Tuesday 28 August 2012

আটলান্টিকের পাড়ে গড়ে উঠা দাসত্ব ও Slave House গুলোর গল্প (পরের অংশ)

দাসবাণিজ্যে নিজেদের আধিপত্য নিয়ে পশ্চিমাদের মধ্যে হানহানির ইতিহাস আগেই বলেছি। Trade center গুলোতে আক্রমন, দখল, যুদ্ধ, মৃত্যু এগুলো যেন ছিলো তখনকার নিত্যদিনের ঘটনা। যেকারনে প্রতিটি Slave House গড়ে তোলা হয় দূর্গের ভেতরে অথবা এগুলোকে কেন্দ্র করে আশেপাশে গড়ে তোলা হয় দূর্গ। শত্রু পক্ষের অবাঞ্চিত দখল ঠেকাতে বসানো হয় বিশাল বিশাল কামান, প্রস্তুত রাখা হয় অগণিত গোলা।


[Goree Island, Senegal]


[Cape Coast Castle, Ghana]


[Cape Coast Castle, Ghana]


[Bunker at Goree Island, Senegal]

উপরের ছবি গুলো দেখে খুব সহজে অনুমান করা যায় যে, একসময় এই স্থান গুলোতে কি পরিমান আধিপত্যের লড়াই চলতো এবং কতটা লাভজনক হলে তবেই এক একটা অঞ্চল নিয়ে দিনের পর দিন এতটা হানাহানি চলতে পারে! দাসবাণিজ্য নিঃসন্দেহে একটি লাভজনক বাণিজ্য ছিলো। এ বাণিজ্যের প্রতেক্ষ সুবিধা ভোগ করে একদিকে যেমন সমৃদ্ধ হয়েছে দাস আমদানিকারক দেশগুলো, যার প্রথম সারিতেই আসে USA - তাদের শিল্প-কারখানা, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, বাঁধ, রেল যোগাযোগ মাধ্যম, বিভিন্ন খনি, সেচ ও কৃষি খাতে এই সকল দাসদের ‘রক্ত, অশ্রু এবং ঘাম’ ঝরিয়ে, অন্যদিকে তেমনি কাঁচা টাকার পাহাড় গড়েছে ইউরোপীয় শক্তিধর দেশগুলোর দাস পরিবহনকারী সংস্থা বা দাস ব্যবসায়ীরা, এসব প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে ভরা অঞ্চলগুলোর, সম্পদ অবাধে লুঠ ও নিজ দেশে নিয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণেও এখানকারই অসহায় মানুষগুলোকে চরমভাবে ব্যবহার করে। অর্থাৎ বলা যায় এসব অঞ্চলের সম্পদ ও মানুষ দুই নিয়ে গড়ে উঠে ছিলো পরাশক্তিধর দেশগুলোর এই রমরমা বাণিজ্য, যাকে ইউরোপ, আফ্রিকা এবং আমেরিকার মধ্যে ‘Triangular Trade’ বা ত্রিভূজিয় বাণিজ্য বলা হয়! শুধু এই বাণিজ্য কোনো লাভজনক পরিবর্তন আনতে পারেনি আফ্রিকার আটলান্টিকের ধারে টিকে থাকা এই দেশগুলোর নিজেদের ভাগ্যে। বরং শত শত বছর ধরে চলতে থাকা শোষণ ও বঞ্ছনায় দেশগুলো অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে পঙ্গু হয়ে যায় চিরতরে। 

