Tuesday 28 August 2012

বাংলাদেশ

আজকে অনেক কিছু লিখব ভেবে বসেছিলাম, অথচ কেন জানি উপরে শিরনামটা লিখেই হাত থেমে গেছে! যদিও এটা আমারই দোষ, চরিত্র মাফিক রাগ-জেদ, আহ্লাদ, আব্দার সব বাজে স্বভাব খুব সহজে বাড়াবাড়ি মাত্রায় প্রকাশ করতে পারলেও, কখনো নিজের ভালোবাসার কথাটাই সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে পারিনা! কখনো বলা হয়না আমার সবচেয়ে আপন মানুষটি কে, কার প্রশান্ত মুখের কাছে পৃথিবীর সব সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়, কোথায় অস্থির ভীত আমি সবচেয়ে নির্ভরতার আশ্রয় খুঁজে পাই, কোন নির্মল চেনা গন্ধে আমি বুক ভরে শ্বাস নিতে পারি! না, কখনোই বলা হয়নি! অথচ আজ এতটা বড় হয়েছি তারপরেও যখন রাতে ঘুমের মাঝে শীত শীত লাগে, মনে হয় মা এসে চাদরটা গায়ে তুলে দেবে। নানা কাজের মাঝে প্রায় সময়মতো খাওয়া হয়না, তারপর হঠাৎ যখন খিদেটা চাড়া দিয়ে ওঠে আবার আলসেমি কাটিয়ে নিজে থেকে খেতেও ইচ্ছা করেনা, মনে হয় মা এসে প্রথমে খুব একচোট বকে পরে আদর করে দুই গাল খাইয়ে দেবে। ফেসবুকে দেখি সবাই মা দিবসে মাকে শুভেচ্ছা জানায়, অনেক অনেক ভালবাসার কথা বলে, আমি অবাক হই, এটা ভেবে মায়ের জন্যে কি আলাদা দিন থাকা লাগে! মনে মনে কিছুটা লজ্জাও পাই, আমার তো কখনো এত সুন্দর করে মাকে কিছু বলা হয়না। আমার ছেলে মা দিবসে স্কুল থেকে আমার জন্য কার্ড বানিয়ে আনে, ভাবি আমরা স্কুল থেকে মায়ের জন্যে পড়া ছাড়া কোনো উপহার আনতে পারিনাই! অই অতটুকু বয়সে আমরা জানতামই না মা দিবস বলে কিছু আছে! তাই হয়তো ফরমালি মাকে ভালবাসার কথা বলতে শিখি নাই! তবুও তো মা আমার কাছে মা-ই, অস্তিত্বের সাথে মিশে থাকা একটা নাম! যে নামের কাছে পৃথিবীর লক্ষ কোটি সুন্দর শব্দের মনে হয় কোনো মূল্য নেই! তেমনি অস্তিত্বের সাথে মিশে থাকা আর একটি নাম ‘মাতৃভূমি’, আমার বাংলাদেশ!


কান্তনগর মন্দির, দিনাজপুর।

দেশের কথাই যখন বলছি, তো নিজের জন্ম শহরের ঐতিহ্য দিয়েই শুরু করলাম! তবে এটাকে আমার অঞ্চলভিত্তিক পক্ষপাতিত্ত্ব ভাবার কোন কারণ নেই, ছবিগুলো সাজাতে গিয়ে মনে হচ্ছে লেখাটা পরের আরোও দুই একটা পর্বে ছড়াতে পারে, সেখানে লেখা বেশ সিরিয়াস হবারও সম্ভাবনা আছে, তাই শুরুটা একটু হালকাভাবে বাড়ির পাশের গল্প দিয়েই হোক না! “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দুইপা ফেলিয়া; একটি ধানের শিষের উপর একটি শিশির বিন্দু!” যদিও এই মন্দিরটি আমার অদেখা ছিলোনা, তারপরেও ঘর থেকে দুইপা-র দূরত্বের অনেক কিছুই মানুষের বরাবরই অদেখা থেকে যায়। এই আক্ষেপ দুর করতে বাংলাদেশ ঘুরাঘুরির উপর এই পোষ্ট, দেশে দেখা আরোও কিছু অঞ্চল ও ঐতিহ্য নিয়ে লেখার ইচ্ছা আছে, যেগুলো পরের পর্বে দিতে পারব আশা করছি।


কান্তনগর মন্দিরটি উপ-মহাদেশের মধ্যযুগীয় মন্দির স্থাপত্যের একটি অপুর্ব নিদর্শন। মন্দিরটি নির্মান করেন প্রখ্যাত জমিদার মহারাজ প্রাণনাথ। ১৭০২ সালে এটির নির্মান কাজ শুরু হয়ে ১৭৫২ সালে তা শেষ হয়। এটি একটি নবরত্ন মন্দির।





