Wednesday 11 June 2014

তাদের আত্না বাস করে ভবিষ্যতের ঘরে

একটু একটু করে সে বড় হয়ে গেছে অনেকটা। আলাদা বিছানায় শোয়, সেও অনেকদিন। নিজ হাতে খায়, খেয়ে প্লেটটাও ধুয়ে রাখে। কখনও কখনও আমার আর বাবারটাও ধোয়ার জন্যে জিদ করে। টয়লেট করে নিজেই পরিষ্কার হয়। ওকে বলে দিয়েছি - 'nobody is allowed to touch ur private body parts, not even me or baba.'

এইতো সে'দিনও কোলে নিতাম কত! জ্বর, কাশিতে প্রায়ই কষ্ট পেত, তখন কোলে নিয়ে এঘর ওঘর হাঁটতাম, খেলনা গাড়িগুলোর কাছে নিয়ে যেতাম। অথচ এখন চাইলেও শখ করে আর কোলে নিতে পারি না। এখন আস্ত গাড়ির চেয়ে খুচরো পার্টসে তার আগ্রহ বেশি। কোন প্লেনের প্রোপেলার, কোন গাড়ির মোটর আর কোন খেলনার ব্যাটারি খুলে নিয়ে সে নিজের ইচ্ছামাফিক চলন্ত আজব আজব জিনিস বানায়, আমরা টেরও পাই না। আসলেই কি সে বড় হয়ে গেল! - এই সরু সরু হাত-পা ওয়ালা ঢ্যাঙা লম্বা হয়ে ওঠা ছেলেটা যে আমার কাঁধ ছুঁই ছুঁই করছে, সে তো আর টোপা, টোপা গালের নাদুসনুদুস সেই গুল্লু বাবুটা নেই! যাকে দেখলেই গাল টিপে আদর করতে ইচ্ছে করতো। এখন অন্য কারো সামনে আদর করলে সে লজ্জা পায়। ইশারায় বুঝায়, কামওন মা গ্রো আপ, লোকজনের সামনে এসব করা যাবে না। মন খারাপ করলে কানের কাছে মুখ এনে বলে - 'পরে, পরে'। মরিয়ামা যদি কখনো ভুল করে বেবি ডেকে ফেলে, সাথে সাথেই প্রতিবাদ, I'm not a baby, I'm a boy! মারিয়ামাও ভুল স্বীকার করে বলে, okay, okay, u're big boy। আমাদের বিগ বয় এখন বিগ ব্রাদার।

ছোট আরেকজন এসেছে বলেই হয়তো এরকম হুট করে বড় হয়ে গেল সে। বোনটার জন্য ছাড় দিতে দিতে - মায়ের কোল, আদর, বিছানার পাশ, নরম খেলনা, নার্সারি রাইম, টিভি টাইম... এতদিনের একার অধিকারগুলো সে ছেড়ে দিচ্ছে খুব সহজে, হাসি মুখে। দিনাজপুরের সেই দিনগুলো মনে পড়ে - পুরোপুরি অন্যরকম এক পরিবেশ, স্কুল, বন্ধু, মানুষ এবং পড়াশুনা। আর এসব কিছুর সাথে মানিয়ে নেয়ার তার চেষ্টা। বাংলা চিনতো না এক বর্ণ। সাত বছরের গ্রেড-ওয়ানের নিতান্তই একটা বাচ্চাকে যে গরু, মহিষ, নদী আর আমাদের বিদ্যালয়ের মুখস্ত করা লাগে, কে জানতো! রেক্টাংগল মানে আয়তক্ষেত্র, স্কয়ার মানে চতুর্ভূজ, ইনসেক্ট মানে কীট-পতঙ্গ (!) যেন ডিকশনারি ঘেটে ঘেটে সবচেয়ে কঠিন আর উদ্ভট শব্দগুলো তুলে দেয়া হয়েছে বাড়ির কাজের খাতায়। এসব ছাইপাশ মুখস্তের চেয়ে ছড়া, কবিতা, গল্প যে তার কাছে বেশি আনন্দের, এই সহজ সত্যটা সেই ছ্যাঁদা ইংলিশ মিডিয়ামকে, কে বোঝাবে! এত কঠিন কঠিন শব্দের দরকারটাই বা কি? টিচার কে জিগ্যেস করায়, তারা আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করলো, যাতে বাচ্চারা যা পড়ছে তার অর্থ বুঝতে পারে। এদিকে শব্দার্থের মর্মার্থ বুঝতে যে আমাদের মা-ছেলের দু'জনের মস্তিষ্কের শর্ট-সার্কিট হয়ে যাওয়ার দশা। এত এত হাতি, ঘোড়া, তালগাছ মুখস্ত করায়ে ছেলেকে রাতারাতি ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বনায়ে ফেলবো এই স্বপ্ন আমি দেখি না কোনোদিন। যে শব্দ উচ্চারণে আমার নিজের দাঁত ভাঙ্গে অথচ মর্ম ভেতর অব্দি পৌছায় না, তা আমি ওর মত বাচ্চা ছেলেকে কি বোঝাবো! তাই আমি তখন পৃথিবীর একমাত্র মা ছিলাম যে কিনা ছেলেকে স্কুল না পাঠাতে পারলেই বরং হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম! ধন্য বাংলাদেশের রাজনীতি, ধন্য হরতাল অবরোধ। ছোটজন আসার দিন গোনা ছাড়া আমার তখন তেমন কিছু করার ছিল না। তাই সেসময়ের পুরোটাই রাখলাম তার জন্যে বরাদ্দ। রামিন আর আমি। আমি আর রামিন। আমরা আস্তে ধীরে বাংলা শুরু করলাম। অল্প কিছুদিনেই সে বাংলা পড়তে, লিখতে শিখলো। রাস্তায় বেরুলে বাংলা সাইনবোর্ডগুলো পড়ে ফেলতো সহজেই, পড়ত বাসায় আসা সংবাদপত্ররের হেডিংগুলো। এখন যখন নন্টেফন্টে, রূপকথার তেপান্তরে ছোট্ট শহর সে আগ্রহ নিয়ে পড়ে তা দেখে আমার মন তৃপ্তিতে ভরে যায়। ওর মুখে অতিচেনা বাংলাটাও কেন জানি অন্যরকম সুন্দর লাগে!
 

