Tuesday 28 August 2012

হারিয়ে গিয়েছে চেনা গাছে, চেনা পথ!




ছোট বেলার ঝাপসা স্মৃতি থেকে ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ওঠা মুহূর্তগুলো, আমার বেড়ে উঠার সাক্ষী রাখা সেই ছোট্ট শহর, চিরচেনা পথ-ঘাট, মাঠ-পুকুর, ঝুম বৃষ্টিতে উঠানে দাপাদাপি, গ্রীষ্মে আম খাওয়া ছুটি ও শীতে পিঠা খাওয়া- যদিও কিছুই আর আগের জায়গায় নেই। বদলেছি আমিও, বদলেছে আমার অবস্থান, তবুও স্মৃতির পটে বহু যত্নে এঁকে রাখা সেই মুহুর্তগুলো বদলায় না কখনো, ধুলো জমেনা এর কোনায়, ফিকে হয়ে আসেনা এর কোন রঙ! ছেলেবেলার কথাই বলছি, যখন বাইরের পৃথিবী বলতে আমাদের কাছে ছিলো শুধু গরমের ছুটিতে নানু বাসায় যাওয়া, শীতে্র ছুটিতে দাদু বাসায় যাওয়া। যেকারনে অতি আগ্রহ ও আনন্দের এই ছুটিগুলো আমাদের কাছে ছিলো রীতিমত অমূল্য! ছোট বেলার সরল তীক্ষ্ণ অনুভূতিতে সব কিছুই যেমন বেশী মাত্রায় বড় আর আপন লাগে। তেমনি এই ১২ থেকে ১৪ কিলোর ছোট রাস্তাও তখন আমাদের কাছে ছিলো অনেক বড় এবং তা নিয়ে আমাদের প্রস্তুতিও ছিলো যথারীতি বড়! আর এই পথগুলো ছিলো আমাদের গন্তব্যের মতই অতি আপন। চেনা ছিলো এর প্রতিটি বাঁক, ছোট ছোট দোকান-পাঠ লোকালয়, ফসলের ক্ষেত, আর দুধারে দাঁড়িয়ে থাকা অতি প্রাচীন অভিভাবকের মত বিশাল বিশাল সব গাছ।

ছোট শহরটি থেকে বেরুবার পর থেকে প্রতিটি গাছই যেন আমাদের দেখে আনন্দের অভিবাদন জানাত, আর আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম সেগুলোর দিকে। মুগ্ধ হতাম তাদের বিশালতা দেখে। প্রতিটা গাছই আলাদা করে ঠিক চিনতাম, যেটার ঠিক মাঝে একটা গোল গর্তের মত ছিল সেখানে একদিন একটা কাঠাবেড়ালী উঁকি দিতে দেখেছিলাম, তাই ধরে নিয়েছিলাম গাছটার ভেতর ওই কাঠবেড়লীটার বাসা, কল্পনায় নানা ভাবে তার ঘরদোর দেখে নিতাম। প্রতিবার গাছটা পেরুবার সময় সেই গর্তে উঁকি দিতাম, যদিও আর কখনো কাঠবেড়ালীটার দেখা মেলেনি। আরো দুটো বাঁক পেরিয়ে, পথ থেকে কিছুটা দুরে ছিলো বিশাল এক বটগাছ, যার কাণ্ড আর শাখা আলদা করে চেনা যেতো না। আর গোড়ার দিকে এবড়োখেবড়ো আমগাছটা দেখে আপু বলতো গাছটার ছোট বেলায় বুঝি ঘা হয়েছিলো, তাই ওরকম হয়ে গিয়েছে দেখতে। জোড়া তালগাছে ঝুলে থাকা বাবুই পাখির বাসাগুলো বাতাসে তালপাতার শব্দে কেমন নেচে নেচে দুলতে থাকত, অসংখ্য পাখির কিচির-মিচির শব্দে কানে প্রায় তালা লেগে যেত! খানিক পর পরই আসতো বিশাল বিশাল সেগুন, মেহগনি, শিমুল আরোও নাম না জানা অসংখ্য সব গাছ। শীতকালে লাল শিমুল ফুলে ভরে থাকতো পথ। ছোটমামা বলেছিলো শিমুল গাছে ভুত থাকে, তাই ভয়ে গাছগুলোর দিকে তাকাতাম না। কিন্তু পথে ছড়ানো ফুলগুলো দেখে মন আনন্দে ভরে উঠত, মনে হত আমাদের জন্যেই বুঝি গাছগুলো তার ফুল বিছিয়ে অপেক্ষা করছে। পুরো পথ নিমেষেই শেষ হয়ে আসত বিচিত্র সব গাছে্র ভিন্ন রঙ, রূপ আর ঘ্রাণ চোখ ও মন ভরে দেখতে দেখতে! যেন এখনও চোখ বন্ধ করে ফিরে পাই সে অনুভূতি।

