Wednesday 11 June 2014

এঞ্জেলিনা

অফিসে এসে অভ্যেস মতো রোজকের মেইলগুলো চেক করছিলাম। আনসোর্টেড লিস্টে একটি নামে হোঁচট খেলাম। গট আ মেইল ফ্রম এঞ্জেলিনা গোমেজ। গির্জার ঘন্টার মতো থেকে থেকে নামটা মাথায় বাজতে থাকলো। ধেয়ে আসা ঢেউয়ের সামনে দাঁড়াতে যতটুকু শক্তি প্রয়োজন তার শূন্য দশমিক দশ ভাগেরও কম নিয়ে আমি ওর মুখোমুখি হলাম। জানতে চেয়েছে - আমাকে মনে আছে তোমার? জেনে খুশি হবে আমার মেয়ে তোমার ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। আমি জানতাম আমার ছেলে-মেয়েরা তোমার মত বড় মানুষ হবে! এটা আমার জন্যে কত গর্বের ভাবতে পারো! ... চোখের সামনের অক্ষরগুলো অচেনা মনে হয়। যেন দূরে থেকে ভেসে আসা চলন্ত কোনো ট্রেনের একঘেয়ে ঝিকঝিক শব্দের সাথে মিশে হারিয়ে যাচ্ছে। আমি অজান্তে কাঁপতে থাকি। নাহ! ভুল নয়, সত্যি এঞ্জেলিনা।

স্রোতের অবিরাম ধারায় কতগুলো বছর পার হয়ে গেছে গুণে তো দেখা হয়নি। আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজের কাঁচাপাকা চুলদাড়ি মাখানো চেহারাটাও অদ্ভুত লাগে। আমি তো নাকি অন্য কেউ, দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগি! যাক, অন্তত সে থেমে থাকেনি। আমি খুশি হই। মেয়েটা দেখতে কেমন হবে, ভাবতে থাকি। কিছু ছোঁয়া তো থাকবে মায়ের।

বেড়ালছানা বাঁচাতে হাঁটু সমান নর্দমার পঁচা কাদা-পানিতে যে মেয়েটি নির্দ্বিধায় নামতে পারে, তাকে কি কেউ ভুলতে পারে! - দ্রুত হাতে টাইপ করতে লাগলাম কথাগুলো... তোমার মেয়েকে আমার শুভেচ্ছা জানিয়ো। আর ওকে বলো যেকোন প্রয়োজনে সে আমাকে পাশে পাবে, সবসময়। এটুকুই, মেসেজ হ্যাজ বিন সেন্ট।

এঞ্জেলিনার সাথে প্রথম দেখা, দিনটি মনে আছে স্পষ্ট।

সেদিন ঘাম দিয়ে জ্বর নামার মত করে এস এস সি'র ভুত নেমেছিল মাথা থেকে। ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে বসে পত্রিকায় কিছু একটা পড়ছিলাম। রান্নার রেসিপি। উচ্ছে দিয়ে কই মাছ। যদিও মাছে আমার তেমন রুচি নাই। তবুও এই অনাবশ্যক আগ্রহের কারণ হলো - সেদিন ছিল ছুটির দিন। সকাল থেকে আধবেলা অবধি পেপারটাও ছিল বাবার দখলে। দেন-দরবার শেষে যতক্ষণে সেটা হাতে পাই, ততক্ষণে কাগজটার মত খবরগুলোও বাসি হয়ে গেছে। তবুও যে কোন মুহূর্তে হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে, এই আশংকায় জোর করে এটার উপর নিজের আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা।

ডোরবেল বাজছিল। একবার। দুইবার। তিনবার... নাহ! এই বাসায় সাত সকালে নিউজপেপারের মত আলতো ঝুপ শব্দে ট্রয়ের সৈন্যের মতো যেখানে যে থাকে ছুটে এসে ঝাঁপায়ে পড়ে, দখল নিতে। অথচ ডোরবেলের কর্কশ আওয়াজে সবাই নির্লিপ্ত, তখন আর কেউ কানে শুনে না।