উপরন্তু আধিপত্য দীর্ঘস্থায়ী করতে, এইসব এলাকার সম্পদের শোষণসহ দাসের যোগান নিশ্চিত রাখতে বৃটিশরা কৌশলে ছড়ায় আঞ্চলিক বিভিন্ন গোত্র গুলোর মধ্যে জাতিগত দ্বন্দ্ব, যা পরবর্তিতে ভয়ংকর রূপ নেয়। উল্লেখ্য আফ্রিকানদের দাসত্বের করুণ পরিনতির জন্য এসব অঞ্চলের তথাকথিত রাজা বা গোত্রপ্রধানরাও সমানভাবে দায়ী ছিলো, যারা সামান্য অর্থ ও সুযোগসুবিধার লোভে অথবা পশ্চিমা প্রভুদের খুশী রাখতে নিজ গোত্রের মানুষ তাদের হাতে তুলে দিত। মূলত সেই সকল গোত্র প্রধানদের হাতে রাখতেই বৃটিশরা তাদের এই ঘৃনিত কৌশল প্রয়োগ করে, যেমনটা তারা করেছিলো ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু, মুসলিমদের ক্ষেত্রে। এখনো আফ্রিকার যেসব দেশ গুলোতে প্রচুর পরিমানে অর্থনৈতিক রিসোর্স আছে, বিশেষ করে খনিজ সম্পদে ভরা অঞ্চলগুলোতে জাতিগত দাঙ্গা চিরস্থায়ী, উদাহরন – অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক ইত্যাদি। অতএব বলা যায় অবাধ সম্ভবনা থাকা সত্ত্বেও এ অঞ্চলের দেশগুলো যে কাতারে ছিলো আজও সে কাতারেই রয়ে যায় বুকে নিয়ে জ্বলন্ত ক্ষত!



পশ্চিম আফ্রিকার দাসবাণিজ্যের পরিসংখ্যানের যে চিত্রটি পাওয়া যায় Juffureh Meseum এ, তাতে দেখানো হয়েছে ১৬৫০ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে আনুমানিক ১৫ মিলিয়নের বেশী ‘জীবিত’ কৃতদাস পৌছায় South America, North America, Central America, West Indies এবং Europe এ । জীবিত বলার কারন হলো পরিসংখ্যানটিতে বলা হয় যাত্রাকালীন মৃতদের সংখ্যা অজানা, অথবা মৃতদের পরিসংখ্যান কোথাও রাখা হয় নাই। এছাড়াও সেখানে আরো বলা হয় এই রপ্তানিকৃত শ্রমিকদের মধ্যেও বেশির ভাগই পরে মারা যায় Carribbean, Central এবং South America য় কাজের কঠোরতা ও নিষ্ঠুর জীবনযাত্রা অবস্থার কারনে।

দাসের পিঠে গরম লোহার শিক দিয়ে চিহ্নিত করার ছবিটি যেমন অনেক কিছু বলে দেয়, তেমনি এটাও সত্য যে ছিলেন Harriet Beecher Stowe এর মতো লেখিকা, যিনি Uncle Tom's Cabin এ তাঁর মর্মস্পর্শী লেখনীর মাধ্যমে এই প্রথার বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। ছিলেন Thomas Clarkson, Henry Brougham মত মানুষ, যাদের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠে Anti Slave Society, ১৮২৩ সালে। ১৮৩৩ সালে Parliament of United Kingdom কতৃক Slavery Abolition Act আইনটি পাশের মাধ্যমে, দাসত্ব বন্ধের পাশাপাশি British Empire এর সকল দাসমুক্ত করা হয়। যদিও আইনটি মাঠপর্যায়ে সফলভাবে কার্যকর হতে লেগে যায় আরও অনেক বছর। আসে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের নাম যিনি ১৮৬২ সালে Emancipation Proclamation নামে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে তৎকালীন আমেরিকার সকল দাস মুক্তির ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে জীবিতদের কেউ কেউ ফিরে আসতে থাকে তাদের শেকড়ের সন্ধানে।


[Cape Coast Castle, Ghana]

Ghana সরকার পহেলা আগস্ট কে ‘বন্ধন মুক্তি’ Emancipation Day ঘোষণা করে। এবং পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা ঘানার কালো মানুষদের মুক্তির অনুভূতির সাথে ফিরে আসতে বলা হয়। তাদের ফিরে আসাকে উৎসাহিত করতে দূর্গের কুখ্যাত সে দরজা যার নাম ‘The Door of No Return’ তার বিপরীত দিকে লিখে দেয়া হয় ‘Door of Return’. এই Concept-টা যদিও ভালো তবে এটা সেসময় এই দরজা দিয়ে বের হয়ে যাওয়া প্রতিটি কালো মানুষের জন্য কতটা প্রযোজ্য প্রশ্ন থেকে যায়!


