Wednesday 5 December 2012

তুলতুলে গা হাতির ছানা!


EVERY PERSON THAT BUYS IVORY HAS BLOOD ON THEIR HANDS AND IS AN ACCOMPLICE IN KILLING AN ELEPHANT, CAUSING IMMEASURABLE SORROW AND SUFFERING TO MANY OTHERS. SAY NO TO IVOY!
কেনিয়ার বন্যজীবন সংরক্ষণে কিংবদন্তি হিসেবে যে মানুষটির নাম সবার আগে আসে তিনি হলেন ডেভিড শেলড্রিকমাত্র একটি লরি ও অল্প কিছু শ্রমিক নিয়ে যিনি দুর্গম, খরাপূর্ন, ভয়ংকর হিংস্র পশু (প্রধানত সিংহ) ভরা, অজানা-অদেখা কেনিয়ার পূর্বাঞ্চলে প্রথম বনরক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৪৮ সাল থেকে। যা বর্তমানে কেনিয়ার সবচেয়ে বড় ও বিখ্যাত – Tsavo National Park (‘দ্যা ঘোস্ট’ এবং ‘দ্যা ডার্কনেস’ সিংহদু’টির আবাসভূমি) নামে পরিচিত।



তিনি যখন প্রথম এ অঞ্চলটিতে আসেন তখন না ছিলো এখানে যোগাযোগের জন্য কোনো রাস্তা, না ছিলো বসবাসের জন্য উপযুক্ত কোনো পরিবেশ। হিংস্র পশু ও খরায় কবলিত অঞ্চলটি ছিলো সবদিক থেকে ঝুঁকিপূর্ন। কিন্তু তারপরেও শেলড্রিকের মত মানুষের প্রকৃতির প্রতি দুর্বার আকর্ষনই তাকে এখানে টিকে যেতে সাহায্য করেছিলো। সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করেছিলো প্রায় ৫,০০০ বর্গমাইল বিশাল এই অঞ্চলটিকে শুধুমাত্র বন্যজীবনের অভয়ারণ্যের পরিণত করতে। পাহাড় সমান অসাধ্য সাধন করে তিনি এ অঞ্চলটিতে যাতায়াতের উপযোগী রাস্তা, বন্যপ্রাণীদের খরার হাত থেকে রক্ষা করতে বর্ষাকালীন নদীতে বাঁধ ও পানি ধরে রাখতে মনুষ্যসৃষ্টি লেক ‘অরুবা’ নির্মাণ করেন, যার ফলে অসংখ্য হাতি, গণ্ডার ও অন্যান্য প্রানী এই জীবনের উৎস পানিটুকুর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ভালোবেসে ফেলেছিলো সে এই প্রাণীগুলোকে, তাদের কষ্ট-দুর্দশার সাথে জড়িয়ে পড়েছিলো খুব সহজেই। যে কারণে চরম খরার কবলে পরে অথবা মানুষ ও হিংস্র প্রাণীর আক্রমনের শিকার হয়ে মুমূর্ষু অবস্থার প্রানীকে এবং মা-হারা এতিম ছানাগুলোকে খাদ্য-পানি-আশ্রয় দিয়ে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যেত, আর এ সব কিছুতেই পাশে থেকে তাকে শক্তি ও সাহস যুগিয়েছিলো স্ত্রী ড্যাফন । একটানা ২৪ বছর এখানে ক্লান্তিহীন দায়িত্ব পালনের পর শেলড্রিকের বদলি হয় এবং তার ঠিক ছয় মাস পর ১৯৭৭ সালে হঠাৎ মানুষটির জীবনও যেন সব গতি হারিয়ে ফেলে!

শেলড্রিকের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ড্যাফন স্বামীর সেই মহৎ উদ্যোগকে প্রাতিষ্ঠানিকতায় রূপ দেয় The Devid Scheldrik’s Wildlife Trust এর মাধ্যমে। শেলড্রিকের স্বপ্নকে জিইয়ে রাখতে প্রায় দুই দশকেরও বেশী সময় ধরে প্রতিষ্ঠানটি নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে ব্যাপক পোচারিং এর কারণে আফ্রিকার সবচেয়ে বেশী হুমকির সম্মুখীন হাতি, কালো গণ্ডার সংরক্ষণের। আওতায় আছে অন্য বন্যপ্রাণীও। এতিম, বিছিন্ন ছানাগুলোর একটি নিরাপদ আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে চালু করাহয় এই নার্সারিগুলোর। যেখানে মুক্ত পরিবেশে এতিম শাবকগুলোর লালন-পালন করা হয়। নির্দিষ্ট বয়সের পর তাদের ছেড়ে দেয়া হয় সাভোর মতো বড় ন্যাশনাল পার্কগুলোতে।