মাঝে অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। জীবনের তাগিদে আমাদের শুধু সামনেই ছুটে চলতে হয়, পেছন ফিরে তাকানোর অবসর খুব কমই মেলে। এবার অনেক দিন পর যাওয়া হয়েছিলো সেই চেনা পথে। কিন্তু হায়! কোথায় আমার ছোট্টবেলার ফেলে আসা সেই স্মৃতিপট! কোথায় আমার কাঠবেড়ালীর বাসাওয়ালা বুড়ো আম গাছটা! কোথায় এবড়োখেবড়ো ঘা-ওআলা গাছটা, কোথায় সেগুন আর শিমুল, কোথায় ফুল, কোথায় গন্ধ! নেই কোনো রঙের ছড়াছড়ি, নেই কোথাও রূপের বৈচিত্র! দুধারে শুধু একঘেয়ে আগাছার মত লকলকিয়ে বেড়ে উঠেছে দীর্ঘকায় ইউক্যালিপটাস-এর জঙ্গল! এ কোন পথ ধরে চলেছি, আমি চিনিনা। আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে! অনেক কষ্টে এই জঙ্গলের ফাঁকে খুঁজতে থাকি, একটু আশা- হয়ত অন্তত একটা চেনা গাছ পাবো, কিন্তু নাহ! কোথাও নেই! মনে পরে গেলো ক্লাস ফাইভে সামাজিক বিজ্ঞানের সালাম স্যারের কথা, "বাংলাদেশ বনায়নের গাছ চুরির নব্য কর্মসূচি চালু হয়েছে, আমাদের সব ভালো ভালো পুরোনো গাছে কেটে সেখানে আগাছা লাগানো হচ্ছে। আগাছা চেনো তো? যা মাটি থেকে অতিরিক্ত পানি ও সার শুষে নিয়ে নিজে দ্রুত বেড়ে ওঠে, ফলে ফসল অর্থাৎ উপকারি গাছগুলোই আর বাড়ার সুযোগ পায়না! অথচ বিনিময়ে আমরা এর থেকে কিছুই পাইনা!" স্যারের আশংকাই সত্যি হয়েছে, অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম কিভাবে ২৫% বনায়ন কর্মসূচী সফল করতে, আগাছায় ভরে ফেলা হচ্ছে পুরো দেশ! অদ্ভুত সে দেশ যেখানে খাবারে অবাধে মেশানো হয় বিষ, পানিতে প্রকাশ্যে ঢেলে দেয়া হয় শিল্প-কারখানার বর্জ্য কেমিক্যাল, বাতাসে কার্বন মনো-অক্সাইড আর মাটিতে লাগানো হয় ক্ষতিকর ইম্পোর্টেড আগাছা!