'লোঠাশ! এই লোঠাশ!!' লোকমান ছোট চাচার নাম হওয়ায় রাজশাহী থেকে আসা কাজের ছেলেটার নাম লোকমান বদলায়ে রাখা হয়েছিল 'লোটাস'। একই বাড়িতে দুই লোকমানের বিপত্তি এড়াতে। ছোট চাচা আমাদের আইডল, তিনি একজন প্রকৃত দার্শনিক গোত্রের মানুষ। যেহেতু তিনি লোটাস কে 'লোঠাঅ্যাশশ' বলে, তাই আমাদেরও একই ডাক।

'ভাইজান আবার ঠাশ ঠাশ শুরু কুরছেন ক্যান!' - লোটাসের ভাবসাব ছিল নবাবের মত।

'জ্বী, শুদ্ধি করে ডাকলে তো আপনারে পাওয়া যায় না, তাই। কখন থেকে বেল বাজছে, কানে যায় না!'

'তা, আপনার কানে তো যায়, দরজাটা খুলে দেন!'  কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নবাব তার অতি প্রিয় জায়গা রান্নাঘরের চিপায় চলে যায়।

টেটনা, বেয়াদ্দপ, অতি আস্কারায় মাথায় উঠছে - গজ গজ করতে করতে করতে দরজা খুললাম। একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জানতে চাইলাম - 'কি চাই?' লোটাসের উপর গজরানোর রেশটা ছিলই বোধহয়, হু কেয়ারস!

'ইয়ে, মানে...' মেয়েটা আমতা আমতা করতে লাগলো। 'বাসায় তোমার আব্বু আম্মু কেউ নাই?'

'আমি আছি। আমাকেই বলেন?' একে তো আমাকে তুমি বলছে, তার উপর মুরুব্বীয়ানা দেখায়ে বলছে যে আব্বু আম্মুর দরকার।

'আসলে এই গলির শেষে ফাঁকা যে মাঠটা আছে, সেখানে একটু আগে কেউ একজন এক রিক্সাওয়ালাকে মেরে তার কাছে যা কিছু ছিল কেড়ে নিয়েছে। বেচারা গরীব মানুষ, এখন কাঁদছে। জিগ্যেস করায় বলল, ওর কাছে পাঁচশ মত টাকা ছিল। ছেলের কোচিং এর জন্য জমানো। আমি চেষ্টা করছি আশেপাশের বাড়িগুলো থেকে সেই টাকাটা তুলে দিতে।'

আমাদের পাড়াটার পাশে আটকে পড়া পাকিস্তানীদের একটা কলোনি আছে। আমরা বলি বিহারীপট্টি। এসব ঘটনা ছিল সেখানকার প্রতিদিনের। জুবায়ের নামে এক উঠতি গুন্ডার দল এসব নানারকম ত্যাঁদড়ামি করে বেড়াত। সবাই জানলেও, ভয়ে কেউ কিছু বলার সাহস পেত না। আমাকে চুপ দেখে সে জানতে চেয়েছিল - 'তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে?'

বেশ বুঝছিলাম, লোটাসের কারণে তাতায়ে ওঠা রোদটার উপর হালকা মেঘের ছায়া এসে পড়তে শুরু করেছে। তাকালাম মেয়েটার দিকে। মাসুদরানার সোহানার স্বপ্নে বিভোর এক কিশোর আমি। জুলফি কানের লতি ছাড়িয়ে গালে এসে ঠেকেছে, আর গলার স্বরেও পিউবারটি লেবেল পার হওয়া পুরুষালি দরাজ টোন। অন্যদিকে এঞ্জেলিনা ছোট-খাটো, চাপা রঙের অতিরিক্ত লিকলিকে একটি মেয়ে। সোহানার পাশে একবারেই বেমানান। তবে ওর ভেতরে কি জানি, কি একটা ছিল - গর্ব, শক্তি না আত্নবিশ্বাস কে জানে! যা কোন অদ্ভুত ব্যক্তিত্বের আভা ছড়াচ্ছিল ওর চোখ দিয়ে। আজ অব্দি কোন মেয়ের ভেতরে আমি তা দেখি নাই। তাই জীবনে প্রথম কোন মেয়ের প্রতি ক্রাশ খাওয়াতে আমি বলতে গেলে আজো গর্বিত।