আমার ছেলের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর, আদুরে, পুতুপুতু প্রানী হলো হাতি। তার নিজের একটা পোষা হাতির শখ অনেক দিনের। তার মতে হাতির সাথে বন্ধুত্ব করাও নাকি খুব সোজা বিষয়, শুধু দু-একটা চিনে বাদাম ওটার সামনে ধরলেই, সে শুঁড় দিয়ে সুরুত করে তা টেনে নিয়ে, আনন্দে লাফাতে লাফাতে বন্ধু হয়ে যাবে (আইডিয়া টা যে ‘টম অ্যান্ড জেরী’ থেকে নেয়া এটা বুঝতে আমার বাকি থাকেনা)। এরপরের প্ল্যানিং অবশ্য দীর্ঘ - টারজানের মত যত খুশি হাতির পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়ানো, শুঁড়টাকে হোস পাইপ বানিয়ে গাছে পানি দেয়া, ট্রাম্পেটের আওয়াজ দিয়ে দুষ্টুদের ভয় দেয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। তার ধারণা অন্যসব পশু-পাখি যেমন- কুকুর, বেড়াল ইত্যাদির মত হাতিও চাইলেই জোগাড় করা যায়। এটা আর এমন কি, কেনিয়ার এলিফ্যান্ট অরফানেজে এতগুলো বেবি এলিফ্যান্ট আছে সেখান থেকে একটা নিয়ে আসলেই তো হয়।



শুধু ছেলের দোষ দেই কেন, আমার নিজেরও প্রাণীকূলের মধ্যে হাতির প্রতি দুর্বলতা বরাবরই একটু বেশী। আর তা যদি হয় বাবু হাতি, তাহলে তো কথাই নাই! আমার তো মনে হয় এই বিশাল অদ্ভুত সুন্দর প্রাণীটির ভেতরে শিশুর মতো যে সরলতা আছে তা দেখে একে ভালো না বেসে থাকতে পারাটাই হবে এক আশ্চর্য।



শিশু হাতিগুলোর প্রাণোচ্ছল ছেলেমানুষি দেখে ওদের সাথে মানবশিশুর পার্থক্য করা রীতিমত কষ্টকর হয়ে পড়ে। তাদের দুরন্তপনা, খুনসুটি, মান-অভিমান, আনন্দে আত্নহারা হয়ে খেলায় মেতে যাওয়া এ সবের সাথে আমার নিজের কোলের শিশুটির আচরণের আমি আসলেই কোনো তফাৎ করতে পারি নাই। তাই ওদেরও দেখেছি একই মুগ্ধতা নিয়ে, মন ভরে উঠেছে গভীর অথচ খুব চেনা এক মমতায়, যা আমি অনুভব করি আমার নিজের সন্তানের প্রতি।



শিশুদের খাওয়ার দৃশ্য নিঃসন্দেহে পৃথিবীর স্বর্গীয় মুহুর্তগুলোর একটি!



 আর স্বর্গীয় এ মুহূর্তটি দেখতে হলে নাইরোবির ডেভিড শেলড্রিক’স এলিফান্ট অরফানেজ এ অবশ্যই সকাল ১১টার মধ্যে যেতে হবে। সেসময়টি এই দেবশিশুগুলোর খাওয়ার সময়। অরফনেজটির মুক্ত পরিবেশে তারা বয়েস ভেদে কয়েক গ্রুপে ভাগ হয়ে একটি নিরাপদ আশ্রয়ে সাচ্ছন্দে বেড়ে উঠে। খাওয়ার জন্য একেক বার একেক দলকে ডেকে আনা হয় জঙ্গল থেকে। অদ্ভুত সুশৃঙ্খল নিয়মে শিশু হাতিগুলোর একেকটি দল একদিক থেকে এসে খেয়ে খানিকক্ষণ হুটোপুটি করে খেলে অন্যদিক দিয়ে আবার জঙ্গলে চলে যায়। এরপর ডাকা হয় আরেক দলকে।



সকাল ১১ টায় প্রথম গ্রুপের বাচ্চা হাতিগুলোকে আনা হচ্ছে খাওয়ানোর জন্য।



দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় দেখে সহজে অনুমান করা যায়, এই মুহূর্তগুলো কতটা অপার্থিব তৃপ্তিদায়ক, কতটা দুর্লভ! 

