Wednesday 26 December 2012

বাংলাদেশ (পর্ব-২)

বাংলার আদি ঐতিহ্য ও সভ্যতার পন্ড্রুবর্ধন বা বরেন্দ্রভূমি এই রাজশাহী। যুগ যুগ ধরে বিশাল পদ্মার তীর ধরে পৃথিবীর কত প্রান্ত থেকে কত মানুষ এসে বসতি গড়েছে এখানে, রেখেছে স্ব স্ব ঐতিহ্যের ছাপ। রাজশাহির আনাচে কানাচে নানা উপজাতির বাস, তাদের ভিন্ন জীবন প্রণালী আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা প্রাচীন নিদর্শন তারই সাক্ষ্য বহন করে।



কুবেরের রূপোলি আঁশের ইলিশের পদ্মা! "পদ্মার ঢেউরে মোর শুন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা" - নজরুল জানে নাই এই পদ্মার ঢেউ একদিন থেমে যাবে, পদ্মার হৃদয় চিরে জেগে উঠবে আদিগন্ত শূন্য বেলাভুমি, বিবর্ণ মুখে উপহাস করবে একদার এই উচ্ছলা, প্রানবন্ত, অবাধ জলরাশির ভরাযৌবনা পদ্মার! শত শত বছর ধরে যা দিয়েছে মানুষের জীবন-জীবিকার সন্ধান, যুগিয়েছে সাহিত্য সাধনার খোরাক। আজ এই পদ্মার বুক জুড়ে শুধুই মানুষের নির্মমতার হাহাকার!
রাজশাহী এসে প্রথমে আমাকে যা মুগ্ধ করলো তা হলো রাজশাহী ষ্টেশনটি। বাংলাদেশের রেলযোগাযোগ মাধ্যমের প্রকৃত অবস্থা অন্তত এই ষ্টেশনটি দেখে বোঝার উপায় নাই। এটি কেবল আধুনিকই নয় বরং বাংলাদেশের অন্যান্য ষ্টেশনগুলোর তুলনায় পরিচ্ছন্ন। যা দেখে দেশে জীর্ণদশা এই মাধ্যমটির উপর একটু হলেও নতুন আশা জাগে, আবার পরক্ষণেই মনে পড়ে বীরগঞ্জ থেকে সন্ধ্যা ৮টার ট্রেন সৌভাগ্যক্রমে রাত ২টায় পেয়েছি, এই দীর্ঘ সময়টা ছোট বাচ্চা নিয়ে আমাদের কাটাতে হয়েছে অস্বাস্থ্যকর অন্ধকার ষ্টেশনটির মধ্যে, কারণ প্রায় পুরোটা সময় সেখানে কারেন্ট ছিলো না। নিজের মনে সান্তনা দিচ্ছিলাম এই ভেবে- এ তো মানুষের রোজকার ভোগান্তি, আমি একদিন দেখলাম! সে সময় মাথায় শুধু একটা কথাই ভাসছিলো, আমরা নিরাপদ সড়ক, যানজটমুক্ত জীবনের জন্য এত কথা বলছি, এত কিছু ভাবছি, অথচ সে একই কারণে কেন দেশের রেলযোগাযোগ মাধ্যমকে সচল ও পুনরুজ্জীবিত করতে সমান ভাবে আওয়াজ তুলছি না? এটাতো স্পষ্ট যে, এই বিশাল জনগোষ্ঠীর চাপ দেশের রাস্তাগুলো থেকে কমাতে না পারলে 'নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ সড়ক' করে মুখে ফেনা তুলে ফেললেও লাভের লাভ কিছু হবে না। আর সড়কের উপর চাপ কমানোর একমাত্র উপায় হলো সারাদেশের অচলপ্রায় মুখ থুবড়ে পড়া রেল ব্যবস্থা পুরো উদ্দমে চালু করা।

ঢাকা শহরে যানজট কমাতে বিশাল বিশাল সব ফ্লাইওভার বানানো হচ্ছে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, দেখতে ভালোই লাগে। কিন্তু যে পরিমানে প্রাইভেট গাড়ি প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় নামেছে, তাতে আদৌ কি এই ক্রমবর্ধমান যানজট সামাল দেয়া সম্ভব! আর রাস্তাগুলোতে দেদারসে চলে বেড়ানো ত্রুটিপূর্ণ আনফিট যাত্রীবাহী যানগুলোর দৌরাত্ব দেখে মনে হয়, এর বদলে ঢাকা ও এর আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে এবং সাথে অবশ্যই দেশের অন্য বড় শহরগুলোতেও যদি অভ্যন্তরীণ মেট্রো ট্রেন সার্ভিস চালু করা যেত, ষ্টেশনগুলোর মানোন্নয়ন করে সব শ্রেণীর মানুষের উপযোগী করা হত , মান্ধাতার আমলের ট্রেনগুলোর সাথে যদি কিছু নতুন সার্ভিস চালু করা যেত, প্রয়োজনে পরিকল্পিতভাবে নতুন ট্র্যাক স্থাপন করে মোটকথা পুরো সিস্টেমটিকে ঢেলে বর্তমান সময়ের চাহিদানুরূপ সাজানো হত, তাহলে দেশের সড়ক মাধ্যমটির উপর থেকে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর ভার অনেকাংশেই কমে আসত! পরিণামস্বরূপ দুর্ঘটনা, যানজট, রোজকার এই ভোগান্তির হাত থেকেও মানুষ রেহাই পেত বলে মনে করি।