পাড়ায় জুবায়ের গ্রুপের তাণ্ডব দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিল। বাড়ছিল এঞ্জেলিনার সাথে আমার বন্ধুত্বও। মাঝে মাঝে ওদের বাসায়ও যাওয়া হতো, এঞ্জেলিনার মা আমাকে বিশেষ পছন্দ করা শুরু করে। ভালো ছাত্র হওয়ায় এই একটা বাড়তি সুবিধা আমি পেয়ে আসছি সবসময়। এঞ্জেলিনা প্রায়ই ঠাট্টা করে বলত তোমার রেজাল্ট ওরকমন বেখাপ্পারকম ভালো না হলে, মা তোমাকে বাড়ির ধারেও ঘেঁষতে দিত না। আর বন্ধুরা বলা শুরু করল, জামাই আদর। বলা বাহুল্য, কোনটাতেই আমার তেমন আপত্তি ছিল না।

এঞ্জেলিনার মার ওকে নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ ছিলো না, প্রায়ই বলত আমার মেয়েটা জানি কেমন। আর দশটা মেয়ের মত না। কখনো রাস্তা থেকে বাদাম-বুটওয়ালা, টোকাই, বস্তির ছেলে মেয়ে ধরে এনে নিজের সোয়েটার জামা দিয়ে দেয়। তো কখনো বাসার চালডাল, এটাসেটা চুরি করে ব্যাগ ভরে নিয়ে কোথাও বিলিয়ে দিয়ে আসে। এঞ্জেলিনা মা-কে থামিয়ে দিয়ে বলে - 'তুমি থামবে! শুধু শুধু এতো সোয়েটার, জামা-কাপড় আলমারিতে ফেলে রাখার তো কোনো মানে হয় না!'

জুবায়ের এঞ্জেলিনার পাশের বাড়ির এক মেয়েকে উত্যক্ত করে আসছিল অনেকদিন, অবস্থা এতই ভয়ানক পর্যায়ে যায় যে মেয়েটির কলেজ যাওয়া পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়।

এঞ্জেলিনা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে, 'বদমাইশটাকে কেউ কিছু বলে না কেন, আমার অবাক লাগে!'

আমি ওর কথা শুনেও না শোনার ভান করি।

'চলো, ওকে একটা শিক্ষা দেই!' ওর চোখ চক চক করে ওঠে।

'পাগল! হাড়গোড় একটাও আস্ত থাকবে না।'

'তুমি এতো ভিতু কেন!' এঞ্জেলিনার স্বরে স্পষ্ট বিদ্রূপ। বলতে দ্বিধা নেই সেদিন ছেলে হওয়ায় ওর কাছে আমার মেল ইগো কিছুটা হার্ট হয়েছিল।

পরদিন খুব ভোরে এসে পাগলের মত বেল চাপছিল, আম্মার চোখের স্পষ্ট বিরক্তি উপেক্ষা করে সে আমাকে প্রায় টেনে নিয়ে বলল - 'গট এন আইডিয়া!'

ওর আইডিয়া শুনে আমার হাত-পা জমে যায়, 'নো ওয়ে... টু মাচ রিস্কি'।

 'ট্রাষ্ট মি, নো রিস্ক নো গেইন!'

