ভোরে কুয়াশায় চাদরে ঘুমিয়ে থাকা পাহাড়গুলো, যেন অদ্ভুত ধোঁয়াটে রহস্যময়তায় ঢেকে রাখতে চায় পুরো জগৎ!
এরপর একটু একটু করে ছড়িয়ে পরে সকালের নরম আলো বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠে, আনন্দে 
ঝলমলিয়ে উঠে ঘাসের ডগায় ক্রিস্টালের মত জমে থাকা তুষার বিন্দুগুলো!
সকালের আলোর সাথে সাথে; দুর কোন ফার্মের ডেন থেকে বেড়িয়ে আসে ভেড়ার পাল। অফুরন্ত কচি ঘাসের মাঝে আয়েশে চড়ে বেড়াবে তারা দিনভর।
স্কটল্যান্ড। বৃটিশ অঙ্গরাজ্য এই দেশটির নামের সাথে কেন জানি আমার মনে 
উঠে আসে সেই তের শতাব্দীর স্কটল্যান্ড এর প্রকৃত কিংবদন্তি, প্রবল 
দৃঢ়চিত্তের পুরুষ উইলিয়াম ওয়ালেসের ছবি। যাকে বলা হত 'গার্ডিয়ান অফ 
স্কটল্যান্ড'।

সাত ফুট উচ্চতা, সুগঠিত শরীর ও শক্ত পেশীর একজন প্রকৃত হিরো উইলিয়াম 
ওয়ালেস। যদিও তার মনের শক্তি ছিলো পেশীর শক্তির চেয়ে হাজারো গুন বেশী!
উইলিয়াম ওয়ালেস, স্কটল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং স্কটিশ ফ্লুট এর 
মন উদাস করা সুর, এগুলোর সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় মেল গিবসনের সাবলিলভাবে 
অভিনীত এবং পরিচালিত মুভি 'ব্রেভ হার্ট' এর মাধ্যমে। যেখানে দেখানো হয় 
স্কটিশদের উপর ইংরেজদের চালানো পাশবিকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাবা ও ভাইয়ের 
মৃত্যু্র পর ছোট্ট ওয়ালেসকে তার এক চাচা এসে সেখান থেকে নিয়ে যায়। বড় হয়ে 
সে ফিরে আসে নিজ মাতৃভূমিতে। দেখা হয় ছোট বেলার ফেলে যাওয়া বন্ধু ম্যারনের 
সাথে, সেই পুরনো ভালোলাগার সাথে যুক্ত হয় নতুন অনুভূতি ভালোবাসা, কিন্তু 
তাদের এই নির্মল স্বাভাবিক অনুভূতিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তথাকথিত ইংলিশ শাসন 
ব্যবস্থা, যেখানে প্রচলিত ইংলিশ আইন অনুযায়ী নববিবাহিত স্কটিশ মেয়েদের 
ব্রিটিশ লর্ডের বিছানায় প্রথম রাত কাটাতে হবে। উপায়ান্তর না দেখে তারা 
লুকিয়ে বিয়ে করে, যদিও দ্রুতই ম্যারন ইংলিশ সৈন্যদের কুনজরে পড়ে, 
প্রিয়তমাকে সৈন্যর লালসা থেকে রক্ষা করতে ছুটে আসে ওয়ালেস, অস্ত্র ছাড়া 
একাই ঠেকাতে থাকে তাদের, ম্যারনকে পালিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় যেতে বলে। 
কিন্তু পালাতে পারেনা ম্যারন, ইংরেজদের ধূর্ততার সাথে পেরে উঠেনা নিরপরাধ 
মেয়েটি, বিচারের নামে ‘রাজার সৈন্যের অবমাননার রাজার অবমাননারই সামিল’ এই 
অজুহাতে ম্যারনকে নিজ গ্রামই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়! ওয়ালেস ইংরেজদের বিরুদ্ধে
 বিদ্রোহ ঘোষণা করে। যা ছড়িয়ে পড়তে থাকে সাধারন মানুষের মধ্যে, গড়ে উঠে 
ওয়ালেস এর নিজস্ব সৈন্যবাহিনী। এভাবেই নানা ঘটনা ও ওয়ালেসের একাগ্রতায় ভীত ও
 নড়বড়ে হয়ে পড়তে থাকে ইংরেজ শাসকের ভিত। নানাভাবে তাকে অনুগত করার 
চক্রান্তে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে জনসম্মুখে অসহনীয় নির্যাতনের মাধ্যমে 
মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় তার। তৎকালীন রাজদ্রোহীদের শাস্তি হিসেবে যে মৃত্যুদণ্ড
 দেয়া হত তা কোন সাধারন উপায়ে দণ্ডিত মৃত্যু নয়। ডিস-এমবোয়েলমেন্ট দ্বারা 
তাকে যখন নারকীয় যন্ত্রনা দেয়া হচ্ছিলো, তখন উপস্থিত জনতার মধ্যে থেকে আকুল
 হয়ে ওয়লেস এর জন্য দয়া ভিক্ষা চাওয়া হয়। তাকে শেষবারের মত সুযোগ দেয়া হয় 
ইংরেজ শাসনের কাছে নতিস্বীকার ও দয়া ভিক্ষার জন্য, পরিবর্তে তাকে দেয়া হবে 
অধিকতর সহজ মৃত্যু এবং জবাবে মনে পড়ে মেল গিবসনের সেই পর্দা কাঁপানো, 
প্রতিটি রোম কোষ জাগানো আওয়াজ - "ফ্রিইডম"!
বার বার পরাজিত এবং ইংরেজদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে আত্নগোপনকালে, মাকড়শার জাল
 বোনা দেখে অধ্যবসায়ি হবার শিক্ষা গ্রহনকারী রবার্ট ব্রুসের গল্প তো সবার 
জানা। নীতিগত কারনে ব্রুস ওয়ালেস কে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সহায়তা করে
 এবং ওয়ালেস এর মৃত্যুর পর 'গার্ডিয়ান অফ স্কটল্যান্ড' এ পরিণত হয় ! 
পরবর্তিতে সে সফল স্কটিশ গেরিলা আক্রমন দ্বারা এই ভূমি থেকে রাজা দিত্বীয় 
এডওয়ার্ড এর অধীন বৃহৎ ইংলিশ সৈন্য হটিয়ে, পুনরায় স্কটিশদের রাজত্ব স্থাপন 
করতে সক্ষম হয়।

