Wednesday 26 December 2012

একটু আলোর 'প্রতিধ্বনি'

মধ্য দুপুর। ঠিক মাথার উপর সূর্যটা তীব্ররোষে গনগনে তাওয়ার ওম ঢালছে। ফ্লাই ওভারের উপর সিঁড়ির ডান পাশটায় বসে আছে ছেলেটা। বয়স দশ কি বারো, কিন্তু বয়সের তুলনায় শরীর ভেঙ্গে গেছে বহু আগেই, জীর্ণ শরীরের ভারটুকুও অনেক বেশি ঠেকে তার কাছে। সকালে বাবা রিক্সাটা নিয়ে বের হওয়ার সাথে সাথে সৎ মা এনে বসিয়ে দিয়ে যায় এখানে, বসে থাকে সে, জলন্ত সূর্যের ঝাঁজ তার চামড়া ঝলসে বাষ্প বের করে দেয়, অস্পষ্টে যেন নিজেকেই বলে - "আজাব!"

কত মানুষ যাওয়া আসা করে, তাদের বোঝার চেষ্টা করে সে, পাশ দিয়ে যেতে থাকা লোকটা, তাগড়া জোয়ান। দ্রুত ভঙ্গীতে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় খানিকটা তাছিল্য মিশিয়ে ছুঁড়ে দেয় একটা পয়সা, সামনের মরচে পরা টিনের থালটাতে আছড়ে পড়ে ঝনঝনিয়ে বেজে উঠে তা। আওয়াজটা যেন একটু কানে বাধলো তার, প্রায় সাথে সাথে বলে উঠে - "এইটা কি দিলা গো ভাইজান, এই পয়সা তো অচল!"

কাছেই এক গ্যারাজে কাজ করে জোয়ান লোকটা, মালিকের সাথে বনিবনা নাই। কদিন হলো, সন্ধ্যার পর তিন-চার জনে মিলে নদীর ধারে ফাঁকা মতো রাস্তাটায় ঢুঁ মারে, তক্কে তক্কে থাকলে দু-একটা সহজ শিকার পাওয়া যায়, শর্ট-কাটে পয়সা কামানোর কায়দাকানুন অল্প দিনে সে ভালোই রপ্ত করেছে। 'বিষয়টা হইলো পরথমেই মানুষের মনে ডর ঢুকায়ে দেয়া, হের পরের কাম খুব সোজা' - মনে মনে ভাবে সে।

পয়সাটা হাতে নিয়ে আবার বলে ছেলেটা, "ভাইজান! ও ভাইজান! এই পয়সা তো অচল।"

'শালার কোথাও শান্তি নাই!' মনে মনে গজরায় লোকটা, 'গ্যারাজ থাইকা একটু হাওয়া খাইতে বাইর হইলাম, রাস্তার ওইপাশে চা-এর দোকানটায় আয়েশে এক কাপ চা আর একখান বিড়ি টান দিয়া, দাম দিতে পকেটে হাত দিয়া দেখি কয়টা খুচরা পয়সা ছাড়া সেখানে আর কিচ্ছু নাই, মেজাজটা তখনই খিচড়ে গেছিলো, তার উপর দোকানদার এই পয়সাটা ফেরত দিয়া কইল, এইটা অচল। ওভারব্রিজে উইঠাই দেখি এই কানা ব্যাটা রোজকার মত থাল নিয়া বইসা আছে, পয়সাটা হাতেই ছিলো ছুড়ে দিলাম তার দিকে। কানায় আবার কয় পয়সা অচল!'

মাথায় রক্ত উঠে গেলো তার- "শালা (বাজে একটা গালি দেয় সে), নকশা করো তাই না?! কানার পার্ট লইয়া ভিক্ষা করো, আবার কও পয়সা অচল!" দুনিয়ার সব না পাওয়ার ঝাল ইচ্ছামতো ঝাড়ে এই আজন্মার উপর। উপুর্যুপরি লাথি মারতে থাকে নরকের কীটটাকে।

মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে ব্যাথায় কুঁকড়ানো শরীরটাকে প্রাণপণে দুই হাত দিয়ে ঢাকতে চায় ছেলেটা, কিন্তু এই আচমকা একের পর এক আসা এই আঘাত থেকে রক্ষা করতে পারেনা নিজেকে। চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে।
ভেতরের পশুটাকে এবার গলায় এনে লোকটা বলে, "চুপ! একদম চুপ! আওয়াজ করলে এক্কেরে জানে মাইরা ফেলবো, হারামির পো!"

