই খন্ডের বিশাল এই উপন্যাস জুরে কোথাও না কোথাও, বিন্দু বিন্দু হলেও অনেকেই ভেসে ওঠে আমার মানসপটে। ছোট দীপার সাথেই বা আমি নিজের এত মিল পাই কেন, কে জানে! হয়ত মফঃস্বলে বেড়ে ওঠা আমি খুব সহজে চিনে ফেলি দীপার ফুল, পাখি, জোনাকির প্রতি সেই চিরচেনা অদম্য আকুতি। তারউপর মেয়ে হয়ে জন্মে আমিও চলতে-ফিরতে-উঠতে-বসতে শুধু 'না' শুনেই অভ্যস্থ। আমার চেয়ে বছর দু'য়েক ছোট ভাইটা বাড়ির পেছনের খোলা মাঠে ইচ্ছে মতো ছুটতে পারবে, আমি 'না'... পাড়ার একই বয়সি ছেলেদের সাথে ও খেলতে পারবে, আমি 'না'... এছাড়া্‌ও, যখন খুশি বাইরে যেতে পারব না, ফুটবল/ক্রিকেট খেলতে পারব না, নিজের জমানো টাকায় ইচ্ছেমতো দোকান থেকে শখের কিছু কিনতে যেতে পারব না... জোরে কথা বলতে পারব না, আস্তেও না... হাসতে পারব না, কাঁদতেও না... আমার এ 'না'এর পালা যেন অনন্তকাল ধরে চলতেই থাকে... এত শত 'না' এর মাঝে যখন নিজেকে হারিয়ে যাওয়া কেউ লাগতে থাকে তখন দীপার কথা ভেবে আমি শক্তি পাই। কারণ দীপা আমার ভেতরে একই থাকে, সে কখনো হারায় না।

জীবন সংগ্রামে হাল ছেড়ে দেয়া, সমাজ কর্তৃক গুঁড়িয়ে দেয়া আত্নসম্মান নিয়ে দিকজ্ঞানশূন্য অসহায় কোন মেয়ের কাছে জীবনকে পুনরুজ্জীবিত করে নতুন আঙ্গিকে দেখতে, পারিপার্শ্বিকতার সাথে নিজ আদর্শের সংঘর্ষে শক্তি যোগাতে, সাধ ও স্বাধীনতা অর্জনে দীপাবলীর সংকল্প ও সংগ্রামের গল্প মূলত এক দৃষ্টান্ত।

Tuesday 12 March 2013

উপন্যাসের প্রিয় চরিত্রগুলো (দ্বিতীয় পর্ব)

 চেজিরা, টু উইমেন, আলবার্তো মোরাভিয়াঃ


'টু উইমেন' মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত দু'জন নারী চেজিরা ও তার কিশোরী মেয়ে রোসেতার গল্প। সরল ও নরম মনের, সৃষ্টিকর্তায় অগাধ বিশ্বাসী মেয়ে রোসেতার তুলনায় মা চেজিরা কিছুটা রুক্ষ, অস্পষ্ট হয়তো বা জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে কঠোর, সমাজের পুরুষ দৃষ্টির কাছে সে আবেদনময়ী এক নারী কেবল, তাও আবার একা। অথচ ভেতরের সবটা জুড়ে সে শুধুই মমতাময়ী এক মা, যুদ্ধের নির্মমতা হতে যে ঢাল হয়ে আগলিয়ে রাখতে চায় তার কোমলমনা শিশুকন্যাটিকে। তারা বাস করত রোমে, বিধবা চেজিরা সেখানে একটি দোকান চালাতো।

চেজিরা অসম্ভব শক্ত মনের এক ইতালিয়ান নারী। তার চরিত্রে বিধবার অসহায়ত্বের বদলে ছিল দাম্ভিকতা ও দৃঢ়তার স্পষ্ট ছাপ। নিজের ও মেয়ের দেখাশুনা করতো সে অসাধারণ গর্ব ও দক্ষতার সাথে। কিন্তু যুদ্ধ তার সবকিছু উল্টেপাল্টে দেয়। যুদ্ধ মানে অনিশ্চয়তা, যুদ্ধ মানে আতংক। যুদ্ধ মানুষকে দিয়ে এমন অনেক কিছু করায় যা হয়তো সে স্বাভাবিক জীবনে কখনো কল্পনাও করতে পারে না। এরকম নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে গল্পের শুরুতেই চেজিরার ভেতরের অনেক চাপা হতাশা, গ্লানি বেরিয়ে আসে।