এডিনবরা ক্যাসেল।
প্রাচীন কোন অগ্ন্যূৎপাত দ্বারা উদগীর্ণ শিলা খণ্ড, নাম বিখ্যাত এডিনবরা
 রক। এই এডিনবরা রক এর উপরই অসীম দম্ভের সাথে হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে 
ঐতিহাসিক এ ক্যাসেলটি দাড়িয়ে আছে। যার নামেই নামকরন করা হয়েছিলো 
স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরার। নগরীর সর্বাধিক প্রাধান্য বিস্তারকারী 
অতুলনীয় এই ক্যাসেলটি বছরে এক মিলিয়নেরও বেশী ভ্রমনকারী পরিদর্শন করেন, যা 
লন্ডন টাওয়ার বাদ দিলে নিসন্দেহে যুক্তরাজ্যের সর্বাধিক প্রদর্শিত প্রাচীন 
স্থাপনা।

কেলভিনগ্রোভ আর্ট গ্যালারী মিউজিয়াম, গ্লাসগো।
স্কটল্যান্ডের ভ্রমন আকর্ষণগুলোর মধ্যে দিত্বীয় স্থানে আছে কেলভিনগ্রোভ 
আর্ট গ্যালারী মিউজিয়ামটি, যেখানে মুহূর্তে হারিয়ে যাওয়া যায় স্কটিশ 
প্রাচীন জীবনধারায় - সেখানকার নাগরিক পুরাতত্ত্ব থেকে প্রকৃতির রাজ্য, 
পার্ল ফিশিং থেকে রবার্ট ব্রুস সব কিছুই যেন কল্পনায় জীবন্ত হয়ে উঠে। 
মিউজিয়ামটিতে সুসজ্জিত রয়েছে প্রাণীজগতের নানা প্রজাতির সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে
 ছোট প্রাণীটির স্টাফ ও প্রাচীন ফসিল কালেকশন, জাঁকালো সব আর্ট কালেকশন, 
পৃথিবীর অন্যতম মধ্যযুগীয় অস্ত্রসস্ত্র কালেকশন ইত্যাদি। বছরে দশ লক্ষ-এরও 
বেশী দর্শনার্থী সমাগিত এই স্থানটি লন্ডনের বাইরে যুক্তরাজ্যের সর্বাধিক 
পরিদর্শিত একটি মিউজিয়াম।