বুঝলাম উপায় নেই। বড় কারো হেল্প লাগবে। ছোট চাচা দার্শনিক মানুষ। সব খুলে বললাম তাকে। তিনি আমাদের সবরকম হেল্প করার প্রতিশ্রুতি দিলেন, সাথে থাকলো লোটাস। রাত বারোটার মধ্য দেড়শ পোস্টারে এঞ্জেলিনার দেয়া কথাগুলো প্রিন্ট করা হলো। আমার আর লোটাসের উপর দায়িত্ব পড়ল, একরাতের মধ্যে থানার সামনে, ডিসি অফিসের সামনেসহ আমাদের পুরো মহল্লায় যতটা পারা যায় নিশ্চুপে পোস্টার লাগানোর। লোটাস কে চরম আনন্দিত লাগে, যেন এতো মজার কাজ সে জীবনেও করেনি। আর আমি, প্রেমিকার কথায় কেউ কখনো জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিতে ঝাঁপ দিয়েছে কিনা জানি না, আমার অবস্থা ছিল ভিসুভিয়াসের জ্বালামুখে ঝাঁপ দেয়ার চেয়েও ভয়াবহ। নির্ধারিত সময় আমি আর লোটাস বের হই। ভাগ্যে, অন্যদিনের মতই পাড়ার ল্যাম্পপোস্টের একটা বাতিও সেদিন জ্বলছিল না। প্রথম পোস্টারটা লাগানোর ঠিক আগ মুহূর্তে কেউ আমার পাশে এসে দাঁড়ায়, আমি ভয়ে একটা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হওয়ার আগেই, এঞ্জেলিনা আমার হাত খাঁমচে ধরে কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিসিয়ে বলে - 'ভয় পেয়ো না, আমি'। আমি ভয় পাই না। এঞ্জেলিনার দুঃসাহসিকতা আমাকে অভয় দেয়। পরে অবশ্য ছোট চাচাও স্বীকার করেছিল, এঞ্জেলিনার মত সাহসী মেয়ে সে আর দেখে নাই! পরদিন ঈদের আমেজে দলে দলে লোক জুবিয়ারের কীর্তিকলাপ পড়ে আমাদের লাগানো পোষ্টার থেকে, ছেলে-বুড়ো সবার মুখে সেদিন এক কথা, জুবিয়ার। কোত্থেকে খবর পেয়ে পত্রিকা অফিস থেকে লোক আসে, মিথ্যা ভয়ের বেড়ি ছিড়ে অনেকেই সেদিন জুবায়েরের বিরুদ্ধে মুখ খোলে। পোষ্টারের ছবিসহ মাস্তান জুবায়েরের ত্রাসের খবর ফলাও করে ছাপানো হয় প্রথম পাতায়। আমি, এঞ্জেলিনা, লোটাস ও ছোট চাচা এমন ভাব করি যেন আমরা এর বিন্দু-বিসর্গও জানি না। ওর আইডিয়া কাজে লেগেছিল, জুবিয়ার ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের পুলিশ কোমরে দড়ি বেন্ধে পুরো মহল্লা ঘুরিয়ে হাজত নিয়ে যায়।

এঞ্জেলিনা। যে আমাকে শিখিয়েছিল অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। অন্তত নিজের কাছে মাথা তুলে দাঁড়াতে।

ওকে আমি অফিসিয়ালি প্রপোজ করেছিলাম, ইউনিভারসিটি পড়ার সময়। বন্ধুদের পীড়াপীড়ি, আর আশেপাশের নানা তরুণ জুটি দেখতে দেখতে আমার ভেতরের আবেগকে আর ধামাচাপা দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। ছোট চাচাকে জিগ্যেস করেছিলাম - 'আমি যদি কোনো খৃষ্টান মেয়েকে বিয়ে করি?'

