Wednesday 5 December 2012

কালো গণ্ডার, বিপন্নপ্রায় একটি প্রজাতির নাম!



বর্তমানে আফ্রিকায় সবচেয়ে বেশী হুমকীর মুখে প্রাণীটি হলো কালো গণ্ডার। এক সময় বিশাল মহাদেশটির বিস্তৃত বনভূমি ও তৃণভূমিতে সাদা-কালো এই দুই প্রজাতির গণ্ডারের অবাধ বিচরণ থাকলেও বেপরোয়া হত্যা, শিকার এবং ব্যাপক চোরাকারবারির কারণে আজ বিপন্নপ্রায় কালো গণ্ডারের অস্তিত্ব। সাদা গণ্ডারও পৌঁছেচে বিলুপ্তির কাতারে। স্বর্ণের চেয়ে দ্বিগুণ দামী গণ্ডারের শিংকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে আফ্রিকায় নৃশংস ও রক্তাত্ব সব চোরাশিকারী যুদ্ধ!


 



সাদা ও কালো এই দুটো প্রজাতিই আসলে হালকা থেকে গাঢ় ধূসর বা বাদামী বর্ণের হয়ে থাকে। এদের মধ্যে তফাৎ করা হয় মূলত মুখের আকৃতি – বিশেষ করে উপরের ঠোঁটের গঠন প্রণালী থেকে। এই ঠোঁটের ভিন্ন গঠন প্রণালীর দরুণ কালো গন্ডারকে ‘hook-lipped rhino’ আর সাদা গণ্ডারকে ‘square-lipped rhino’ নামে ডাকা হয়। বস্তুত ঠোঁটের ভিন্ন আকৃতি চিহ্নিত করে এই দুটি প্রজাতির ভিন্ন খাদ্যাভাসের –- কালো গণ্ডার যেখানে ছোট ছোট ডালপালা, লতাপাতাসমৃদ্ধ গাছ ও ঝোপঝাড় খুঁজে বেড়ায়, সেখানে সাদা গণ্ডার চরে বেড়ায় বিস্তৃত তৃণভূমিতে। জীবনধারণের জন্য পানি এদের কাছে অত্যাবশ্যকীয়, তাই তারা কখনোই পানির খুব বেশি দুরে যায় না। ভোর ও সন্ধ্যা এই দুইবেলায় এরা নিকটবর্তী জলাশয়ে পানি পান করে।



গণ্ডার লম্বায় আফ্রিকান মোষের কাঁধ বরাবর হলেও ওজনে প্রায় এর দ্বিগুণ হয়ে থাকে। এই ভারি-ভরকম শরীর নিয়েও প্রাণীটি ঘণ্টায় ৫০ কিমি পর্যন্ত দৌড়াতে পারে। আর দুর্বল দৃষ্টিশক্তির অনেকটাই পুষিয়ে দেয় এর তীক্ষ্ণ ঘ্রাণশক্তি। শুধুমাত্র প্রজননের প্রয়োজন ছাড়া গণ্ডার একা থাকতেই পছন্দ করে। প্রজননের জন্য গণ্ডারের কোনো নির্দিষ্ট মৌসুম থাকে না। পুরুষ গণ্ডার মূত্রের ঘ্রাণ থেকে সঙ্গী চিনে নেয়। অর্থাৎ মূত্রের মাধ্যমেই এরা একজন আরেকজনের সাথে যোগাযোগ করে থাকে। সাধারণত পুরুষ গণ্ডার আগন্তুকের প্রতি আক্রমণান্তক হয়ে থাকে।



গণ্ডারের মুখের উপরের অংশে দুটো শিং থাকে, কদাচিৎ কোনোটার তিনটে শিংও দেখা যায়। সামনের শিংটি গড়ে ৬০ সেমি হয়, ক্ষেত্রবিশেষে তা ১৫০ সেমি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে।



ইউরোপীয় প্রভুদের দ্বারাই আফ্রিকায় গণ্ডারনিধনের সূত্রপাতঃ


বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা তাদের আবাসনের প্রয়োজনে আফ্রিকায় কিছু অবকাঠামোভিত্তিক পরিবর্তনে হাত দেয়, কৃতদাস ও খনিজ ব্যবসার পাশাপাশি আফ্রিকার উর্বরভূমিতে খামার ও পশ্চিমা কায়দায় চাষাবাদ শুরু করে, সাথে কাণ্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয়স্বরূপ এখানকার বন্য ঐতিহ্য উজাড়ে প্রাথমিক তৎপরতাও শুরু করে দেয়। ইউরোপীয় সৌখিন শিকারীদের নিছক বিনোদনের তাগিদে সেসময় রোজ গড়ে পাঁচ থেকে ছয়টি গন্ডার হত্যা করা হয়েছে। এরকম বেহিসেবী প্রাণ দিতে হয়েছে হাতি, সিংহসহ অন্যান্য বন্যপশুকেও। অবশ্য হাতির দাঁতের কারবার ইউরোপীয় বণিকরা শুরু করে দিয়েছিলো তারও বহু আগেই। অর্থাৎ সামন্তপ্রভুদের রেখে যাওয়া বিনাশের এ মাত্রা ছিলো সম্পূর্ন অপূরণীয়।