জার্মান বাহিনীর রোম আক্রমণের শুরুতেই চেজিরা তার মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে দক্ষিণের অপেক্ষাকৃত অনুন্নত, পাহাড়ি গ্রামাঞ্চলে আশ্রয় নেয়। সাথে নেয় তার সারাজীবনের সঞ্চিত কিছু অর্থ। কিন্তু যুদ্ধের বাস্তবতায় তার সেই অর্থ দ্রুত মূল্যহীন বস্তুতে পরিণত হয়, যেখানে এক টুকরো পনীর বা এক খন্ড রুটি হয়ে ওঠে সোনার চেয়ে মূল্যবান, কারণ ক্ষুধার জ্বালা কেবল খাদ্যই দুর করতে পারে, স্বর্ণ বা অর্থ নয়। আর দশটা সহায়সম্বলহীন রিফিউজির সাথে তাদের কোন তফাৎ থাকেনা, উপরন্তু গ্রামের নীতিহীন, সুযোগসন্ধানী মানুষের আচরণে তাদের জীবন আরো দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। দীর্ঘ নয় মাস তারা ঠাণ্ডা, ক্ষুধার সাথে যুদ্ধ করে মানবেতর জীবন কাটাতে থাকে এবং অপেক্ষা করতে থাকে তাদের জন্য যারা আসলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। অপেক্ষা করতে থাকে দুর্দশা থেকে মুক্তির, অপেক্ষা করতে থাকে মিত্রবাহিনীর। একসময় চেজিরা জয়ের খবর পায়, খবর পায় মুক্তির সেই কাংখিত আশ্বাস নিয়ে মিত্রবাহিনীর মহানায়কদের আগমনের। যদিও জয়-পরাজয় নিয়ে চেজিরা ততটা উৎকণ্ঠিত ছিল না, যতটা সে অধীর ছিল ফেলে আসা শান্ত-সুন্দর-নিশ্চিত জীবনটার জন্যে। সে শুধু জানতো তাদের ফিরে যেতে হবে, আবার সবকিছু আগের মতো করে পেতে।

অথচ জয় তাদের জন্যে আনন্দের বদলে বরং আরো নির্মমতা বয়ে আনে। যখন ফেরার পথে চেজিরার বহু প্রতিক্ষিত সেই হিরোদেরই এক অংশ মরোক্কান সৈন্যরা গির্জার ভেতর মাদার মেরীর মূর্তির সামনেই কিশোরী রোসেতাকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে, চেজিরাকে মেরে অজ্ঞান করে দেয়। সেদিন চেজিরার অভিযোগ কেউ শুনেনি, তার ধর্মভীরু ছোট মেয়েটিকে না বাঁচিয়ে মাদার মেরীও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিষ্পলক চেয়ে ছিল, যেন আসলেই সে নির্জীব পাথুরে মূর্তি মাত্র। রোসেতার সরল মনে এই বর্বরতা ভয়াবহ প্রভাব ফেলে, তার শরীরের মতো মনের বিশ্বাসও দুমড়ে-মুচড়ে যায়। মায়ের সাথে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে, জীবনের ইতিবাচক মূল্যবোধগুলো বিসর্জন দিয়ে সে একটা উশৃংখল পতিতার মতো জীবন কাটাতে শুরু করে। নানা ঘটনা পরিক্রমায় অবশেষে তারা রোমে ফিরে, যুদ্ধ শেষ হয়, রেখে যায় দুটি নারীর জীবনে অমোচনীয় কিছু ক্ষত।