'ভালোবাসার সামনে কোন ঈশ্বরের ঘাড়ে কটা মাথা আছে রে!' - ছোট চাচা জবাব দিয়েছিল।

তখনো বুঝি নাই এই ঈশ্বরই তার ছেলে-মেয়ে সমেত হাজির হবে, আমার আর এঞ্জেলিনার মাঝে। আমার প্রস্তাবের জবাব আমাকে দিয়েছিল সে প্রায় সাতদিন পর, অনেক ভেবেচিন্তে, এঞ্জেলিনা আমাকে জানায় - সে তার জীবন উৎসর্গ করতে চায় প্রভুর সন্তানদের সেবায়।

আমি অস্থির হয়ে বলেছিলাম - 'তুমি করো না, কে তোমাকে না করছে, যত চাও প্রভুর সন্তানের সেবা করো! শুধু আমাকে ফিরিও না!'

'আমার জীবনে এমন আত্নসুখের কোনো স্থান নেই, যা অন্যের কাজে আসে না। আমাকে ক্ষমা করো। ' - সে অবিচল, তার স্বর একটুও কাঁপে না, চোখ স্থির।

একটু থেমে, যেন নিজেকে আশ্বস্ত করছে এমন স্বরে বলে - 'তবে তুমি ভেবো না। নিজেকে আমি কখনো ঠকাই না।'

তার বলা কথাগুলোর মর্ম উপলব্ধির ক্ষমতা আমার তখন ছিল না, এখনো নেই। কেন জানি নিজেকে চরম প্রতারিত বলে মনে হয়। অক্ষম আবেগ বয়ে বেড়ানোর কোন মানে হয় না। দেশ ছাড়ি, ছাড়ি আপনজন, সবকিছু। এঞ্জেলিনাও আমার সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখে না। এতদিন পর সেই এঞ্জেলিনা।

দিনকালের হিসেব আমি কখনোই রাখতে পারি না, গুলিয়ে যায়। আমার সামনে বসে আছে, মারিয়ামা জোওলা। এসেছে এক চিলড্রেন অরফানেজ থেকে। অনেক আগে লাইব্রেরিয়ার গৃহ যুদ্ধে যখন স্বজাতির হাতে ওর বাবা মা খুন হয়। তখন তার দু'শ গজের ভেতর এক কাসাবার ঝোপে সে অচেতন পড়ে ছিল। এসব কিছুই তার কাছে ঝাপসা অতীত। আজ 'মা' শব্দটির সাথে তার ভেতরে যে উজ্জল মমতাময়ী মুখটি ভেসে ওঠে, সে মাদার এঞ্জেলিনা।

তাদের আত্না বাস করে ভবিষ্যতের ঘরে

একটু একটু করে সে বড় হয়ে গেছে অনেকটা। আলাদা বিছানায় শোয়, সেও অনেকদিন। নিজ হাতে খায়, খেয়ে প্লেটটাও ধুয়ে রাখে। কখনও কখনও আমার আর বাবারটাও ধোয়ার জন্যে জিদ করে। টয়লেট করে নিজেই পরিষ্কার হয়। ওকে বলে দিয়েছি - 'nobody is allowed to touch ur private body parts, not even me or baba.'