আমি বাজি রেখে বলতে পারি, কেউ যত পাষাণ হৃদয়ের হোক না কেন কেবল ছবিগুলো দেখেই ওদের ভালোবেসে ফেলবে। এই অকৃত্রিম নির্মল আকুতিই যথেষ্ট কেউ না চাইলেও তার মনকে ঠিকই টেনেহিঁচড়ে নিয়ে ওদের সাথে কোথাও এক অদৃশ্য বাঁধনে জড়াতে! আমরা বাধ্য ওদের ভালবাসতে! তারপরেও কেউ যদি অস্বীকার করে তাহলে বলব, আপনি নির্ঘাত হৃদয়ের সব অনুভূতিসমেত আস্ত হৃদয়টাকেই লকারে পুরে তালা মেরে রেখেছেন!



অনুভূতির দিক থেকে হাতি মানুষের সমমানের এক প্রাণী


হাতির অনুভূতি ব্যাপারে কিছু তথ্য জেনে ভীষণ অবাক হয়েছি। মানুষের সাথে এই প্রাণীটির অনুভূতির কতখানি মিল, তা আসলেই ভাবা যায় না। মানুষের মতই তার হৃদয়ও কোনো অজানা রহস্যময় অথচ গাঢ় জ্যোতিতে ভরা। যেখানে সুখ-দুঃখ, অস্থিরতা-প্রশান্তি, রাগ-ঈর্ষা-ক্রোধ-হিংস্রতার অদ্ভুত সংমিশ্রণ, তারা চাইলে আমাদের মতই তাদের এই অনুভূতিগুলো বিকশিত অথবা সীমাবদ্ধ রাখতে পারে। তাদের মধ্যে রয়েছে দৃঢ় পারিবারিক বন্ধন, প্রিয়জনের প্রতি ভালোবাসা, শুধু তাই নয় ভালোলাগার স্মৃতি বা বিষয়গুলো তারা হৃদয়ে ধরে রাখে আজীবন। প্রিয়জনের মৃত্যু বা বিচ্ছেদে তারা কষ্ট পায়, কাঁদে, উন্মাদ হয়ে যায়। আবার কখনো অবসরে সেই স্মৃতি হাতড়ে অতি আপনজনটির অনুপস্থিতি অনুভব করে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে, ঠিক যেন মানুষেরই মত!

-একটি হাতি’র মস্তিষ্কে জমানো স্মৃতি (হতে পারে তা সঙ্গী অথবা প্রিয়মানুষ, বিষয় বা ঘটনা) তার জীবনকাল থেকে যায়।

-হাতির শ্রবণশক্তি মানুষের চেয়ে ঢের গুণ বেশি তীক্ষ্ণ! তারা নিজেদের মধ্যে দীর্ঘ পরিসরে অদৃশ্য কিছু শব্দে যোগাযোগ করে, যা মানুষের পক্ষে কখনই শোনা বা জানা সম্ভব নয়। অর্থাৎ হাতি তার চারপাশের যেকোন ছোট থেকে ছোট শব্দ অনেক দুর থেকে শুনতে পায়।


অতএব কেবল আকারেই নয়, বরং প্রচণ্ড ভালোবাসার ক্ষমতাসম্পন্ন এবং তীক্ষ্ণ অনুভূতিপ্রবণ এই প্রাণীটি প্রকৃতির শর্তাবলি অনুযায়ী বাস্তবেই পৃথিবী নামক এই গ্রহটার সবচেয়ে বড় স্তন্যপায়ী জীব।