মার খাওয়া কুকুরের মতো মুখ দিয়ে শুধু গোঙানির আওয়াজ বের হয় ছেলেটার, চিঁচিঁ করে বলতে থাকে - "আমার চক্ষু নাই গো ভাইজান... আমি জন্মঅন্ধ... আমি জন্মান্ধ..."

চারপাশে দ্রুত উকসুক মানুষের ভিড় জমে যায়, শন্ডামার্কা এক যুবকের কাছে, এক কানার ভং ধরা ছোকরা ফকিরের মার খাওয়া ব্যাপক বিনোদন! এরকম দুই-একটা পথে-ঘাটে মাইরা সাফ করলেই বরং দেশের বোঝা কমে!
.......................................................................................................................................................

উপরের গল্পটা কাল্পনিক। গল্পের সেই ছেলেটা, যে কিনা আসলেই জন্ম থেকে দৃষ্টিহীন, সে সেদিন কারো সহানুভূতি পায়নি। শুধু থালে পয়সা বাড়ি খাওয়ার শব্দ শুনেই বলে দেয়া, পয়সাটা অচল, এই খোঁড়া যুক্তি গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি কারো কাছে। অলৌকিক বা জীন-ভূত প্রদত্ত কোনো ক্ষমতা তার আছে কিনা, সেটা ভাবার সময়ও আপাতত কারো নেই। ব্যস এটুকুই, এর চেয়ে বেশী গুরুত্ব পাওয়ার সুযোগ তার নেই আমাদের সমাজের বাস্তবতায়, তাই এরচেয়ে বেশি তাকে নিয়ে কেউ ভাবেও না। যেখানে একজন সুস্থ মানুষের বেঁচে থাকাই নিত্য জটিলতায় ভরা, সেখানে এধরণের অপূর্ণাঙ্গ জীবন তো স্বয়ং এক 'আজাব'! এটাই স্বাভাবিক।

এবার আরেকজন মানুষের গল্প বলব, তবে এবার কল্পনা নয় বাস্তব -


 ড্যানিয়েল কিশ, জন্ম ১৯৬৬, ক্যালিফোর্নিয়া। মুক্ত প্রকৃতিতে অবাধ ঘোরাঘুরি, পর্বতারোহণ ও মাউন্টেন-বাইকিং তার নেশা। অবিশ্বাস্য রকমের প্রাণবন্ত ড্যানিয়েল কিশ যখন কোন সাহায্য ছাড়াই সাবলিলভাবে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে যায় বা ঢাল বেয়ে সাইকেল চালিয়ে যায়, তখন বিশ্বাস করা সত্যি কঠিন যে মানুষটি আসলে চোখে দেখে না। মাত্র ১৩ মাস বয়সে এক ভয়ঙ্কর রকমের ক্যান্সারের কারণে সে তার দুইটি চোখই খুইয়ে বসে। কিন্তু তাই বলে থেমে যায়নি তার জীবন, থেমে যায়নি পৃথিবীকে দেখাও। বরং অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সে তার চারপাশ দেখার নিজস্ব এক কায়দা রপ্ত করে ফেলে আর তা হল 'active echolocation' অর্থাৎ প্রতিধ্বনির মাধ্যমে অবস্থান নির্নয় বা প্রতিধ্বনির ব্যবহার। এটি সে করে তার জিভ নেড়ে বাইরের জগৎ এ কিছু শব্দতরঙ্গ পাঠিয়ে এবং এর প্রতিফলন থেকে।




কিশ তার জিভ দিয়ে মুখের তালুতে সেকেন্ডে দু থেকে তিন বার টোকা দিয়ে ছোট্ কিছু শব্দ তৈরি করে, এবং এই ছোট্ট শব্দগুলো তরঙ্গে প্রতিফলিত হয়ে তাকে সাহায্য করে আশেপাশের পৃথিবীর একটা বাস্তব প্রতিচ্ছবি পেতে, যেমন- গাড়ি, দরজা, ফুটপাথের খাম্বা ইত্যাদি। এই ছোট তরঙ্গ তাকে দেখিয়ে দেয় বস্তুর দুরত্ব, আকৃতি, গঠন ও ঘনত্ব। কিশের ভাষায় -