এইতো সে'দিনও কোলে নিতাম কত! জ্বর, কাশিতে প্রায়ই কষ্ট পেত, তখন কোলে নিয়ে এঘর ওঘর হাঁটতাম, খেলনা গাড়িগুলোর কাছে নিয়ে যেতাম। অথচ এখন চাইলেও শখ করে আর কোলে নিতে পারি না। এখন আস্ত গাড়ির চেয়ে খুচরো পার্টসে তার আগ্রহ বেশি। কোন প্লেনের প্রোপেলার, কোন গাড়ির মোটর আর কোন খেলনার ব্যাটারি খুলে নিয়ে সে নিজের ইচ্ছামাফিক চলন্ত আজব আজব জিনিস বানায়, আমরা টেরও পাই না। আসলেই কি সে বড় হয়ে গেল! - এই সরু সরু হাত-পা ওয়ালা ঢ্যাঙা লম্বা হয়ে ওঠা ছেলেটা যে আমার কাঁধ ছুঁই ছুঁই করছে, সে তো আর টোপা, টোপা গালের নাদুসনুদুস সেই গুল্লু বাবুটা নেই! যাকে দেখলেই গাল টিপে আদর করতে ইচ্ছে করতো। এখন অন্য কারো সামনে আদর করলে সে লজ্জা পায়। ইশারায় বুঝায়, কামওন মা গ্রো আপ, লোকজনের সামনে এসব করা যাবে না। মন খারাপ করলে কানের কাছে মুখ এনে বলে - 'পরে, পরে'। মরিয়ামা যদি কখনো ভুল করে বেবি ডেকে ফেলে, সাথে সাথেই প্রতিবাদ, I'm not a baby, I'm a boy! মারিয়ামাও ভুল স্বীকার করে বলে, okay, okay, u're big boy। আমাদের বিগ বয় এখন বিগ ব্রাদার।

ছোট আরেকজন এসেছে বলেই হয়তো এরকম হুট করে বড় হয়ে গেল সে। বোনটার জন্য ছাড় দিতে দিতে - মায়ের কোল, আদর, বিছানার পাশ, নরম খেলনা, নার্সারি রাইম, টিভি টাইম... এতদিনের একার অধিকারগুলো সে ছেড়ে দিচ্ছে খুব সহজে, হাসি মুখে। দিনাজপুরের সেই দিনগুলো মনে পড়ে - পুরোপুরি অন্যরকম এক পরিবেশ, স্কুল, বন্ধু, মানুষ এবং পড়াশুনা। আর এসব কিছুর সাথে মানিয়ে নেয়ার তার চেষ্টা। বাংলা চিনতো না এক বর্ণ। সাত বছরের গ্রেড-ওয়ানের নিতান্তই একটা বাচ্চাকে যে গরু, মহিষ, নদী আর আমাদের বিদ্যালয়ের মুখস্ত করা লাগে, কে জানতো! রেক্টাংগল মানে আয়তক্ষেত্র, স্কয়ার মানে চতুর্ভূজ, ইনসেক্ট মানে কীট-পতঙ্গ (!) যেন ডিকশনারি ঘেটে ঘেটে সবচেয়ে কঠিন আর উদ্ভট শব্দগুলো তুলে দেয়া হয়েছে বাড়ির কাজের খাতায়। এসব ছাইপাশ মুখস্তের চেয়ে ছড়া, কবিতা, গল্প যে তার কাছে বেশি আনন্দের, এই সহজ সত্যটা সেই ছ্যাঁদা ইংলিশ মিডিয়ামকে, কে বোঝাবে! এত কঠিন কঠিন শব্দের দরকারটাই বা কি? টিচার কে জিগ্যেস করায়, তারা আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করলো, যাতে বাচ্চারা যা পড়ছে তার অর্থ বুঝতে পারে। এদিকে শব্দার্থের মর্মার্থ বুঝতে যে আমাদের মা-ছেলের দু'জনের মস্তিষ্কের শর্ট-সার্কিট হয়ে যাওয়ার দশা। এত এত হাতি, ঘোড়া, তালগাছ মুখস্ত করায়ে ছেলেকে রাতারাতি ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বনায়ে ফেলবো এই স্বপ্ন আমি দেখি না কোনোদিন। যে শব্দ উচ্চারণে আমার নিজের দাঁত ভাঙ্গে অথচ মর্ম ভেতর অব্দি পৌছায় না, তা আমি ওর মত বাচ্চা ছেলেকে কি বোঝাবো! তাই আমি তখন পৃথিবীর একমাত্র মা ছিলাম যে কিনা ছেলেকে স্কুল না পাঠাতে পারলেই বরং হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম! ধন্য বাংলাদেশের রাজনীতি, ধন্য হরতাল অবরোধ। ছোটজন আসার দিন গোনা ছাড়া আমার তখন তেমন কিছু করার ছিল না। তাই সেসময়ের পুরোটাই রাখলাম তার জন্যে বরাদ্দ। রামিন আর আমি। আমি আর রামিন। আমরা আস্তে ধীরে বাংলা শুরু করলাম। অল্প কিছুদিনেই সে বাংলা পড়তে, লিখতে শিখলো। রাস্তায় বেরুলে বাংলা সাইনবোর্ডগুলো পড়ে ফেলতো সহজেই, পড়ত বাসায় আসা সংবাদপত্ররের হেডিংগুলো। এখন যখন নন্টেফন্টে, রূপকথার তেপান্তরে ছোট্ট শহর সে আগ্রহ নিয়ে পড়ে তা দেখে আমার মন তৃপ্তিতে ভরে যায়। ওর মুখে অতিচেনা বাংলাটাও কেন জানি অন্যরকম সুন্দর লাগে!
 