আমার আলোচনা আবার অন্য ট্র্যাকে যাচ্ছে, আসছি মূল বিষয়ে।

‘বাংলাদেশ’ লেখাটি শুরু করেছিলাম দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী কান্তজীর মন্দির থেকে। এ পর্বে থাকছে রাজশাহী অঞ্চলের প্রাচীন বাঘা মসজিদ। পঞ্চাশ টাকা নোটে এই মসজিদটির ছবি দেখে আসছি সেই ছোটবেলা থেকে, সুযোগ হয়েছিলো মসজিদটিকে একেবারে কাছ থেকে দেখার।





রাজশাহী শহর থেকে ২৫ মাইল দক্ষিণে ঐতিহাসিক বাঘা মসজিদ অবস্থিত। মোঘলদের অনেক কীর্তি নিয়ে আমরা প্রায়শঃই গর্ববোধ করি, যেমন, এযাবৎ বাংলাদেশের তিনটি ওয়াল্ড হেরিটেজের একটি বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ, পুরান ঢাকার লালবাগের কেল্লা ইত্যাদি। হয়ত আমার বাংলাদেশ ভ্রমণে পরবর্তী পর্বগুলোতে এসবের উল্লেখ আসতে পারে। তবে আমার কাছে এগুলোর মধ্যে বাংলার নিজ ঐতিহ্যের প্রকৃত গর্বের দ্বাবিদার অবশ্যই এই প্রাচীনতম এই বাঘা মসজিদটি, কারন এটিকে আমরা আদি বাংলার নিজেস্ব ঐতিহ্য বলে নিঃসঙ্কোচে দ্বাবি করতে পারি। বাবর যেখানে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহীম লোদীকে পরাজিত করে ভারত দখল করে ১৫২৬ খ্রিটাব্দে, তারও অনেক পরে ১৫৫৬ র দিকে মোঘলরা বাংলায় প্রবেশ করে, সেখানে ১৫২৩ সালে বাংলার স্বাধীন সুলতান নাসিরুদ্দিন নুশরাত শাহের আমলে বাঘা মসজিদটি নির্মান করা হয়। তিনি ছিলেন আবদুল্লাহ হোসেন শাহের পুত্র অর্থাৎ হোসেন শাহি বংশের দ্বিতীয় সুলতান, বাবার মতই মোঘলদের আক্রমণ হতে নানা কৌশলে যিনি বাংলার ভূমিকে রক্ষা করেন। অর্থাৎ বাঘা মসজিদটি এ অঞ্চলে মোঘলদের আগমনেরও কয়েক দশক আগের প্রাচীন এক কীর্তি।মসজিদটি ভেতরে ও বাইরে পোড়ামাটির ফলক চিত্রের অপূর্ব নকশা দ্বারা অলংকৃত। যার আসল সৌন্দর্য্য কালের পরিক্রমায় অনেকটাই মুছে গিয়েছে।



প্রবেশের জন্য দুপাশে আকর্ষণীয় দুটো বিশাল ফটক, যা একই সাথে একই আদলে তৈরী করা হয়েছিলো, এগুলোর মধ্যে পোড়ামাটির নকশার কাজগুলো আজ অদৃশ্য।



১৮৯৭ এর শক্তিশালী ভূমিকম্পে বাংলাদেশের অধিকাংশ পুরাতত্ত্বের বিবিধ ক্ষতি সাধন হয়, সেসময় বাঘা মসজিদের মূল ছাদটিও খসে পড়ে। পরবর্তীতে দেশের পুরাতত্ত্ব বিভাগ পুণরায় পাথরের পিলারে উপর বর্তমান একাধিক কাপ আকৃতির গম্বুজের ছাদটি নির্মান করে যা মসজিদটির ভেতর ও বাহিরের জৌলুশময় রূপটি আরো ফুটিয়ে তুলে। খুব সম্ভব এই একই ভূমিকম্পে বাংলার আরেক ঐতিহ্য কান্তজীর মন্দিরের আদি আকৃতির ৯টি চূড়াও ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।