“For example, a wooden fence is likely to have thicker structures than a metal fence and when the area is very quiet, wood tends to reflect a warmer, duller sound than metal.”
শুধু তাই নয়, তার শব্দ এবং প্রতিধ্বনি তাকে নিখুঁত ভাবে অনুধাবন করায় কোনো বস্তুর সৌন্দর্য অথবা রুক্ষতা বা বস্তুটি আসলেই কেমন, প্রতিফলিত তরঙ্গগুলো পৃথিবীর হুবহু সেই রূপ বর্ণনা করে যা হয়তো একজন পূর্ণদৃষ্টির লোকের পক্ষে দেখা সম্ভব। তার এই ক্ষমতাই তাকে ঘরের বাইরে যেকোন দুঃসাহসিক অভিযানে - হাইকিং, মাউন্টেন-বাইকিং অংশগ্রহণে স্বতঃস্ফুর্ত শক্তি যোগায়, বলা যায় ইকোলোকেশন একজন নান্দনিক অনুসন্ধানকারীকে পৃথিবীকে চিনতে শিখিয়েছে।

ড্যানিয়েল কিশ ও বাদুড়ের ইকোলোকেশনের সাদৃশ্যঃ



জিভ দিয়ে শব্দ করে ও তার প্রাপ্ত প্রতিধ্বনির মাধ্যমে সবকিছু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার এই অবিশ্বাস্য কৌশল আয়ত্তের কারণে, অনেকে ড্যানিয়েল কিশ কে real life "Bat"man বলে। বাদুড়ের শব্দতরঙ্গ ব্যবহারের কৌশল ও কিশের কৌশল অনেকটাই মিলে যায়। বাদুড়ও উচ্চ-তীক্ষ্ণ স্বরবিশিষ্ট শব্দ ক্রমাগত বাতাসে ছাড়ে এবং তা পৃথিবীর নানা পৃষ্ঠে আঘাত পেয়ে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে, এভাবেই বাদুড় রাতের আকাশে নির্বিঘ্নে উড়ে চলে এবং অন্ধকারে পোকামাকড় খুঁজে বের করে। এই অসাধারণ উচ্চ কম্পনশীল শব্দপদ্ধতির কারণে বাদুড়ও প্রায় মানুষের কাছাকাছিই দেখে, অতএব বাদুড় দেখতে পায় না এই ধারণা পুরোপুরি ভ্রান্ত। শব্দ তৈরি ও তার প্রতিধ্বনি থেকে বাদুড় তার মস্তিষ্কে পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে একটা sonic map তৈরি করে। শব্দ প্রতিফলনের সময়টুকু থেকে সে জেনে যায় কোন বস্তু তার থেকে কত দুরে। যা দৃষ্টিশক্তির পরিপূরক হিসেবে কাজ করে, আর এটাই হলো Echolocation। প্রকৃতিতে অনেক প্রাণী নানাভাবে এই ইকোলকেশন ব্যবহার করে, যেমন, সাগরের তিমি, ডলফিন ইত্যাদি ।

আসি আসল কথায়, অধিকাংশ অন্ধলোকের ইকোলকেশন ক্ষমতা বেশি থাকে। তবে একেকজন একেকভাবে হয়ত নিজের অজান্তে তা ব্যবহার করে, যেমন - হতে পারে কেউ তার হাতের ছড়িটা দিয়ে মাটিতে বার বার আঘাত করে, কেউ অকারণে হাতের আঙ্গুল কামড়াতে থাকে, কেউ হয়তো হাঁটার সময় একটু জোরে জোরে শব্দ করে পা ফেলে ইত্যাদি। এসবই তাদের ভেতরে থাকা শব্দ ধরার অতিরিক্ত ক্ষমতাই প্রকাশ করে। কিন্ত খুব কম লোকেই ড্যানিয়েল কিশের মত এই ক্ষমতাকে জেনে শাণিত করার সুজোগ পায়। আমার প্রথম গল্পের অন্ধ ছেলেটাও কিন্তু তার ভেতরে থাকা ইকোলোকেশন ক্ষমতা থেকেই বুঝে ফেলে পয়সাটা আসলে নকল!

আসুন দেখি, বিজ্ঞান ইকোলোকেশনকে দৃষ্টির পরিপূরক বলে গ্রহন করে কিনা?