বলছিলাম হরতাল, অবরোধের দিনগুলোর কথা। আর জ্ঞান হবার পর তার কাটানো সবচেয়ে দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে থাকার গল্প। কাকতালীয়ভাবে এই দু'টিই তখন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। সাথে মিশে ছিল আমাদের অপেক্ষার গল্পও।

ছোটজন আসার দিন গোনার জন্য সে নিজ হাতে একটা ক্যালেন্ডার বানিয়েছিল। রোজ সকালে উঠে পেন্সিল দিয়ে নিয়ম করে একটা একটা দিন কাটত। নানুভাইএর সাথে স্কুল যাওয়া আসার আনন্দটুকু বাদে, দিনাজপুরের ইন্টারন্যাশনাল ইংলিশ মিডিয়াম তার ছোট মনে দেশের স্কুলের প্রতি আতংক ছাড়া আর কোনো ভালো স্মৃতি রাখতে পারেনি। স্কুলের দিনগুলোতে ক্যালেন্ডারে দিন ক্রস করার তাড়া একটু বেশি থাকার অন্য একটা অর্থ হয়্তো ছিল - আরো একটা লম্বা দিন তার পার হল বাবার কাছ থেকে দূরে, ভয়াবহ একটা স্কুলে ভয়াবহ কিছু অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে। যেখানে চশমা পড়ার জন্যে তাকে সহপাঠিরা টিজ করে, শুনতে হয় বাম হাতে লিখলে আল্লাহ্‌ গুণাহ দেয়, বাংলা অন্যদের মত দ্রুত না লিখতে পারায় পেতে হয় সবজান্তা টিচাদের কটাক্ষ। আরো, আরো অনেক কিছু যার সবটা হয়তো আমি জানি না... (!)