গণ্ডারের শিঙের চোরাকারবারি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়াঃ



শিকার ও হত্যার পাশাপাশি আফ্রিকান হাতির দাঁতের সাথে গণ্ডারের শিঙেরও চোরাকারবারির রাজত্ব শুরু হয় ষাটের দশকের শেষে ও সত্তুরের দশকের শুরু থেকে। অনুমান করা হয় ইউরোপিয়ানদের দ্বারা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের পরেও সেসময় মহাদেশটিতে ৭০,০০০ এর মতো জীবিত কালো গণ্ডার ছিলো। প্রাপ্ত তথ্যমতে - সত্তুর দশকের শুরু থেকে এই পোচিং মোটামুটি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে এবং আশির দশকের মধ্যেই প্রাণীটির সংখ্যা স্থানভেদে শতকরা ৪০ থেকে ৯০ ভাগ পর্যন্ত কমিয়ে আনে। কেবল মাত্র ১৯৭০ থেকে ১৯৯২ সালের ভেতর পুরো আফ্রিকায় সমগ্র কালো গণ্ডারের ৯৬ ভাগই মেরে সাফ করা হয়।




কলোনি পরবর্তী অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অভ্যন্তরীণ জাতিগত সংঘর্ষ এবং আফ্রিকার নানাদেশে চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে বিশাল এ মহাদেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে এন্টি-পোচিং কার্যক্রমও তুলনামূলক শ্লথ গতিতে এগিয়ে চলছে। এবং বেশীরভাগ স্থানেই সংরক্ষণের প্রক্রিয়াকে নিত্য বাধার মুখে পড়তে হয়। উদাহরণস্বরূপ – এঙ্গোলা, রুয়ান্ডা, সোমালিয়া, সুদানের মত জাতিগত দাঙ্গা ও গৃহযুদ্ধে জর্জরিত দেশগুলোতে বন্যজীবন সংরক্ষণের মত কার্যক্রম পরিচালনা করা রীতিমত দুঃসাধ্য ব্যাপার। ফলে এই পোচিং ও চোরাকারবারিদের দৌরাত্ব অভুতপূর্বভাবে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। যে কারণে প্রানীটির সংখ্যা কমতে কমতে আফ্রিকার বিভিন্ন প্রান্ত যেমন- পশ্চিম আফ্রিকায় ইতিমধ্যে কালো গণ্ডার সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন ঘোষণা করা হয়েছে।



বর্তমানে আফ্রিকায় জীবিত গণ্ডারের সংখ্যা ও সংরক্ষণঃ


বর্তমানে আফ্রিকায় বিশ হাজারের মত সাদা গণ্ডার এবং মাত্র পাঁচ হাজারেরও কম কালো গণ্ডার অবশিষ্ট আছে। যার মধ্যে ৯৮ ভাগই কেবলমাত্র -- সাউথ আফ্রিকা, নাবিবিয়া, জিম্বাবুয়ে ও কেনিয়া এই চারটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অনেকসময় চোরাকারবারিদের হাত থেকে রক্ষার জন্যে তাদের সরিয়ে নেয়া হয় সংরক্ষিত স্থানগুলোতে। যেখানে ডেভিড শেল্ড্রিকের ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্টের মত গুটিকয়েক কনজারভেশন সেন্টার, ন্যাশনাল পার্কগুলোতে এই বিপন্নপ্রায় প্রাণীটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ‘দুর্বল প্রয়াস’ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ‘দুর্বল প্রয়াস’ কথাটা বলার কারণ হলো - সংরক্ষিত এরিয়াগুলোতেও গন্ডার ও হাতির মত মূল্যবান প্রাণী দুর্বিৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা করতে বনরক্ষক, কর্মীদের রীতিমত হিমশিম খেতে হয়।



 কোথাও কোথাও ২৪ ঘণ্টা গান প্রটেকশনে রেখেও তাদের রক্ষা করা দায় হয়ে পড়ে। কখনো সংরক্ষণ কর্মীদের সাথে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত দুর্বিৃত্তদের সংঘর্ষ এবং মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে থাকে। এছাড়াও রাতে চাঁদের আলোয় চোরাহত্যা, গুপ্তহত্যা ইত্যাদি নৃশংসতা তো ঘটছে হরহামেশাই। 