যুদ্ধের ধ্বংস ও যন্ত্রণার তীব্রতা যে কেবল রণক্ষেত্রের ভেতর নয়, বরং তার বাইরেও সমান ছাপ ফেলে সেই বাস্তবতাই লেখক আলবার্তো মোরাভিয়া এই দু'টি অতি সাধারণ নারী চরিত্রের ভেতর দিয়ে নিখুঁত ও যথাযথভাবে তুলে ধরেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে লেখক নিজে তার স্ত্রীসহ দীর্ঘ আট মাস পালিয়ে, লুকিয়ে বেঁচে ছিলেন। টু উইমেনে মা-মেয়ের নয় মাসের রিফিউজি জীবনের গতানুগতিক বর্ণনায় মোরাভিয়া তার নিজের সেই অনন্য মূল্যবান অভিজ্ঞতাগুলোকেই হয়তো বিস্তারিত আওড়ে গেছেন। প্রাসঙ্গিকভাবেই চেজিরাকে তিনি এঁকেছিলেন শক্তিশালী এক নারী চরিত্র হিসেবে। যে কারণে এ চরিত্রটিকে সিনেমার পর্দায় তার নিজ স্বকীয়তায় ঠিক ঠিক উপস্থাপনের ফলেই ১৯৬০ সালে একটি ইতালীয় ভাষার ছবি হয়েও অস্কারের সেরা অভিনেত্রীর পুরুস্কারটি লুফে নেন সোফিয়া লরেন।
 

আমি 'টু উইমেন' উপন্যাসটি পড়েছিলাম ২০০৭-এ। যা ছিল সেসময় আমার জীবনের অন্যতম দুঃসাহসিক কাজগুলোর একটি। এর আগে পর্যন্ত যুদ্ধ আমার কাছে ছিল দুর থেকে ভেসে আসা কান্নার করুণ সুরের মত অথবা '৭১ এর খান সেনাদের ভয়ে আমার কিশোরী মায়ের খড়ের গাদায়, চিলেকোঠায় লুকিয়ে বাঁচার দমবন্ধকর গায়ে কাঁটা দেয়া গল্প। অথচ সব যুদ্ধই যে পৃথিবীর সব নারীর কাছে একই বীভৎসতা নিয়ে হাজির হয় তা আমি জেনেছিলাম অচেনা এই নারী চেজিরা ও তার বারো বছরের মেয়ে রোসেতার কারণে। হয়তো আমার এই সামান্য বিশ্লেষণ-ধৃষ্টতায় চরিত্র হিসেবে চেজিরা এখনো পুরোটাই অভেদ্য ও অস্পষ্টই থেকে গেল। তবে এটুকু বলতে পারি সে আমার মনে সবসময় প্রবল শক্তিশালী ও আকর্ষণীয় এক চরিত্রের উদাহরণ হয়ে আছে এবং থাকবে।

Saturday 2 March 2013

উপন্যাসের প্রিয় চরিত্রগুলো (প্রথম পর্ব)

জীবনটা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়া উপন্যাসের কোনো চরিত্র না। যেখানে সুখ-দুঃখ, ভালোলাগা-মন্দলাগা, হাসি-কান্নার মত ছোটবড় প্রতিটি অনুভূতির গাঁট ধরা থাকবে অভিজ্ঞ কোন হাতের যাদুকরীতে। জীবনের প্রতিটা বাঁক বরং আরো অনেক বেশি বর্ণিল, আপেক্ষিক, অনিশ্চিত ও বৈচিত্র্যময়। কোথাও চরম আবার কোথাও নির্মল যা আগে থেকে অনুমান করা কঠিন। তারপরেও ভালো লাগা উপন্যাসের প্রিয় কোন চরিত্রের মাঝে প্রায়শই আমরা ফুটে উঠতে দেখি নিজের প্রতিচ্ছবি। অবাক হয়ে ভাবি এও কি সম্ভব! নিজের ভেতরের স্বপ্ন, ইচ্ছে, চেপে রাখা না বলা কথাগুলো নির্জীব কাগুজে ক'টা পাতায় কেমন করে এত সহজে প্রাণ পেয়ে গেল। আজ এরকমই কিছু উপন্যাস ও তার চরিত্র নিয়ে লিখতে বসলাম। যার ভেতরে অসংখ্যবার ভিন্ন সময়ে ভিন্ন আঙ্গিকে আমি আয়নার মত প্রতিবিম্বিত দেখেছি আমার চারপাশটা, প্রিয়-অপ্রিয়-চেনা-অচেনা মানুষ, কখনো নিজেকে...