[Goree Island, Senegal]

Goree Island থেকে মৃত অথবা পাচারকৃত দাসদের প্রতি সন্মানে এই মিনারটি তৈরী করে পরবর্তীতে তাদেরই ফিরে আসা বা বেঁচে থাকা বংশধরেরা।


[Slavery Freedom Monument, Goree Island, Senegal]

যদিও পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে প্রায় বলার চেষ্টা করা হয়, দাসপ্রথাকে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। তারপরেও তাদেরই বড় বড় সব মহারথীদের, রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের লক্ষ্যে এসব Slave House গুলোতে প্রায় আসতে দেখা যায়। Goree Island এ প্রেসিডেন্ট Bill Clinton আসেন ১৯৯৮ সালে, George W. Bush আসেন ২০০৩ সালে, যা তাদের আমেরিকার বিশাল কালো জনগোষ্ঠির সন্তুষ্টি ও সমর্থন পেতে সাহায্য করে।


[Goree Island, Senegal. Guns of Navarone মুভির একটি অংশ এখানে শুটিং করা হয় যেখানে Gregory Peck তাঁর সাথীদের নিয়ে পাহাড়ে উঠছে। মুভিটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত অতএব মূল আলোচনার সাথে অপ্রাসঙ্গিক।]


[Cape Coast Castle, Ghana. মৃতদের আত্মার শান্তিতে, ফিরে আসাদের শেকড়ের সন্ধানের কামনায় এবং এখানে ঘটে যাওয়া নির্মমতা তুলে ধরার প্রতিজ্ঞায় এই Plaque টি স্থাপন করা হয় দূর্গটির দেয়ালে।]


[Cape coast Castle, Ghana. President Barack Obama, slave house টি পরিদর্শনে এসে উপরের ফলকটি উন্মোচিত করেন ২০০৯ সালে।]

[Juffureh Museum, The Gambia – Sengbeh Pieh]

Sengbeh Pieh - একজন সফল বিদ্রোহী হিসাবে যাকে স্মরণ করা হয়। তাকে Sierra Leone থেকে পর্তুগীজরা আটক করে Cuba-য় Spanish দের কাছে বিক্রি করে ১৮৩৯ সালে। কিন্তু সে ও তার সঙ্গীরা সেখানে বিদ্রোহ করে দুজন crew কে জিম্মি করে Amistad নামের Spanish Slave Ship টি নিজেদের দখলে নিতে সক্ষম হন। এবং জিম্মিকৃত crew দের জাহাজটি Sierra Leone এর দিকে নিতে বাধ্য করে। এদিকে crew রা চালাকি করে তা Sierra Leone এর পরিবর্তে USA-র দিকে নিতে থাকে, সেখানে পুনরায় তাদের বন্দি করা হয়। কিন্ত ততদিনে আমেরিকাতে দাসত্ব বন্ধের আইন কার্যকর হওয়ায়, US আদালত জাহাজটিকে Sengbeh Pieh ও তার সঙ্গীদের সহ Sierra Leone ফিরিয়ে নিয়ে মুক্ত করতে নির্দেশ দেয়। Sengbeh Pieh পরিনত হয় Sierra Leone এর একজন কিংবদন্তি হিসাবে। তার বীরত্বকে সন্মানিত করতে Sierra Leone এর ৫০০০ টাকার নোটে তার ছবি ছাপানো হয়।


এখনো অজানা কজন খুঁজে পেয়েছে তার শেকড়ের ঠিকানা!