না, আমি কোনো পরিবেশবাদী বা গাছ বিশারদ নই! দেশে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির আওতায় অন্তর্ভুক্ত কোনো নির্দিষ্ট গাছের গ্রহনযোগ্য পরিসংখ্যান ও উপকারিতা অপকারিতা নিয়ে গবেষণা করার মত যথেষ্ট জ্ঞানী ও সচেতন মানুষ দেশে আছে বলেই আমি মনে করি, এব্যাপারে আমার জ্ঞানের শীমাবদ্ধ স্বীকার করেই বলছি- যেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে বৃক্ষরোপণ দিবস উদযাপন করেন দেশীয় ফলজ গাছ লাগিয়ে, এবং সাধারণ মানুষকেও এসব উপকারী ফলজ গাছ লাগানোর পরামর্শ দেন। সেখানে একটা প্রাপ্তবয়স্ক ফলজ বা পরিবেশ-অনুকূল স্বজাতীয় গাছের শেকড় উপড়ে কেন দশটা বিদেশী আগাছা লাগানো হচ্ছে, এটা বুঝতে আসলেই আমার কষ্ট হয়!

আমাকে শুধু তাড়ায় আমার চেনা গাছগুলোর দীর্ঘশ্বাস! ভাবতে পারিনা কতটা নিরব অভিমান বুকে নিয়ে তাদের চলে যেতে হয়েছিলো! তাদের বাঁচাবার জন্য কোথাও কোনো প্রতিবাদ হয়নি, তাদের শূন্যতা অনুভব করে কারো চোখে নেমে আসেনা দুফোঁটা অশ্রু! অথচ এই স্বার্থপর মানবজাতি এবং পৃথিবী নামক গ্রহটার ঋণ তাদের কাছেই বরং অনেক বেশী ছিলো। কোন মফস্বল শহরের অজপাড়ার পথের কিছু বুড়ো গাছের খোঁজ নাহয় কেউ নাই রাখলো। আমার বিস্ময় আরোও বাড়ে যখন দেখি বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটা হাইওয়েতে শুধু ইউক্যালিপটাসের দৌরাত্ব! শুধু হাইওয়ে নয় একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় কিভাবে গ্রামের মেঠো পথ, স্কুল-কলেজ, পকুর পাড়, ধান ক্ষেত সর্বত্র ভরিয়ে ফেলা হয়েছে এই বিদেশী গাছ দিয়ে। তাহলে কি এসব জায়গা থেকেও অবাধে উপড়ে ফেলা হয়েছে প্রাচীন সব স্বদেশী গাছের শেকড়! বিভিন্ন সাইজের এই গাছ দেখলে সহজে অনুমান করা যায়যে এ প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত রয়েছে।

স্বাভাবিকভাবেই কিছু প্রশ্ন মনে আসে,
ইউক্যালিপটাস বা এই প্রজাতির গাছগুলোর কি এমন মহত্ব ও গুরুত্ব আছে যে কারণে এই এক টাইপ গাছ দিয়ে পুরো বাংলাদেশ ভরে ফেলা হচ্ছে? এটা বাংলাদেশের জলবায়ুর প্রেক্ষিতে এটি একটি উপযুক্ত প্রজাতি কিনা? এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী স্বদেশী গাছগুলো রক্ষা ও বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বনবিভাগের কোন নীতিমালা আছে কিনা, থাকলেও তা কতটা কার্যকর?