গাম্বিয়ায় এসে আরেকদফা স্কুল বদল হলো। নতুন স্কুলে কোনো নতুন ফ্রেন্ড হলো কিনা, টিচাররা কেমন, তার ভালো লাগছে কিনা এসব নিয়ে আমরা কথা বলি খেতে খেতে বা টিভি দেখতে দেখতে। আমি জানি না সন্তানের বন্ধু হওয়া যায় কেমন করে। বা আদৌ হওয়া যায় কিনা। আসলে নিজের মাকে আমার কেবল মা লাগে, বন্ধু না! তাই নিজের সব কথা মা-কে বলাও হয়না মন খুলে। কিন্তু, আমি ওর বন্ধু হতে চাই! ওকে বলি - তুমি পঁচা কাজ করলে আমি কষ্ট পাই, কিন্তু তারো বেশি কষ্ট পাই তুমি যদি মিথ্যা বলে সেটা আমার থেকে লুকানোর চেষ্টা করো। একদিন ঘুমানোর সময় ওর পাশে শুয়ে আছি, এই সময়টা আমি বা ওর বাবা ঘুমানোর আগ পর্যন্ত ওর পাশেই থাকি, একসাথে গল্প বা কমিক পড়ি যেন ঘুমের পুরো সময়টা সে নিশ্চিন্ত থাকে, মা অথবা বাবা পাশে আছে ভেবে। সেদিন কি মনে করে হঠাত বলে, 'মা তুমি রাইট, স্কুলের একটা ওয়াল পেইন্টিঙয়ে লেখা আছে - We are honost, we don't cover up the truth।'। বলে - 'আমি কখনো ট্রুথ কাভার আপ করবো না, আই প্রমিজ।' চোখে পানি চলে আসল। পরদিন সারাক্ষণ আমি শুধু ওর বলা কথাগুলো ভাবলাম। ছেলেটা আমার সত্যি বড় হয়ে যাচ্ছে! জানিনা দিনাজপুরের সেই ইন্টারন্যাশনাল স্কুলটাতে ক্লাস ওয়ানে 'সত্য বলা' নামে কোনো রচনা ছিল কিনা, বা ক্লাশে 'ট্রুথ স্পিকিং' নামে আলাদা কোন সাবজেক্ট ছিল কিনা। তবে নিশ্চত, থাকলে তাও শিখানো হত, মুখস্তের আতংক দিয়ে। কে জানে হয়তো সেখানে বাচ্চাদের সত্য বলাও শিখানো হয় ধরে বেঁধে নয়তো বা ভয় দিয়ে। যেমনটা আমাদের বেলায় হতো, 'মিথ্যা বললে আল্লাহ্‌ জিভ টেনে ছিড়ে ফেলবে!' কি ভয়ংকর! অন্যদিকে নম্বরখেকো বাবা মা-রাও হয়্তো বাসায় হাই স্কিলড টিচার রেখে দিত যার যার ছেলেমেয়েকে সত্য বলায় বেশি নম্বর পাওয়ার জন্য!

কেন জানি আজকে একটু একটু করে রামিন-কে নিয়ে অনেক দিনের
জমানো এ কথাগুলো বলতে ইচ্ছে করল। ছেলেটা জীবনে এভাবেই ছোট ছোট বিষয় থেকে অনেক বড় বড় বিষয় শিখুক। প্রথম হওয়ার প্রতিযোগিতায় না, জগত চিনে নিক নিজের মতো, দ্বিধাহীন... গত ৭ই জুন সে আট বছরে পড়ল, ছেলেটা বুঝি এবার সত্যি সত্যিই বড় হয়ে গেল --

তোমাদের সন্তানেরা তোমাদের নয়,
তারা জীবনের সন্তানসন্ততি
জীবনের জন্যই তাদের আকুতি।
তারা তোমাদের সঙ্গেই রয়েছে
তবু তারা তোমাদের নয়।
তারা তোমাদের সঙ্গেই রয়েছে
তবু তারা তোমাদের নয়।
তারা তোমাদের ভালোবাসা নিয়েছে
কিন্তু নেয়নি তোমাদের ধ্যান-ধারণা,
কেননা তারা গড়ে নিয়েছে
তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারনা।
তাদের শরীর তোমাদের আয়ত্ত্বের ভেতর
কিন্তু তাদের আত্না কখনই নয়
কেননা, তাদের আত্না বাস করে
ভবিষ্যতের ঘরে,
যে ঘরে তোমরা কখনই পারবে না যেতে
এমনকি তোমাদের স্বপ্নেও না।
........................

তাদের কে চেয়ো না তোমাদের মত করতে
কারণ তাদের জীবন কখনই ফিরবে না
পেছনের পানে।

(একাত্তরের দিনগুলি পড়ার সময় খলিল জিবরান সম্পর্কে জেনেছিলাম, অনুবাদটা হয়ত জাহানারা ইমামের নিজের করা। সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের নিছক উদ্বিগ্নতার এত স্বচ্ছ সমাধান আর কোথাও দেখি নাই। ভালো লাগায় লাইনগুলো টুকে রেখেছিলাম বহুআগে)