Wednesday 5 December 2012

সাফারি সাফারি...





প্রথম আফ্রিকায় এসে এখানকার বন্য জীবন ঘুরে দেখার বহুদিনের লোভ সামলাতে না পেরে সে বছর ডিসেম্বরেই সোজা রওনা হলাম পাশের দেশ সেনেগালে। নভেম্বর থেকে মার্চ এই সময়টাকে এখানে বলা হয় টুরিস্ট সিজন। সেসময় প্লেন বোঝাই হয়ে দলে দলে ভ্রমণ পিপাসুরা আসে এখানকার বনজঙ্গল চড়ে বেড়াতে, তাদের মধ্যে পশ্চিমা সাদা চামড়া বা লোকালদের ভাষায় 'টুবাব' এর সংখ্যাই বেশি। আফ্রিকার বন্যজীবন ছাড়াও, এ অঞ্চলের দাসত্বের ইতিহাস ও আটলান্টিকের আকুল আবেদন তো আছেই বাড়তি পাওনা হিসেবে। অন্যদিকে লোকালদের কাছে টুরিস্ট সিজন মানেই টু-পাইস কামাইয়ের মোক্ষম সুযোগ। পথে ঘাটে সব খানেই দেখা যায় লোকে আফ্রিকান স্যুভেনিরের পশরা সাজিয়ে বসে। এসব অঞ্চলের বিড'স শিল্প, উডেন শিল্প, রঙ্গিন বাটিকের কাপড়, ক্যাশুনাট ইত্যাদি বিখ্যাত জগৎ জুড়ে। তা নিয়ে সময় করে আলাদা আলোচনা হতে পারে।



সেনেগাল, 'দা ফ্রেঞ্চ কোস্ট অফ আফ্রিকা'-য় আমাদের নির্ধারিত চার দিনের মধ্যে তিন দিনই পার হয়ে গেলো - গোরে আইল্যান্ড, মেইজন দি এসক্লাভস, রাজধানী ডাকার এ। চতুর্থদিন সকাল সকাল ভাড়া করা ল্যান্ড রোভার নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম, উদ্দেশ্য অবশেষে সাফারি। ল্যান্ড রোভার কেন - আফ্রিকার দুর্গম গিরি কান্তার মরু টাইপ পথ পাড়ি দেয়ার জন্য বিশেষভাবে বানানো অত্যন্ত রোবাস্ট ফোর হুইলার হলো এই গাড়িগুলো। যে কারণে এ অঞ্চলে ছোট মারুতির চেয়ে তুলনামূলক এইসব উঁচু ফোর-হুইলারগুলো বেশী জনপ্রিয়। বনে বাদাড়ে বিশাল বিশাল দৈত্যাকৃতির গাড়ির আধিক্য দেখে মনে হবে, এখানকার মানুষেরা সবাই বুঝি খুব ধনী, বাংলাদেশের মন্ত্রী মিনিস্টারদের মত। আসলে বিষয়টা মোটেও সেরকম না, দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এখানকার অধিকাংশ মানুষের গাড়ি ব্যবহারের সামর্থ্য নেই বললেই চলে। তারপরেও জীপ, চেরোকি, ডিফেন্ডার, হামার, লান্ড রোভার, ল্যান্ড ক্রুজারের মত গাড়িগুলো মূলত আসে এখানে ঘুরতে আসা সৌখিন টুরিস্টদের বা বিভিন্ন গবেষণায় আসা দাতা সংস্থাগুলোর বদৌলতে। যেহেতু এখানে গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে ট্যাক্স নেই বললেই চলে, তাই অনেকে আফ্রিকা ভ্রমণে শিপিং এ নিজের গাড়ি নিয়ে আসে, সেই গাড়ি করে আফ্রিকার কয়েক হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে, যাবার সময় নিলামে প্রায় পানির দরে তা বিক্রি করে দিয়ে যায়। কারণ উন্নত দেশগুলোতে তেলখাদক বড় গাড়িগুলো পোষায় অনেক হ্যাপা।



আমাদের ল্যান্ডরোভার ছুটে চলেছে, খানা-খন্দ পেরিয়ে, পথের লাল ধুলো উড়িয়ে। দুপাশে পানির অভাবে শুকিয়ে খর হয়ে আসা বিবর্ণ মরা ঘাসের মাঠ। কোথাও কোথাও তা লম্বায় বুক ছাড়িয়ে গিয়েছে, থেকে থেকে বাতাসে দুলে উঠছে যেন পৌষে নবান্নের আগে ছড়িয়ে থাকা আদিগন্ত সোনালি ধানক্ষেত, তার মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে প্রকান্ড বিচিত্র আকৃতির ভুতুড়ে বাওবাবগুলো। যেগুলোকে 'শয়তান খেয়ালবশতঃ মাটি থেকে তুলে উল্টো করে পুঁতে রেখেছে, আর তাদের শেকড়গুলো ছড়িয়ে আছে আকাশে।' ঝোপ-ঝাড় বন-জঙ্গল যাই পেরিয়ে যাচ্ছি সবখানেই একই বৈচিত্র্যহীন ধুসর বাদামী, কোথাও বা ধুলো জমা লালচে প্রাণহীন সবুজ। মনের ভেতরে থাকা 'ঘোস্ট এ্যন্ড দা ডার্কনেস' অথবা 'গড মাস্ট বি ক্রেজি'-র আফ্রিকার সেই চেনা পটভূমির সাথে হুবহু মিলে যায় সবকিছু। পরে জেনেছি এখানে পুরো বছর ধরে খেলে যায় শুধুমাত্র দুটি ঋতু - 'রেনি সিজন' ও 'ড্রাই সিজন'। এবং এই প্রানহীন ধুসর প্রান্তর বর্ষার এক পরশেই কেমন আশ্চর্য রকমের সবুজ ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে তা নিজ চোখে না দেখলে ঠিক বিশ্বাস করা কঠিন!