 পার্ল এস. বাকের মাঃ 

মা হলো গ্রামের অতি সাধারণ পরিশ্রমী বর্গাচাষী নারীদের একজন। গ্রামীণ জীবনধারা, পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ, কঠোর পরিশ্রম এসবকিছুর সাথে একজন নারীর মনের কল্পনাবোধ, স্বপ্ন, মমতা, রাগ-ক্ষোভ-ঈর্ষা এরকম অনেক চেনা অনুভূতির অদ্ভুত সংমিশ্রণ ফুটে ওঠে এই এক চরিত্রের মধ্যে দিয়ে। পুরো উপন্যাস জুড়ে যে চরিত্রটিকে লেখিকা সম্বোধন করে যান কেবল 'মা' নামেই। মা ছাড়া অন্য নাম চরিত্রটির সাথে যায় না। 

এই সাধারণ গ্রামীন কৃষক রমণীর ভেতরের স্বপ্ন, সাধ, আকাংখাগুলোও আর দশটা মেয়ের মতই অতি সাধারণ। বর্গা নেয়া জমিটুকুতে সকাল-সন্ধা ঘাম ঝরিয়ে শস্য ফলানো, পুরো দিনমান বীজ বুনে সন্ধায় ঘরে ফেরার পথে কল্পনায় সে বীজ শীঘ্রই অঙ্কুর হয়ে চারা বের হবে এই ভাবনা তার মনকে অদ্ভুত সুখানুভূতিতে আচ্ছন্ন করে রাখে। ঘরে ফিরে সন্তানদের মুখে তৃপ্তির অন্ন তুলে দিয়ে তার সমস্ত ক্লান্তি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। মায়ের কোমলমতি মনের ভাগ থেকে বাদ যায় না বাড়ির কুকুর বা অন্য পোষা প্রাণীগুলোও, যাদের খাইয়েও মা সমান তৃপ্তি পায়। তারাও সন্তানের মতই দিনভর মায়ের ফেরার পথ চেয়ে থাকে। মায়ের অকৃত্রিম ভালবাসা ভরা মনটার প্রকাশ পায় এভাবেই নিজের সন্তান, শাশুড়ি ও বাড়ির প্রতিটি জীব যারা মাকে নির্ভর করেই বেঁচে থাকে তাদের প্রতি তার নিরলস দায়িত্ববোধ ও মমতা থেকে। সাথে নানা কাজের মাঝেও অন্ধ হয়ে আসা মেয়েটার ভাবনা মাকে অস্থির করে তুলে।

মা তার স্বামীকে ভালবাসতো। কারণ স্বামীর কারণে সে পেয়েছে সন্তানধারণের মত গর্ব। নিজের মাতৃত্বের ক্ষমতায় মা একজন গর্বিত নারী। স্বামীর আত্নকেন্দ্রিক সভাব, আড্ডা-জুয়া-বিলাসীতা, সংসার ও কাজের প্রতি অনীহা কারণে কখনো ভেতরের ক্ষোভ চেপে রাখতে না পেরে মা ফেটে পড়তো, এরকম সামান্য এক ঘটনার পর স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়, আর ফিরে না। দিনের পর দিন মা অপেক্ষা করে থাকে স্বামীর জন্যে, ভালো রেঁধে তুলে রাখে। সংসারের এতগুলো মানুষের দায়িত্ব এসে পড়ে মায়ের কাঁধে, যা সে একাই পরিশ্রম ও দক্ষতার সাথে পালন করতে থাকে। কিন্তু পৃথিবীর সবখানেই বুঝি কোন মেয়েকে তার স্বামী ছেড়ে যাওয়াটা সমাজের চোখে স্বামীর বা পুরুষের দ্বায়িত্বজ্ঞানহীনতার চেয়ে সেই মেয়েরই দোষ বুঝায়। আর অন্যেরাও তখন নিজের কাজ ফেলে সেই মেয়ের দোষ ঘাটতে অতিউৎসাহী হয়ে পড়ে। নিশ্চয়ই তার কোন দোষ আছে নাহলে স্বামী তাকে ছেড়ে যাবেই বা কেন, এরকম প্রশ্নে মায়ের নারীসত্ত্বা, অহমকে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে। যেকারণে মানুষের নানা প্রশ্নের নানা কটূক্তির জবাবে সে মিথ্যে বলা শুরু করে। গ্রামের মানুষের মুখ বন্ধ করতে শহরে গিয়ে স্বামীর নাম করে নিজের ঠিকানায় চিঠি লিখিয়ে নেয়া শুরু করে যে, স্বামী তার শহরে ভালো চাকুরী করছে। সবার মুখ বন্ধ হয়, মায়ের ভেতরের হাহাকার রয়েই যায়।