বলছিলাম হরতাল, অবরোধের দিনগুলোর কথা। আর জ্ঞান হবার পর তার কাটানো সবচেয়ে দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে থাকার গল্প। কাকতালীয়ভাবে এই দু'টিই তখন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। সাথে মিশে ছিল আমাদের অপেক্ষার গল্পও।

ছোটজন আসার দিন গোনার জন্য সে নিজ হাতে একটা ক্যালেন্ডার বানিয়েছিল। রোজ সকালে উঠে পেন্সিল দিয়ে নিয়ম করে একটা একটা দিন কাটত। নানুভাইএর সাথে স্কুল যাওয়া আসার আনন্দটুকু বাদে, দিনাজপুরের ইন্টারন্যাশনাল ইংলিশ মিডিয়াম তার ছোট মনে দেশের স্কুলের প্রতি আতংক ছাড়া আর কোনো ভালো স্মৃতি রাখতে পারেনি। স্কুলের দিনগুলোতে ক্যালেন্ডারে দিন ক্রস করার তাড়া একটু বেশি থাকার অন্য একটা অর্থ হয়্তো ছিল - আরো একটা লম্বা দিন তার পার হল বাবার কাছ থেকে দূরে, ভয়াবহ একটা স্কুলে ভয়াবহ কিছু অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে। যেখানে চশমা পড়ার জন্যে তাকে সহপাঠিরা টিজ করে, শুনতে হয় বাম হাতে লিখলে আল্লাহ্‌ গুণাহ দেয়, বাংলা অন্যদের মত দ্রুত না লিখতে পারায় পেতে হয় সবজান্তা টিচাদের কটাক্ষ। আরো, আরো অনেক কিছু যার সবটা হয়তো আমি জানি না... (!)