ড্যানিয়েল কিশ নিঃসন্দেহে তার ইকোলোকেশন শক্তিকে যথাযথভাবে শাণিত করে আজ একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবনকে উপভোগ করছে। কিন্তু তারপরেও সার্বজনীনতার ক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন আসে, যেমন - এই শব্দ প্রতিধ্বনির মাধ্যমে অবস্থান নির্ণয়, আসলেই কি একজন মানুষের কাছে বাস্তবতার পূর্ণাঙ্গ রূপ তুলে ধরে? বাদুড়ের জন্য নাহয় এ পদ্ধতি উপযোগী, তাই বলে মানুষের ক্ষেত্রেও যে তা একইভাবে কার্যকর হবে তার প্রমাণ কোথায়? এবং সর্বোপরি বিজ্ঞান কি ইকোলোকেশনকে দৃষ্টিশক্তির পরিপূরক বলে গ্রহণ করে?

প্রশ্নগুলো মাথায় রেখে কানাডার একদল বিজ্ঞানী গবেষণা শুরু করেছিল ২০১১ সালে। তারা দুজন অন্ধ ইকোলোকেশনে সক্ষম ব্যক্তি এবং দুজন পূর্ণ দৃষ্টিশক্তিবিশিষ্ট অথচ ইকোলোকেশনে সক্ষম না, এমন ব্যক্তির মস্তিষ্ক স্ক্যান করেন। স্ক্যানিং এর সময় অংশগ্রহণকারীদের কিছু অডিও টেপ শোনানো হয়, যার মধ্যে এক সেট রেকর্ডিং এ কিছু প্রাকৃতিক ইকো থাকে, অন্য রেকর্ডিং সেটটি তে তা থাকেনা।




এই স্ক্যানিং অন্ধ ইকোলোকেশন এ সক্ষম ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে দারুণ কিছু অভুতপূর্ব তথ্য দেয়, মস্তিকের যে অংশ দৃষ্টিশক্তিবিশিষ্ট মানুষের সরাসরি দৃষ্টি বা দেখার সাথে সংযুক্ত, সে অংশে এ অন্ধ ব্যক্তিদের মস্তিষ্কে ইকো রেকর্ডিং চলাকালে জোরালো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই গবেষণায় সম্পৃক্ত বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে আসে এভাবে -

"We don't know to what extent they're "seeing" but they're certainly using the part of the brain that sighted people use for vision."
ইকোলোকেশন শাণিতকরন এবং এর ভবিষ্যতঃ

ড্যানিয়েল কিশের মত মানুষেরা এই পদ্ধতির মাধ্যমে তাদের দেখার ক্ষমতাকে বাধ্য করেছে একটা নিজস্ব রূপে গঠনে, এবং যা বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রমানিত। অতএব এই কৌশল দৃষ্টিহীন মানুষগুলোর রঙহীন কালো পৃথিবীটাকে নিজের রঙে সাজাতে অবশ্যই সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই কৌশল কার্যকরিভাবে রপ্ত করানো, অন্ধদের পড়া ও লিখার বিশেষ যে ব্যবস্থা (braille) তার থেকেও বহুগুণে সহজতর হবে। যা তাদের অন্য যেকোন অনুশীলনে প্রাণ যোগাতে পারে।

কিশ তার নিজ উদ্যোগে World Access for the Blind প্রতিষ্ঠানটিতে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ৫০০০ দৃষ্টিহীন মানুষকে তার এই ইকোলোকেশন পদ্ধতির প্রশিক্ষণ দেয়, কিশ এখানে সবাইকে জিভ দিয়ে শব্দ করে মস্তিষ্ক সক্রিয়করণের মাধ্যমে আশে পাশের জগৎ সম্পর্কে একটা সংবেদনশীল ম্যাপ পেতে সাহায্য করে, সে তার এই পদ্ধতির নাম দিয়েছে FlashSonar। সে যখন এই প্রতিষ্ঠানের তরুণ অনুশীলনকারী দের বাস্কেটবল বা হাইকিং-এর ট্রেনিং দেয়, তখন প্রতিটি অন্ধ মানুষ মুক্ত পৃথিবীতে এভাবেই নির্বিঘ্নে অংশগ্রহণ ও উপভোগের করবে এই স্বপ্নই দেখে।