দ্বিগুণ পরিশ্রমে মাঠের কাজ, সংসারের ভরণপোষণে লেগে যায় মা। শরীর ও মনের জোরে হয়তো সে একজন পুরুষের চেয়েও বেশি ফসল ফলায়, সন্তানের মুখে ভালো খাবার তুলে দেয়, কিন্তু তারপরেও সে অন্যের চোখে রয়ে যায় একজন নারী হয়েই। যে কারণে খুব সহজে জমিদারের নায়েবের কুনজরে পড়ে এই স্বামী পরিত্যক্তা নারীটি। এখানে বলে রাখা ভালো যে, লেখক মা-কে ধরাছোঁয়ার বাইরে দোষগুণের উর্দ্ধে কোন দেবীর আসনে নেননি। মা-কে তিনি এঁকেছেন সাধারণ একজন নারী অথবা মানুষ হিসেবে। আর মানুষের আচরণে নিশ্চিত করে কিছু বলা মানে তার উপর জোড় করে কিছু চাপিয়ে দেয়া। যেখানে মানুষের আচরেন নিশ্চিত বলে কিছু নেই। ততদিনে স্বামী ফিরার আশাও মা বাদ দিয়েছে। উপরুন্ত স্বামীর ছেড়ে যাওয়ায় তার ভেতরে যে অপমানবোধ, যে ক্ষোভ জমেছিলো, তার শোধ নিতে চেয়েছে নায়েবের সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে। কিন্তু এখানেও মা প্রতারিত, লোভী নায়েবের পুরুষ দৃষ্টি যে শুধু মায়ের নারী শরীরটাকে চেয়েছিলো, তা বুঝে প্রথমবারের মতো সন্তান ধারণ তার কাছে গর্বের চেয়ে পাপবোধ ও আত্নানুশোচনার জন্ম দেয়। এ পাপ থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে সে শরীরের উপর চিরস্থায়ী যন্ত্রনার ছাপ নিয়ে।

মা একসময় বুড়িয়ে যায়, তার ছেলে সমর্থ হয়। ঘড়ে বউ এসে মায়ের স্থান নিতে থাকে, সেখানে চলতে থাকে ছেলের বৌয়ের সাথে চলে মায়ের কর্তৃত্বের সংঘাত। সংসারে তার স্থান অন্য কেউ নিয়ে নিচ্ছে তা মেনে নেয়া মায়ের কাছে কষ্টকর হয়ে পড়ে। উপন্যাসের শেষে মায়ের সবচেয়ে ছোট ছেলের জমিদারের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার মধ্যে দিয়ে চীনের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটে। জনসম্মুখে মায়ের চোখের সামনে নিজের প্রিয় সন্তানের মৃত্যদন্ড, চরম মানসিক বিপযস্থ অবস্থায়ও এক নব জাতকের কান্নার আওয়াজ মায়ের ভেতরে সব হারানোর মাঝেও কিছু পাওয়ার অনুভূতি জাগায়।