পুরো মন্দিরের বাইরের দিক উৎকৃষ্ট পোড়ামাটির ফলকচিত্র দ্বারা অলংকৃত। যার প্রতিটি ফলক আলাদা ছাঁচে তৈরি হয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে জ্যামিতিক নকশায় বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী, রামায়ণ, মহাভারত এবং সেসময়ের সামাজিক ও অবসরবিনোদনের চমৎকার চিত্র তুলে ধরে।





এবার প্রায় ৭ বছর পর এই প্রাচিন স্থাপত্যটিতে যাওয়া হলো, কদিন আগে আমার একমাত্র ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে বাসায় এত অধিক মাত্রায় আত্মীয়ের সমাগম ঘটেছিলো যে, যাত্রীবোঝাই বাসের মত অতিথি-বোঝাই বিয়ে বাড়িটিতে নড়াচড়ার মত অবস্থাও ছিলোনা! ঘরে মানুষ, উঠানে মানুষ, বারান্দায় মানুষ, বাথরুমে মানুষ সবখানেই শুধু মানুষ আর মানুষ! যা দেখে দেশে জনসংখ্যা আধিক্যের নমুনা নিজ বাড়িতেই একদম হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছিলো। আর জন্মহারের উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সদ্য ডিম ফুটে বের হওয়ার একটু পর থেকে শুরু করে ন্যাদা-প্যাদা, ইঁচড়ে পাকা সবসাইজই তখন খুঁজে পাওয়া সম্ভব ছিলো, এই এক বাড়িতেই। তো এভাবেই দীর্ঘ চার পাঁচ দিনের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ও জুনের আম পাকা গরমে আমাদের অবস্থা যখন আমসত্ত্ব-প্রায়, তখন ঠিক করা হলো একটু ঘুরে আসা যাক!

যথারীতি আবার এক দঙ্গল পোলাপান, নতুন জামাই-বউ, আর আপু-দুলাভাইসহ দুইটা গাড়িতে চাপা-চাপি করে আমরা বেড়িয়ে পরলাম। দুইটা গাড়িতে চাপাচাপি বলাটা বোধহয় ঠিক হলনা, কারণ দুইটা গাড়িতে জনসংখ্যার চাপ সমান ছিলোনা। যেহেতু সামনের ছোট গাড়িটিতে ভাই তার নুতুন বউ নিয়ে যাবে তাই তার সম্মানার্থে সে গাড়িটি বলতে গেলে অন্য গাড়িটির তুলনায় ফাঁকাই যাচ্ছে, শুধু চিফ গেস্ট হিসাবে আপু দুলাভাই সে গাড়িতে। আর বাদবাকি পনেরো ষোলো জন উচ্ছিষ্ট জনতাসহ আমার জায়গা হলো বারো সিটের মাইক্রোটাতে। এই মাইক্রোবাসটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো একটু খানাখন্দ, উঁচুনিচু রাস্তা পেলেই চ্যাং মাছের মত লাফিয়ে লাফিয়ে চলা। অবশ্য এতে পেছনে বসা যাত্রীরা কিছুক্ষনের মধ্যেই মুফতে রোলার কোস্টারের আনন্দ পেতে শুরু করলো, আর কে কার গায়ে পড়লো এই নিয়ে হাসাহাসির দমক বয়ে যেতে লাগলো।






যেহেতু কান্তজীর মন্দির দিনাজপুর শহর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দুরে, তাই ঠিক করা হলো আমরা ভেতর দিয়ে কিছুটা ঘুরে গ্রামগঞ্জ দেখতে দেখতে ২০ মিনিটের রাস্তা এক ঘন্টা বা দেড় ঘন্টায় যাবো। যে সময় পরে ক্রমাগত বেড়ে গিয়েছিলো সামনের গাড়ির খানিক পর পর আচমকা ব্রেক কষায়, যেখানে থেকে নতুন বউ বের হয়ে আসে পেছন পেছন নতুন জামাইও। জামাইয়ের চোখে মুখে দুঃখ দুঃখ ভাব, হাতে পানির বোতল ও বমির পলিথিন। জানা গেলো আমাদের নতুন বউয়ের গাড়িতে উঠলে মাথা ঘুরায়।

বমি বিরতির ফাঁকে ফাঁকে গ্রাম বাংলার কিছু রুপ-



আসমানিরা!



লজ্জাবতী!