গণ্ডারের শিঙের এই ব্যবসা এতটাই লাভজনক যে হাতির দাঁতের মত এটা সংগ্রহের জন্যেও সুসংগঠিত চোরাকারবারির আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, যাতে প্রত্যক্ষভাবে ইন্ধন যুগিয়ে যাচ্ছে আমেরিকার মত শক্তিধর দেশগুলো। ফলে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির হেলিকাপ্টার থেকে শুরু করে, রাতে দেখা যায় এমন বাইনোকুলার, সাইলেন্সড গান, বিষাক্ত বা অচেতন করার ওষুধ এবং অন্যান্য দুষ্প্রাপ্য অস্ত্রপাতি সহজলভ্য করে পৌঁছে দেয়া হয় আঞ্চলিক দুর্বিৃত্তদের হাতে। অর্থাৎ আফ্রিকার বনঐতিহ্য উজাড়ে একটি বড় দায়ভার বর্তায় আমেরিকার মত সুবিধাবাদী রাষ্ট্রের উপরও।

তাই নির্লজ্জ বাস্তবতা হলো – শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কালো গণ্ডারের মত ঐতিহ্যবাহী অসাধারণ এই প্রাণীটির শেষ রক্ষা হয়ত সম্ভব না। সম্প্রতি কয়েক বছরে আফ্রিকার কালো গণ্ডার হত্যার ক্রমবর্ধমান চিত্রটি অন্তত তাই বলে –
২০০৯ সালে হত্যাকৃত গন্ডারের সংখ্যা ছিলো – ১২২ টি
২০১০ সালে হত্যাকৃত গন্ডারের সংখ্যা ছিলো – ৩৩৩ টি
২০১২ সালে এপর্যন্ত গন্ডার হত্যার সংখ্যা – ৩৮৮ টি (যা এরই মধ্যে বিগত কয়েক বছরের গন্ডার হত্যার সংখ্যা ছাড়িয়ে গিয়েছে!) 


কেবলমাত্র যে শিঙের জন্য আস্ত একটা প্রজাতিই বিলুপ্ত হতে বসেছে, এবার দেখা যাক সেই সিঙের প্রকৃত গুরুত্ব ও মহত্ত্বঃ




এরকম একটা শিঙের ওজন আট পাউন্ডের মত। এবং যার কালোবাজারি দাম ৩৬০,০০০ ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে! (আতর্জাতিক ইন্ধন তথা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ও মূল্যবান অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের কারণটা মোটামুটি এখানেই পরিষ্কার। ব্যাপক হারে গণ্ডার নিধন বস্তুত মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের মামলা!)




গণ্ডারের শিঙের সবচেয়ে বড় বাজার দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার প্রধাণত চায়না ও ভিয়েতনাম, যেখানে এই শিং-কে অত্যন্ত কার্যকরী ঔষধিগুনসমৃদ্ধ একটি মূল্যবান উপাদান হিসেবে মনে করা হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ বছরের প্রচলিত বিশ্বাসমতে গন্ডারের শিং থেকে প্রাপ্ত পাউডার মাথাব্যথা, জ্বর, হৃদরোগ এবং কান্সারের মত অসুখ সারাতে সক্ষম।

অথচ যেখানে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, গণ্ডারের শিঙ keratin নামের প্রোটিন দিয়ে গঠিত, একই কেরাটিন যা আমাদের নখ ও চুলেও বিদ্যমান। এবং যার মধ্যে কোনো প্রকার রোগ নিরাময়ের ঔষধি গুণাবলীর বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায় না!

অতএব শুধুমাত্র ভ্রান্ত ধারণা আর বিশ্বাসই গণ্ডারের শিঙের মত খুব সাধারণ একটি বস্তুকে মানুষের কাছে করে তুলেছে অমূল্য! এবং যার বলি হতে হয়েছে পুরো সমৃদ্ধ এক প্রজাতিকে। মানষের নির্বুদ্ধিতা, অজ্ঞতা এবং নৃশংসতার মূল্য না জানি এরকম কত প্রজাতিকে ইতোমধ্যে দিতে হয়েছে এবং রোজ কত নতুন প্রজাতি এ কাতারে যোগ হচ্ছে, সে হিসেব নিঃসন্দেহে ভয়াবহ!

যদিও আপাতদৃষ্টিতে চায়নায় আইনের মাধ্যমে তাদের ঐতিহ্যবাহী ঔষধপত্রে গন্ডারের শিং ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তারপরেও পরিসংখ্যান বলছে অন্য কথা - পোচিং চলছে দেদারসে, বরং পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়েও আরো জোরেসোরে। এ প্রবণতা এতটাই আশংকাজনক যে, যদি এখনই বন্ধ না হয় তবে পৃথিবী অচিরেই হারাবে আফ্রিকান কালো গণ্ডার, প্রকৃতি হারাবে তার আরেক বিশাল প্রজাতি, এবং একের পর এক এই মনুষ্যসৃষ্ট বিলুপ্তি আমাদের নিজেদের কপালে কি দুর্ভোগ বয়ে আনবে তা হয়ত আমারা এখনো অনুমানও করে উঠতে পারি নাই!
------------------------------------------------------------------------------------------------------
তথ্য ও ছবি সূত্রঃ

ডাব্লিউ ডাব্লিউ এফ গ্লোবাল
বিবিসি
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
 ইউকিপিডিয়া
স্টার আফ্রিকা
ভণ্ডুল


No comments:

Post a Comment