প্রাচিন নগরী এডিনবরা।
রাজধানী এডিনবরা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী এবং ইউরোপের প্রধানতম 
অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলোর একটি। আঠারো শতাব্দীতে স্কটিশ আলোকউজ্জল অধ্যায়ে 
এডিনবরা কেন্দ্রিয় ভুমিকা পালন করে। যা স্কটলান্ডকে ইউরোপের বাণিজ্যিক, 
বুদ্ধিবিত্তিক ও শিল্পভিত্তিক ‘পাওয়ার হাউজে’ পরিণত করে।
গ্লাসগো সিটি চেম্বার। স্কটলান্ডের বৃহত্তম নগরী গ্লাসগো। এবং পৃথিবীর অন্যতম বানিজ্যিক শহর গুলোর একটি।

সিনে প্লেক্স। পৃথিবীর উচ্চতম সিনেমাহল!

উচ্চতা পরিমাপের চেষ্টায়।

গ্লাসগোর পথে।

আর্থার'স সিট, এডিনবরা।
এডিনবরা শহরের ঠিক মাঝখানে এক গুচ্ছ পাহাড়ের শিখর হলো এই আর্থার’স সিট। 
যেখান থেকে শহরের চমৎকার এক প্যানারোমিক ভিউ ফুটে উঠে। সন্ধ্যা হয়ে আসায় 
ছবিটা ঠিক মন মত হয় নাই।

ফোর্থ রোড ব্রিজ। দেশটির চার প্রান্ত থেকে ছুটে আসা চারটি পথের সংযোগ পারাপার এই ব্রিজটি।

ফলকার্ক হুইল, ফলকার্ক, স্কটল্যান্ড।
পৃথিবীর প্রথম এবং একমাত্র ঘুর্নায়মান বোর্ট এলিভেটর। যা 'ফোর্থ অ্যান্ড
 ক্লাইড ক্যানেল' ও 'ইউনিয়ন ক্যানেল' নামে দুটো বিশাল খা্লের মধ্যে সংযোগ 
স্থাপন করছে, প্রকৃতির গতিকে বাধাগ্রস্ত না করে। এই ক্যানেলগুলো একটি থেকে 
আরেকটি ৩৫ মিটার উপরে অবস্থিত। মধ্য স্কটল্যান্ডের প্রান চাঞ্চল্য ফিরিয়ে 
আনতে এই ক্যানেল দুটোকে সংযুক্ত করা জরুরি হয়ে পড়ে যার ফলাফল আজকের এই 
‘ফলকার্ক হুইল’। আর্কিটেকচারাল, মেকানিক্যাল সাইন্স মোদ্দা কথা টেকনোলজির 
এক আশ্চর্য নিদর্শন স্কটল্যান্ডের এই ফলকার্ক হুইল। একটু কল্পনা, মাটি থেকে
 ৩৫ মিটার উপরে নৌকো চেপে শূন্যে ভাসতে ভাসতে; চারপাশের মনোরম প্রকৃতি 
দুচোখ ভরে দেখা যেন অনেকটা ছোটবেলার ময়ূরপংখীর সাধ পূরন হবার মত!

শিশুদের কিছু আনন্দ দেখে প্রায়ই একটা কথা মনে হয়, আহা! আমি কেন শিশু হলাম না!