যাইহোক ফিরে আসি আবার যাত্রা পর্বে, এরই মধ্যে আমাদের মাইক্রোবাসে চলমান হাসাহাসি, কিছুটা কিলঘুষিতে টার্ন নেয়া শুরু করেছে, আমি আসন্ন দাঙ্গার আভাস পেয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে গান গান (আন্তাকশিরি) খেলার প্রস্তাব করলাম, আফটার অল অলস মস্তিস্ক শয়তানের আড্ডাখানা! যথারীতি মেয়েদের টিম আর ছেলেদের টিম আলাদা করা হলো, আমার টিমে আমি তিনজন সংগীত শিল্পী আর একজন নৃত্য শিল্পী পেয়ে বেশ গর্ববোধ করছিলাম, আর আসন্ন জয়ের কথা চিন্তা করে মনে মনে বেশ পুলক অনুভব করছিলাম। যদিও আমার স্বপ্নে ভাটা পরতে বেশি সময় লাগে নাই, কারণ কিছুক্ষনের মধ্যেই আবিষ্কার করলাম আমার শিল্পীবৃন্দের গানের গলা, সুর, তাল, লয় যতই উচ্চমার্গীয় পর্যায়ে হোকনা কেন, তাদের গানের ভাণ্ডার মোটেও সেই পর্যায়ে সমৃদ্ধ নয়, আর বৈচিত্রের ব্যাপারে আরও বেহাল দশা! আমাদের অবস্থা হলো এরকম যে, যেটা জানি তো সবাই জানি, যখন কোন অক্ষর দিয়ে গান পাচ্ছিনা তো কেউ পাচ্ছি না! অন্যদিকে ড্রাইভার সেকান্দার ভাইয়ের ভরসায় ছেলেরা আমাদের থেকে অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থায় পৌছে গেলো। সেকান্দার ভাইয়ের গানের ভাণ্ডার যে আমাদের চেয়ে বিস্তৃত ছিলো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ইতিমদ্ধে সে গফুর বাদশা বাঞ্চা পরি, গোলাপি এখন বিলেত, ও প্রিয়া তুমি কোথায় ইত্যাদি গান গেয়ে, দেশীয় সংগীত ও সঙ্কৃতিতে তার অবাধ দখলের নমুনা দেখিয়ে আমাদের রীতিমত তাক লাগিয়ে দিলো! উপায় না দেখে বললাম, সেকান্দার ভাই আজকাল মাইক্রোবাস অনেক বেশী এক্সসিডেন্ট হচ্ছে, আপনার গান গাওয়া লাগবে না ঠিকমতো গাড়ি চালান। কিন্তু সে ততক্ষণে ছেলেদের টিমের মেইন ভোকাল ও ক্যাপ্টেন পর্যায়ে চলে গিয়েছে, তাকে থামানো আর সম্ভব নয়, অগত্যা আন্তাকশিরিই থামাতে হলো।







অবশেষে ঐতিহ্যবাহী কান্তনগর মন্দিরে পৌছানোর পর সেকান্দার ভাই আরেকদফা তার জ্ঞান ও সূক্ষ্য বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে বলল, “আফা হেন্দুরা মন্দিরে পূজা করে হেই মন্দির মুসলমানদের জন্যে কোন দেখার বিষয় হইলো! কোনদিন হুনছেন হেন্দুরা মুসলমানদের মসজিদ দেখবার যায়?”

বললাম, ভাইরে পুরা রাস্তা মেলা মাথা খাইছেন, এইবার একটু থামেন। হিন্দুর মন্দির, মুসলমানের মসজিদ এগুলা বাদ দিয়ে পারলে আপনিও ভেতরে এসে দেখেন, আসলেই কি দেখার আছে!

“আমারে কেউ লাখ টাকা দিলেও হেন্দুর মন্দির না দেখি”, বলে সে তার মোবাইলে ধারণকৃত আলিফ লাইলার অংশ বিশেষ দেখা শুরু করলো। করুণা হলো এই চোখ বন্ধ রেখে অন্ধ থাকতে চাওয়া মানুষটার প্রতি!

১৯৬০ সালে কান্তনগর মন্দির সরকার কতৃক সংরক্ষিত প্রাচীন কীর্তি হিসাবে ঘোষণার পরও হীন সাম্প্রদায়িকতার কারণে ঐতিহাসিক নিদর্শন এই মন্দিরটি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান আর্মি ধ্বংসের চেষ্টা চালায়!

ভাবতে চাই -আমারা স্বাধীন সকল গোঁড়ামি ও ভিত্তিহীন সাম্প্রদায়িক মানসিকতা থেকে! ভালোবাসি নিজের দেশ, নিজের ঐতিহ্যকে!

------------------------------------------------------------------------------------------------

No comments:

Post a Comment