টেরাকোটা বা পোড়ামাটির কারুকাজ - কান্তজী মন্দিরের মতই বাঘা মসজিদটিও বাংলাদেশের পোড়ামাটির ফলকে কারুকাজ বা নকশার জন্য উল্লেখযোগ্য একটি নিদর্শন, কিন্তু মসজিদটি আরো প্রাচীন হওয়ায় এখানকার অধিকাংশ নকশা প্রায় ক্ষয়প্রাপ্ত। আর ধর্মীয় কারণে এগুলো কোন পৌরাণিক কাহিনী বর্ণনা করে না। যদিও তা সেসময়ের সূক্ষ রুচি ও গাঢ় শিল্পবোধের পরিচয় ফুটিয়ে তুলতে অনবদ্য ভূমিকা রাখে।


যেভাবে প্রাচীন স্তম্ভগুলো টেরাকোটায় অলংকৃত ছিলো।


সম্মুখে এই সবুজ ঘেরা বিশাল প্রাচীন দীঘিটি মসজিদের চারপাশে একটি নির্মল শান্তির পরিবেশ আবিষ্ট করে রেখেছে যা মূলত খনন করা হয়েছিলো কৃষিজমিতে জলসেচের জন্য।



অসূর্য্যস্পর্শা নারীদের গল্প- এটি ছিলো সেসব নারীদের স্নানের পুকুর যারা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত রয়ে গেছে সূর্যের স্পর্শের বাইরে। বাড়ি হতে সুড়ঙ্গপথে তারা পুকুরে স্নান করতে আসত আবার সুড়ঙ্গপথেই ফিরে যেত। এই সৌরজগতের প্রতিটি গ্রহ-উপগ্রহ, জীব-জগত, ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ প্রতিটি বস্তুকণার মূল চালিকাশক্তি বা প্রাণ যেখানে সূর্য্য সেখানে এইসব নারীদের জীবন কতটা স্বভাবিক ছিলো এই সূর্য্য নামক কল্পিত পুরুষটিকে প্রত্যাক্ষিত করে! জানতে ইচ্ছা করে তাদের জীবন কেমন ছিলো, যারা কখনো আকাশ দেখেনি, শীতের সকালের নরম রোদ গায়ে মাখেনি, নদীতে ভাসেনি, খোলা মাঠে বন্ধুদের সাথে চি-বুড়ি, গোল্লাছুট খেলনি! সেই ঘেরা দেয়া গাছটির সাথে তাদের কি খুব বেশি পার্থক্য ছিলো, সুরক্ষার বেড়াজালে যে গাছটি এত অধিক পরিমানে ঢেকে দেয়া হয় যে তার প্রকৃতি প্রদত্ত স্বাভাবিক বৃদ্ধিই থমকে যায়, মুক্ত আলো বাতাসের অভাবে গাছটি বাহিরে নির্জীব ও ফ্যাকাশে হয়ে বেড়ে উঠে, তাহলে তার ভেতরে বা মনের উপর এর প্রভাব কতটা ভয়াবহ হতে পারে! হঠাৎ সে ঢাকা তুলে দিলেও গাছটি আর বাঁচেনা, জ্বলে য়ায়, কারণ সূর্য্যের প্রখরতা সহ্য করার মত মনের শক্তি তার অর্জিত থাকেনা! বাঘা মসজিদ থেকে কিছুটা দুরে অবস্থিত এই পুকুরটি নিয়ে কোনো ঐতিহাসিক দলিল পেলাম না। তবে পুকুর, সাথে ঝোপঝাড়ে ঢাকা সুড়ঙ্গ পথটি এবং পুকুরটি নিয়ে মানুষের প্রচলিত গল্প বা ধারনা, সহজে মিলে যায় একটির সাথে আর একটি। বাংলাদেশ পুরাতত্ত্ব বিভাগ এই পুকুরটি সংরক্ষণের চেষ্টা করছে, যদিও দেখে তা মনে হয়নি।



পুকুরটি থেকে কিছুদুর গিয়ে চোখে পড়ল আরেকটি প্রাচীন মসজিদ, যেটির ছাদও পুনঃস্থাপিত করা হয়েছে দেখে বোঝা যায়!






বাংলার অবারিত কচি ধানের মাঠ, মাটির সোঁদা গন্ধ, খোলা আকাশ আর কাশবনে ঢেউ খেলানো বুনো হাওয়া সব কিছুর খুব চেনা এক আকুল আবেদন মন ভুলিয়ে নিয়ে যায় দুরে- যেখানে আছে আমার ফেলে আসা দিন, নকশীকাঁথার মাঠ, রূপকথার দেশ, মাটির চুলোর ওম, দাদীর পান খাওয়া ফোকলা দাঁতের হাসি আরও অনেক কিছু!


পুরনো দুঃখ - আমি কেন শিশু হলাম না!

---------------------------------------------------------------------------------------------------

No comments:

Post a Comment