বলা বাহুল্য আমাদের ল্যান্ডরোভারখানা সাইজ ও স্বভাবে পদে পদে এখানকার পরিবেশ অ্নুকূলতার প্রমাণ দিচ্ছে, অথচ এটার ভেতরে আমাদের অবস্থান মোটেও সেই তুলনায় অনুকূল হয়ে উঠছিলো না, তার উপর মাঝের কিছু রাস্তা ছিলো যাকে বলে এক্কেবারে 'রিয়েল ওয়াইল্ড'! আহা! সেই কথা মনে পড়লে এখনো কোমরের পেশীতে টান অনুভব করি! গাইডের নির্দেশে কাঁটাবনের ভেতর দিয়ে যাওয়ার পথে, বেখেয়ালে জানালা খুলে রাখায় বিষাক্ত কাঁটাওয়ালা ডালের অবাঞ্ছিত প্রবেশে মুখের মানচিত্র হেরফেরের হাত থেকে একটুর জন্যে বেঁচে যাই, পরম করুণাময়ের কৃপায়! এটা ভেবে এখনো শান্তি পাই যে সেযাত্রা অক্ষত ফিরতে পেরেছিলাম! এভাবে এক থেকে দেড়ঘন্টার যত্রতত্র ঘুরার পর, মনে হচ্ছিলো আশপাশের প্রাণীরা বোধহয় আমাদের আসার খবর পেয়ে, আগেভাগেই সব লুকিয়ে বসে আছে, আদৌ কিছু দেখা পাব কিনা সন্দেহ। ঠিক এমন সময় গাইড হাত দিয়ে ড্রাইভারকে গাড়ি থামানোর ইশারা করলো, আমাদের এক লম্বা কাঁটাঝাড়ের আড়ালে কিছু দেখালো। দেখলাম লম্বায় প্রায় গাছের সমান এক জিরাফ। আমরা ধীর পায়ে গাড়ি থেকে নেমে এলাম, আমাদের দেখে তাকে খুব একটা ভীত বা অস্থির মনে হলোনা, খুব স্বাভাবিকভাবেই সে গাছের পাতা খেয়ে যাচ্ছে। আমরা মুগ্ধ জীবনে প্রথম এই বিশাল, অদ্ভুত সুন্দর ও মায়াভরা চোখের প্রাণীটিকে বাস্তবে এত কাছ থেকে দেখতে পেয়ে! যেখানে কোনো লোহার শিক দিয়ে সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি তার বিচরণক্ষেত্র, আমার মত সেও সমান স্বাধীন। যেন ডিসকভারি বা অ্যানিম্যাল প্ল্যানেটের কোনো ওয়াইল্ড লাইফ নিয়ে ডকুমেন্টারি-তে দুম করে নিজেই ঢুকে পড়েছি!



প্রাণীটি শুধু দেখতেই নিরীহ নয় স্বভাবেও মিশুক প্রকৃতির। ছবি নেয়ার সময় ঘাড় ঘুড়িয়ে আমাদের অবাক করে কেমন পোজ দিলো! জিরাফের লম্বা গ্রীবা ও বড় বড় চোখ দিয়ে সে চারপাশ বেশ ভালোই দেখে। শিকারির আক্রমন থেকে রক্ষার জন্যে সে ঘণ্টায় ৬০ কিমি পর্যন্ত দৌড়াতে পারে। তার পেছনের পায়ের জোর এতোই প্রবল যে শুধু মাত্র এক কিকই যথেষ্ট সিংহ মামাকে কুপোকাত করতে, যদি তা ঠিক মত বসাতে পারে। জিরাফ এমন একটা প্রাণী যে কিনা দাঁড়িয়ে চোখ খোলা রেখেই ঘুমায়! আবার জিরাফের সবচেয়ে প্যাথেটিক বিষয়টিও কিন্তু পা, এই ৬/৭ ফুট উঁচু পায়ের কারণেই এদের অধিকাংশ বাচ্চা জন্মাবার পর মাটিতে আছাড় খেয়ে ঘাড় ভেঙ্গে মারা যায়!