(এই প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুর পাক খাচ্ছিলো অনেকদিন। শেষে নিজেই এর উত্তরের আশায় কিছুটা ঘাটাঘাটি করে যা পেলাম, তা আমার মত করে নিচে তুলে ধরলাম। আগেই বলেছি আমি কোন পরিবেশবাদী বা বৃক্ষ গবেষক নই, বাংলাদেশের জলবায়ুর প্রেক্ষিতে ইউক্যালিপটাস বা এই প্রজাতির গাছের উপকারিতা বা অপকারিতার ব্যাপারে তেমন কোন নির্দিষ্ট তথ্য আমি পেলাম না, আশা করছি আপনাদের বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও তথ্যে বিষয়টি আরোও পরিষ্কার হবে।)
যদিও বাংলাদেশে প্রকৃতি ও জলবায়ুতে নির্দিষ্টভাবে ইউক্যালিপটাস এর প্রভাব এখনো অবধি কোন গবেষণার আওতায় আনা হয়নি, শুধু ধরে নেয়া হয় যেহেতু পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এই গাছরোপণ কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলে নাই তাই বাংলাদেশের জলবায়ুতেও অনুরূপভাবে এর প্রভাব একই থাকবে। FAO এর দেয়া তথ্য মতে, মানুষ প্রতি দশ হেক্টর প্রাকিতিক বন উজাড় করে কেবল এক হেক্টর কৃত্রিম বনায়ন করছে, সেক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশ গুলোতে ক্রমবর্ধ্মান জনসংখ্যার খাদ্য, জ্বালানী ও আশ্রয় চাহিদা পুরনে ইউক্যালিপটাসের মত দ্রুত বর্ধ্মান এবং পারিপার্শিকতার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম গাছকে বিকল্প হিসেবে প্রস্তাব করা হয়। অন্যদিকে বৃক্ষরোপণ অভিযানে নোবেল লরিয়েট কেনিয়ার Wangari Maathai এর মতে, শুধু মাত্র বাণিজ্যিক কারনে এই আগন্তুক গাছকে অতিউৎসাহিত করা হয়েছে। তিনি ইউক্যালিপটাসকে 'ওয়াটার ড্রিংকার' এবং অন্য প্রজাতির প্রতি শত্রুভাবাপন্ন একটি ক্ষতিকর গাছ বলে আখ্যায়িত করেন। তার মতে, “When you go into these monoculture plantations, they look like dead forests because it’s only them, you don’t see birds, butterflies, other trees, animals—anything other than them because they don’t allow any other growth.” কেনিয়াতে ইউক্যালিপটাস রোপণ সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে এবং জলাশয় বা নদীর তীরবর্তী অঞ্চল থেকে এই গাছ তুলে ফেলতে সরকারী নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, সাউথ আফ্রিকাতেও এই প্রজাতির গাছগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

মাথাই এর ভাষায়, “God had a reason to put some species somewhere so that we have appropriate habitats for particular parts of the world, so when you bring eucalyptus from Australia, you are killing yourself.” যেমন আফ্রিকার পথে প্রান্তরে সবত্র প্রকাণ্ড ভুতুড়ে বাওবাব গাছগুলো শত শত বছর ধরে নিজের ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। সেখানে বাংলাদেশে সর্বত্র বিভিন্ন সাইজের আগন্তুক এই ইউক্যালিপটাস দেখে মনে হয় যেন এটাই বাংলাদেশের আদি ও একমাত্র গাছ! গেলো বিদেশী গাছের কথা, শেষ করি আমার নিজ দেশের ছোট থেকে দেখে আসা চিরচেনা প্রিয় গাছ আর প্রিয় পথগুলোতে- রূপবৈচিত্রে ভরা এই বাংলাদেশ, যার প্রতিটি ঋতুর সাথে সাথে পথে প্রান্তরে ফুটে উঠে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ও তার গন্ধ। কবির ভাষায়, "পলাশ ঢাকা কোকিল ডাকা আমার এই দেশ ভাইরে" অথবা "পলাশ ফুটেছে শিমুল ফুটেছে এসেছে প্রিয় মাস", কোকিলের ডাক শুনিনা বহুদিন! বাংলাদেশের পথে ঘাটে এখন আর পলাশ-শিমুল ছড়ানো থাকেনা, বটতলিতে বটগাছ নেই যেমনটি কাঁটাবনে কাঁটাগাছ নেই; আমাদের পরের প্রজন্মের কাছে এসব রূপকথার গল্প নয়তোবা শুধুই নাম হয়ে থাকবে!

--------------------------------------------------------------------------

1 comment:

  1. চমৎকার লাগলো।
    অসংখ্য ধন্যবাদ।

    ReplyDelete