লক লমন্ড, বামাহা, স্কটলান্ড।
লেক কে স্কটিশ ভাষায় বলা হয় 'লক'। অথ্যাৎ এখানে 'লক লমন্ড' বলতে 'লেক 
লমন্ড' বোঝানো হচ্ছে, অথবা 'লমন্ড লেক' এভাবেও বলা যায়। তা নামটা যেভাবেই 
বলিনা কেন, কবির ভাষায় বললে- প্রকৃতির অকৃতিম মায়াময়তা, প্রতিটি কণা উজাড় 
করে ঢেলে রাখা শুধু মুগ্ধতা; লোকালয়-কোলাহল থেকে কয়েক ক্রোশ দূরে, 
স্নিগ্ধ-স্থির, ছোট ছোট দ্বীপ ও সবুজ পাহাড় ঘেরা স্বচ্ছ জলরাশি, এতোটাই 
স্বচ্ছ যেন প্রেমিকার চোখে জমে থাকা ভালবাসা!
লক লমন্ডের প্রধান আকর্ষন হচ্ছে, বোটিং। ছোট ছোট নৌকা নিয়ে এই আবাধ 
প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়া, আর একটু দুরে হাতছানি দিয়ে ডাকছে যে 
দ্বীপগুলো, কাছে গিয়ে তাদের ছুঁয়ে দেয়া! বোটিং শেষে কিছুটা সময় দেয়া যায় 
এখানকার ইকো পার্কটিতে, এছাড়াও একটু কষ্ট করে পাহাড়ে উঠে স্বর্গের জানালায় 
অন্তত একবার উঁকি না দিলে শুধুই আফসোস!
এ অঞ্চলে লেকের এর প্রসঙ্গে যখন আসাই হলো, তখন বলে নেই আমরা আসলে ‘লক 
লমন্ডে’ গিয়েছিলাম ভুল করে। আমাদের যাওয়ার কথা ছিলো 'লক নেস' লেকে 'নেসি' 
নামে এক বহুল আলোচিত মনস্টারের খোঁজে। '
লক নেস মনস্টার'
 এর গল্পটা যদিও অনেক প্রাচীন। ষষ্ঠ শতাব্দীতে একজন ধর্মযাজকের লেখায় প্রথম
 এই দানব সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। এরপর নানা জন নানা ভাবে এই লেক এবং তার
 আশেপাশে অঞ্চলে নেসিকে দেখে থাকলেও, তাকে প্রথম ক্যামেরাবন্দি করা সম্ভব 
হয় ১৯৩৩ সালে। তবে তার কিছুটা স্পষ্ট অবয়ব ফুটে উঠে ১৯৩৪ এর দিকে ড. উইলসন 
এর বিখ্যাত শট 'সার্জন'স ফটোগ্রাফ' এ। যেখানে এই ‘চার ফুট উঁচু, ২৫ ফুট 
লম্বা, হাতির শুঁড়ের মত ক্রমে সরু গলা ওয়ালা দানব’-টাকে (যারা দেখেছে বলে 
দ্বাবি করে তাদের ভাষায়) দেখে আমি রীতিমত সাপ খুড়তে গিয়ে কেঁচো পাওয়ার মতই 
হতাশ হই! এটাকে আমার কাছে একটা পাতিহাঁস বা খুব বেশী হলে রাজহাঁসের ঝাপসা 
ছবি ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। অথচ তারপরেও এই তথাকথিত অদ্ভুত দর্শন 
প্রাণীটির চাক্ষুষ দর্শকের দ্বাবীদার দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। কল্পশিল্পীরা 
মনের মাধুরি মিশিয়ে এই মনস্টারের ছবি আঁকছে, যেখানে দেখা যায় বিশাল 
ডাইনোসরের মত শরীর আর হাতির শুঁড়ের মত গলা, মুখের দিকে খানিকটা রাজহাঁসের 
মত টাইপ এক জন্তু ‘লক নেস’ এর ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! কেউ আবার দুই
 ডিগ্রি বেশি মাথা খাটিয়ে একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা 
করেছে এভাবে, এটা 
Plesiosauria এবং সীল মাছের সঙ্গমে উদ্ভূত কোন হাইব্রিড প্রাণী। অথচ যেখানে গবেষকরা 
পুরো লেক কয়েকদফা ছেনেও এই কল্পিত বাবাজীর লেজটিও খুজে বের করতে সক্ষম 
হয়নি, এবং শেষে বিষয়টিকে ‘মডার্ন মিথ’ বলে ক্ষান্ত দিয়ে বোধহয় ‘Occum's 
Razor’ দর্শন বেছে নিয়েছেন। দর্শনটা হলো, "যখন কোন বিষয় নিয়ে একাধিক 
হাইপোথিসিস চলে আসে, তখন তাদের মধ্যে যেটা সবচেয়ে কম অনুমানভিত্তিক, সেটা 
গ্রহন করাই যুক্তিযুক্ত" (খুব সাধারণ হলেও বহুল কার্যকরি এক দর্শন)। কিন্তু
 এই অসামান্য মনস্টার নিয়ে এত বেশি হাইপোথিসিস তৈরি হয়েছে যে, Occum 
সাহেবের Rajor পদ্ধতিও নিত্য হিমশিম খাচ্ছে সন্দেহ নাই! আমিও 'এলিয়েন 
অটোপসি', 'তুংগুশকার বিস্ফোরনের' মত 'লক নেস মনস্টার'কেও আপাতত এক্স-ফাইলেই তুলে রাখি।
--------------------------------------------------------------------------------------------