  
'মা' চরিত্রটিকে লেখিকার নিজের মূল্যায়নঃ পার্ল এস. বাক তার বিশাল উপন্যাস 'দা গুড আর্থ' এর পরপরই 'দা মাদার' লিখেন, যা লিখে তিনি নিজে খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। বিষয়টা আমার কাছে 'চোখের বালি' উপন্যাসে বিনোদিনী চরিত্রটির সাথে ন্যায় করতে না পারায় রবীন্দ্রনাথের ভেতরে যে আত্ননুশোচনা রয়ে গিয়েছিলো খানিকটা সেরকম লেগেছে। রবীন্দ্রনাথ যেমন সেকালের সমাজের বেড়াজাল থেকে হিন্দু বিধবা স্ত্রী বিনোদিনী-কে বের করতে পারেন নি, বাকও তেমন চীনের সে সময়ের সমাজ ব্যবস্থায় একটি নারীর একা থাকার যে যন্ত্রণা, সমাজের নিয়মকানুন পারিপার্শ্বিকতায় সে যন্ত্রণা আরো আরো তীব্র হয়ে ওঠা থেকে এই চরিত্রটিকে বের করতে পারেননি।

পুরো চরিত্রটির ভেতর লেখিকা নিজে নারী হিসেবে তার অনেক অনুভূতি, উপলদ্ধি ও চিন্তাভাবনা অকপটে লিখে গিয়েছেন যা একটু খেয়াল করলেই আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়, যেমন - মাতৃত্ব নিয়ে বাকের নিজের যে ভাবনা ও অব্যক্ত হতাশা তাও এই 'মা' চরিত্রটির মধ্যে স্পষ্ট ফুটে ওঠে।

মায়ের প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়নঃ প্রকাশক Peter Conn যিনি পরবর্তীতে বাকের দ্বিতীয় স্বামী ছিলেন, তিনি এই উপন্যাসটিকে “Pearl S. Buck: A Cultural Biography” বলে উল্লেখ করেন। 'মা' সম্পর্কে Peter Conn লিখেন - “veered perilously close to a personal confession, an unguarded glimpse into the secrets of her sexual and maternal frustration”। পার্ল এস. বাকের 'দা মাদার' উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৪ সালে। বলা হয়ে থাকে এই উপন্যাসটির মাধ্যমে বিশ্ব-সাহিত্যের পটে চীনের গ্রামীণ সমাজে নারীর অবস্থানের যথাযথ নিখুঁত চিত্রায়ণই তাকে এনে দিয়েছিলো ১৯৩৮ সালে নোবেল অর্জনের মত দুর্লভ খ্যাতি।

মা চরিত্র ও উপন্যাসটি আমার মূল্যায়নের দুঃসাহসঃ যদিও মায়ের স্বামীর তুচ্ছ ঝগড়ার জের ধরে রাগের বশে চলে যাওয়াটা বুঝা গেলেও, একবারে ফিরে না আসাটা আমার কাছে রহস্যই থেকে গেছে। তারপরেও এটা অস্বীকার করার উপায় নাই 'দা মাদার' উপন্যাসটি পড়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত এর কেন্দ্রীয় চরিত্র মা আমার ভেতরে আসে ঘুরেফিরে, বার বার। একজন স্ত্রী বা জননী হিসেবে নয় বরং একজন নারী হিসেবে এ চরিত্রটি আমাকে ভাবিয়েছে অনেক বেশি। বলতে গেলে আমার আশেপাশের অনেক জটিলতা, সমাজে নানা অবস্থানের নারীদের সীমাবদ্ধতা, প্রাপ্তি ও হতাশাগুলো চিনতে শিখিয়েছে নতুন করে, সম্মান করতে শিখিয়েছে নিজ নিজ অবস্থানে নিত্য টিকে থাকার চেষ্টারত প্রতিটি নারীকে। সাথে অবাক হয়েছি লেখিকার চরিত্রটির ভেতরে ঢুকে তা বিশ্লেষণের ক্ষমতা দেখে, তাই ভেবেছি হয়ত তিনি নিজেও একজন নারী ছিলেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। চীনের সেকালীন গ্রাম্য সমাজের রীতিনীতি ও কাঠামো পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণও লেখিকার নিখুঁত দৃষ্টি ও একটি প্রান্তিক সমাজের সাথে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা আমাকে মুগ্ধ করেছে।