গাম্বিয়ায় এসে আরেকদফা স্কুল বদল হলো। নতুন স্কুলে কোনো নতুন ফ্রেন্ড হলো কিনা, টিচাররা কেমন, তার ভালো লাগছে কিনা এসব নিয়ে আমরা কথা বলি খেতে খেতে বা টিভি দেখতে দেখতে। আমি জানি না সন্তানের বন্ধু হওয়া যায় কেমন করে। বা আদৌ হওয়া যায় কিনা। আসলে নিজের মাকে আমার কেবল মা লাগে, বন্ধু না! তাই নিজের সব কথা মা-কে বলাও হয়না মন খুলে। কিন্তু, আমি ওর বন্ধু হতে চাই! ওকে বলি - তুমি পঁচা কাজ করলে আমি কষ্ট পাই, কিন্তু তারো বেশি কষ্ট পাই তুমি যদি মিথ্যা বলে সেটা আমার থেকে লুকানোর চেষ্টা করো। একদিন ঘুমানোর সময় ওর পাশে শুয়ে আছি, এই সময়টা আমি বা ওর বাবা ঘুমানোর আগ পর্যন্ত ওর পাশেই থাকি, একসাথে গল্প বা কমিক পড়ি যেন ঘুমের পুরো সময়টা সে নিশ্চিন্ত থাকে, মা অথবা বাবা পাশে আছে ভেবে। সেদিন কি মনে করে হঠাত বলে, 'মা তুমি রাইট, স্কুলের একটা ওয়াল পেইন্টিঙয়ে লেখা আছে - We are honost, we don't cover up the truth।'। বলে - 'আমি কখনো ট্রুথ কাভার আপ করবো না, আই প্রমিজ।' চোখে পানি চলে আসল। পরদিন সারাক্ষণ আমি শুধু ওর বলা কথাগুলো ভাবলাম। ছেলেটা আমার সত্যি বড় হয়ে যাচ্ছে! জানিনা দিনাজপুরের সেই ইন্টারন্যাশনাল স্কুলটাতে ক্লাস ওয়ানে 'সত্য বলা' নামে কোনো রচনা ছিল কিনা, বা ক্লাশে 'ট্রুথ স্পিকিং' নামে আলাদা কোন সাবজেক্ট ছিল কিনা। তবে নিশ্চত, থাকলে তাও শিখানো হত, মুখস্তের আতংক দিয়ে। কে জানে হয়তো সেখানে বাচ্চাদের সত্য বলাও শিখানো হয় ধরে বেঁধে নয়তো বা ভয় দিয়ে। যেমনটা আমাদের বেলায় হতো, 'মিথ্যা বললে আল্লাহ্‌ জিভ টেনে ছিড়ে ফেলবে!' কি ভয়ংকর! অন্যদিকে নম্বরখেকো বাবা মা-রাও হয়্তো বাসায় হাই স্কিলড টিচার রেখে দিত যার যার ছেলেমেয়েকে সত্য বলায় বেশি নম্বর পাওয়ার জন্য!

কেন জানি আজকে একটু একটু করে রামিন-কে নিয়ে অনেক দিনের
জমানো এ কথাগুলো বলতে ইচ্ছে করল। ছেলেটা জীবনে এভাবেই ছোট ছোট বিষয় থেকে অনেক বড় বড় বিষয় শিখুক। প্রথম হওয়ার প্রতিযোগিতায় না, জগত চিনে নিক নিজের মতো, দ্বিধাহীন... গত ৭ই জুন সে আট বছরে পড়ল, ছেলেটা বুঝি এবার সত্যি সত্যিই বড় হয়ে গেল --

তোমাদের সন্তানেরা তোমাদের নয়,
তারা জীবনের সন্তানসন্ততি
জীবনের জন্যই তাদের আকুতি।
তারা তোমাদের সঙ্গেই রয়েছে
তবু তারা তোমাদের নয়।
তারা তোমাদের সঙ্গেই রয়েছে
তবু তারা তোমাদের নয়।
তারা তোমাদের ভালোবাসা নিয়েছে
কিন্তু নেয়নি তোমাদের ধ্যান-ধারণা,
কেননা তারা গড়ে নিয়েছে
তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারনা।
তাদের শরীর তোমাদের আয়ত্ত্বের ভেতর
কিন্তু তাদের আত্না কখনই নয়
কেননা, তাদের আত্না বাস করে
ভবিষ্যতের ঘরে,
যে ঘরে তোমরা কখনই পারবে না যেতে
এমনকি তোমাদের স্বপ্নেও না।
........................

তাদের কে চেয়ো না তোমাদের মত করতে
কারণ তাদের জীবন কখনই ফিরবে না
পেছনের পানে।

(একাত্তরের দিনগুলি পড়ার সময় খলিল জিবরান সম্পর্কে জেনেছিলাম, অনুবাদটা হয়ত জাহানারা ইমামের নিজের করা। সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের নিছক উদ্বিগ্নতার এত স্বচ্ছ সমাধান আর কোথাও দেখি নাই। ভালো লাগায় লাইনগুলো টুকে রেখেছিলাম বহুআগে)

No comments:

Post a Comment