অথচ নগ্ন সত্য হলো, শুধুমাত্র এর মূল্যবান দাঁতের কারণে হাতি মানুষের বর্বতার শিকার হয়ে আসছে বহু আগে থেকেই। ধারণা করা হয় বর্তমানে আফ্রিকায় মাত্র ৫ লাখের মত হাতি অবশিষ্ট আছে। যারমধ্যে কমপক্ষে দশ হাজার হাতি প্রতি বছর বলি হচ্ছে চোরাকারবারি, শিকারি অথবা আইভরি ব্যবসায়ীদের নৃশংসতার। ব্যাপক হারে পোচিং-এর শিকার আফ্রিকান হাতির উপর চালানো ভয়ঙ্কর সব গণহত্যা বর্তমানে প্রাণীটির অস্তিত্বই হুমকির মুখে এনে ঠেকিয়েছে। এই প্রক্রিয়া এতটা নৃসংশ যে তা বীভৎসতার সংজ্ঞাকেও হার মানায়, যখন একটি পালের (ছোট-বড়) সব ক’টা হাতিকে একসাথে হেলিকাপ্টার থেকে ব্রাশ ফায়ারিঙে গণহারে হত্যা করা হয়। অথবা স্থানীয় আদিবাসীদের দ্বারা বিষাক্ত তীর ছুড়ে মারা হয়। উদ্দেশ্য মূলত একটাই নিরীহ এই প্রানীটি থেকে খুবলে নেয়া দাঁতের রমরমা বানিজ্য। যত বেশি মরা হাতি, তত বেশি দাঁত, তত বেশি টাকা! জয় মানবপ্রজাতি! জয় তোমার বীরত্ব! প্রকৃতিকে বোধ করি এই এক মানব প্রজাতির হিংস্রতা ও বর্বরতার মূল্য দিতে দিতেই ক্রমে কঙ্কালসার হতে হবে, যথারীতি যার খেসারৎ দিচ্ছে এরকম মহান সব সৃষ্টি!

উল্লেখ্য, অসহায় প্রানীগুলোর উপর চালানো পাশবিক বর্বরতায় ব্যবহৃত হেলিকাপ্টার থেকে শুরু করে আধুনিক মিলিটারি অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য ইন্ধনগুলো আঞ্চলিক ক্লায়েন্টদের হাতে ট্রাষ্টের নামে মূলত পৌঁছে দিয়ে আসছে ইউনাইটেড স্টেটেস মত ক্ষমতাধর দেশগুলো! কিন্তু কেন এই ট্রাস্ট? কি উদ্দেশ্যে এগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে? সে ব্যাপারে তারা বরাবরই “comfortably numb” ! অতএব আফ্রিকার বন ঐতিহ্য উজাড়ে একটি বড় দায়ভার আমেরিকার মত পশ্চিমা সুবিধাবাদী রাষ্ট্রগুলোর উপরও বর্তায়।

যদিও হাতির দাঁতের এই বানিজ্য দুই দশক যাবত আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ। তারপরেও ধর্মীয় কারণে আইভরি বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় বাজার চায়নাসহ থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামের বাজার রয়েছে এখনো উন্মুক্ত এবং আমেরিকার মত শক্তিধর দেশেগুলোর দুর্বৃত্তদের মদতে এই নৃশংস পোচিংও চলছে যথারীতি সক্রিয়ভাবে। এ প্রক্রিয়া যদি এভাবেই চলতে থাকে তাহলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই প্রকৃতির সবচেয়ে বৃহৎ ও অসাধারণ এই সৃষ্টিটি পুরোপুরি বিলুপ্তির কাতারে পৌছে যাবে এব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। খোলা অরণ্যে হাতির বিচরণ রূপকথার গল্প হয়ে থাকবে, হয়ত দেখা মিলবে চিড়িয়াখানা অথবা ডেভিড শেলড্রিকদের মতো মানুষদের মনুষ্যত্বের উদাহরণস্বরূপ রেখে যাওয়া কনজারভেশন সেন্টার, অরফানেজগুলোতে। যেগুলোতে গেলে প্রকৃতির সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রাণী হিসেবে মানুষ হওয়ার লজ্জাটা কিছুটা হলেও ঘুচে।

............................................................................................................

 অফ টপিকঃ ফেসবুকে The Devid Scheldrik’s Wildlife Trust পেজটি এড করে এই ছানাপোনাদের নিয়মিত খোঁজখবর পেতে পারেন। আবার চাইলে এখানে ডোনেট করে এই মহৎ প্রক্রিয়ার অংশীদার হতে পারেন।

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------

No comments:

Post a Comment