কেবল মানবতার দোহাই এই ঐতিহাসিক প্রথা বাতিলের একমাত্র কারন ছিলোনা, মূলত ব্যাপক হারে যন্ত্রের আবিষ্কার ছিলো এই প্রথা বন্ধের অন্যতম প্রকৃত কারন। অতএব বলা যায় সাদা চামড়ার আড়ালে সুবিধাবাদী আসল কালো মানুষ গুলো যখন দেখলো যন্ত্রের আবিষ্কার তাদের কাজকে সহজ করেছে কয়েকগুণ, এতদিন মানুষ দিয়ে যে কাজটি করানো হতো, এখন মেশিন সে কাজটি করছে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে ও সহজে, তখন দাস বাণিজ্যর মতো কষ্টকর এবং ব্যয়বহুল বিষয়টি অর্থহীন হয়ে পড়ে বটে।

এরিস্টটলের মত মণীষী যদি দাসপ্রথার বাস্তব এরূপ দেখতেন, তবে ‘প্রকৃতিগত ভাবেই মানুষ জন্মে প্রভূ হয়ে, নয়তবা দাস হয়ে’ এ নির্মম তত্ত্ব দিতে পারতেন কিনা! মানুষেরই কল্যাণে যে ধর্ম, সেগুলোতেও এপ্রথাকে কেন কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ করা হলো না, এসব প্রশ্ন আমার মনকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে বার বার! বর্ণবাদ নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নাই, চাইনা নতুন করে বর্ণবাদ উস্কে দিতে। শুধু এটুকুই মেনে নিতে কষ্ট হয় যখন ইউরোপ, আমেরিকাসহ পৃথিবীর বড় বড় সব দেশ গুলোতে শীল্প, অর্থনীতি ও অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছিলো; এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো পৃথিবীর সভ্যতাকে কয়েক ধাপ উপরে, তখন সে সভ্যতারই বলি হচ্ছিলো এসব অসংখ্য অজানা নিরিহ প্রাণ, যাদের করুণ আর্তনাদ এখনও রয়ে গিয়েছে এই Slave House গুলোর শক্ত চার দেয়াল এর মধ্যে!

লেখাটা এখানেই শেষ করবো, আটলান্টিক এর পাড়ে গড়ে উঠা দাসত্বের গল্প কতটুকু বলতে পারলাম জানি না। যদিও আমার মনে হয় পৃথিবী সব স্থানের দাসত্বের কাহিনী বোধহয় অনেকটা একই, তবে এ স্থানগুলো বেশী গুরুত্ব পেয়েছিলো ক্যারিবীয় রুট থেকে যাতায়াতের সুবিধার কারণে। সবশেষে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক একটি ঘটনা যোগ করবো। Goree Island থেকে যখন ফিরছিলাম খানিকটা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে, তখন Dakar পোর্টের কাছে এই ‘বাংলার কাকলি’ আমাদের (এক সাথে পরিদর্শনে আসা আর এক বাঙালী পরিবার) সবার মুখে হাসি ফুটিয়েছিলো একসাথে, মুহূর্তের মধ্যে যেন আমরা ভুলে যাই কতটা বিস্ময়কর স্তব্ধতা নিয়ে ফিরছিলাম island টি থেকে! সৃষ্টিকর্তা বোধহয় সবাইকেই তার উপলদ্ধি যাচাইয়ের সুযোগ করে দেয়, যেমনটি আচমকা এই জাহাজটি দেখে আমাদের পুনরায় উপলদ্ধি হয় যে মানুষের কাছে কতটা প্রিয় হতে পারে তার নিজের মাতৃভূমি! সমবেদনা যেন আরও বাড়ল তাঁদের প্রতি যাদের হাতে পায়ে সেকল বেঁধে চিরদিনের জন্য বিছিন্ন করা হয়েছিল নিজের মাতৃভূমি থেকে!


[আচমকাই Dakar Port দেখতে পাওয়া বাংলাদেশী জাহাজ।]

---------------------------------------------------------------------

No comments:

Post a Comment