জেব্রাগুলোকে দেখতে সব একই রকম মনে হলেও, পৃথিবীর সব প্রাণীর ডি এন এর গঠন যেমন আলাদা, আমাদের আঙ্গুলের ছাপ, সিগনেচার এমনকি মায়েদের হাতের রান্নাও যেমন একটার থেকে আরেকটা মিলানো যায় না, তেমনি প্রতিটি জেব্রার গায়ের সাদা কালো ছাপগুলোও একটির থেকে আরেকটি আলাদা। জিরাফ বা অন্য যেকোনো প্রাণীর ক্ষেত্রও এটা প্রযোজ্য।



গণ্ডারের চামড়া ওয়ালা রিয়েল গণ্ডার মামু, আমাদের যা লুক দিয়েছিলো তা দেখে ভয়ে জমে যাবার মত অবস্থা, এখুনি তেড়ে এসে আস্ত গাড়িটাই উল্টায়ে দেয় কিনা ভাবছি, গণ্ডারের শক্তি বলে কথা! গাইড বলল, 'ডোন্ট ওরি! সে তার দৃষ্টি সীমার দু-তিন ফিটের বাইরে তেমন কিছুই দেখে না।' শুনে তাইরে নাইরে করে গাড়ি থেকে নেমে (নিরাপদ দুরুত্ব বজায় রেখে) বীরের মত মুখে হাসিআলা পোজ দিয়ে গণ্ডারের সাথে ফটো তুললাম।





গণ্ডারকে বিদায় দিয়ে কিছুদূর এগোনোর পর ছানাপোনাসমেত এক উটপাখী যুগল দেখে আমাদের চোখ ছানাবড়া। দুমকি চালে খুব আয়েসে হেঁটে যাচ্ছে তারা আমাদের ঠিক সামনে দিয়ে, গাড়িটাকে সাইড দেয়ার ইচ্ছা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না এই পরিবারের। আমাদেরও তাড়া নেই, ওদের দেখেই তো আমাদের পয়সা উসুল! তাছাড়া বনে তো বন্যদের অগ্রাধিকার বেশি হওয়া উচিৎ।






শ্রী গনেশ বাওবাব। হাতির মাথার আকৃতির এই বাওবাবটিকে বলা হয়, 'এলিফ্যান্ট বাওবাব'।





প্রাচীন বাওবাব বৃক্ষ ঘিরে এ অঞ্চলে চিরকাল নানা প্রথা বিদ্যমান। এক সময়ের 'স্টোরি টেইলার' নামে পরিচিত সন্মানিত পবিত্র কিছু ব্যক্তিত্ব ছিলো, তারা বিশ্বাস করত বিশ্ব জগতের প্রতিটি বস্তুর কোনো আত্মা আছে এবং তারা সেই আত্মার কথা শুনতে পায়। মৃত্যুর পর সন্মানের নিদর্শনস্বরূপ, তাদের সমাধিত করা হত বিশাল বিশাল বাওবাবের মাঝের ফোঁপা গর্তে। পরবর্তিতে সে্নেগালে সরকারী ভাবে এই প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এরকম একাধিক গাছের সন্ধান পাওয়া যায় যার এক একটির ভেতর একশর অধিক ব্যক্তিকে সমাধিত করা হয়েছিলো। বান্দিয়া সাফারি পার্কের এই বিশাল বাওবাবটি সেই প্রথার চিহ্ন ধরে রেখেছে।













এছাড়াও 'La Reserve De Bandia' সাফারি পার্কটি ৩৫০০ হেক্টর বিস্তৃত অঞ্চল অসংখ্য প্রাণীর সংরক্ষণ স্থান হিসেবে গণ্য। তাদের মধ্যে বাফেলো, অ্যান্টিলোপ, কুডু, ইম্পালা, গেজাল, কুমির, কচ্ছপ, বানর ইত্যাদি। আর পাখীদের মধ্যে রয়েছে - স্মল হর্নবিল, গ্রে হেরন, ব্লাক বার্ড, ঈগল, মাছ রাঙ্গা ইত্যাদি। উল্লেখ্য, এই পার্কটিতে কোনো হিংস্র পশু রাখা হয়নি।

..........................................................................................

আফ্রিকায় সাফারি আগ্রহীদের জন্য টিপস-

১। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি আবহাওয়া অতীব চমৎকার।
২। আফ্রিকায় আসার আগে ফ্রেঞ্চ ভাষাটা মোটামোটি রপ্ত করে আসা ভালো। আমারা পার পেয়েছিলাম আমদের ড্রাইভার কিছুটা ইংলিশ ও লোকাল ভাষা জানতো বলে। এখানকার ফ্রেঞ্চ অধ্যুষিত অঞ্চলের লোকেরা ইংলিশ একদমই বুঝে না।
৩। সাফারিতে যাওয়ার উপযুক্ত সময় ভোর বা সন্ধ্যায় যেসময় প্রানীরা কাছের কোনো জলাধারে পানি খেতে আসে, সেক্ষেত্রে তাদের খুঁজে বের করতে গোল গোল ঘুল্লি দেয়া একটু কম লাগে।


No comments:

Post a Comment