কিন্তু দৃষ্টিহীনদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার এই সহজ কৌশল সকলের কাছে গ্রহণীয় হবে কিনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়! কারণ দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় বাধা হলো আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। প্রতিধ্বনির জন্য শব্দের প্রয়োজন, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কারো অবাঞ্ছিত শব্দ তৈরি শুরুতেই নিরুৎসাহিত করা হয়, কারণ সেটা তার প্রতি অন্য মানুষের একটা নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করে। আসল কথা হলো যেকোনো প্রতিবন্ধীদের তাদের প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে উঠার সঠিক ও সহজ ট্রেনিং আসলে আমাদের সমাজে কোথাও দেয়া হয়না, বরং শেখানো হয় তাদের ভেতরের সীমাবদ্ধতা যাতে আর দশটা সুস্থ মানুষের জীবনে অসুবিধার কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। তাদের শেখানো হয় কিভাবে অন্যদের জীবনযাত্রায় বিঘ্ন না ঘটিয়ে সমাজে সকলের সাথে সহাবস্থানের মাধ্যমে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা যায়, এটুকুই।

কিশকে আমেরিকায় কেউ 'ডেয়ারডেভিল', কেউ 'ব্যাটম্যান', আবার কেউবা 'রিয়েল লাইফ হিরো' বলে তার প্রাপ্য সম্মান দেয়ার চেষ্টা করে। আমাদের দেশেও যে কিশের মতো দুই একজনকে পাওয়া যাবেনা, তা নয়। অবশ্য তাদের খাতিরও কিন্তু আমরা কম করিনা, কাউকে ঈশ্বর বা জীন-ভূত থেকে অলৌকিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত ধরে নিয়ে, কানা পীর বানিয়ে তার কাছে পানিপড়া আনতে যাই, আবার কাউকে ভন্ড-ভুয়া বলে পথে-ঘাটে আচ্ছা ধোলাই দিয়ে মানুষ করার চেষ্টা করি।

প্রকৃতি তার সৃষ্টিতে যখন কোথাও কোন অপূর্ণতা দিয়ে পাঠায় তখন অবশ্যই সেটার পরিপূরক হিসেবে, সেখানে অন্য কোন উপাদান স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী দিয়ে একটা ব্যাল্যান্স রাখার চেষ্টা করে, কারণ প্রকৃতির কাছে তার সব সৃষ্টিই স্পেশাল। আমাদের সমাজের ক্ষেত্রে তথাকথিত সুস্থ মানুষের অজ্ঞতা ও অবহেলায় সেই অপূর্নতার স্বীকার মানুষগুলোর পরিপূরক উপাদানটি হয়তো কখনো বিকশিত হওয়ার সুযোগই পায়না! তাই লেখাটি অন্ধ ছেলেটার গল্প দিয়ে শুরু করা।
.................................................................................................................................................................................................
ছবিগুলো নেট থেকে নেয়া

ব্যবহৃত তথসূত্রঃ
১। উইকিপিডিয়া
২। বিবিসি
৩। ডিসকভার ম্যাগাজিন

বাংলাদেশ (পর্ব-৩)
















পুরো বছর ধরে দেশে যাওয়ার যে ছুটিটার জন্যে তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করে থাকি, সেই অতি মূল্যবান এক/দেড় মাসের অর্ধেকই আসলে কেটে যায় পথে। কখনো রাজশাহী তো কখনো দিনাজপুর, কখনো ঢাকা তো কখনো খুলনা। সব কূল রক্ষা করতে যেয়ে নিজের হাতে সময় বলতে গেলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা। এরই মাঝে - এক দুপুরে পিচঢালা চওড়া হাইওয়েটা ধরে যাচ্ছিলাম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। কাছাকাছি পৌঁছে বাঁয়ে তাকিয়ে দেখি এক স্মৃতিস্তম্ভ, আবদার ধরলাম সেখানেই নেমে পড়ার। 'স্মৃতিস্তম্ভ' শব্দটাতে কেন জানি বরাবরই ধাক্কা খাই আমি - স্তম্ভিত স্মৃতি নাকি স্মৃতির স্তম্ভ! কি জানি কি বোধ কাজ করে ভেতরে, তবে শব্দটার নিজস্ব একটা ভার আছে, যেটাকে ঠিক অস্বীকার করা যায় না। এর আগেও একবার আসা হয়েছিলো খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিন্তু পাশের এই বধ্যভূমিটির ব্যাপারে জানা হয়নি কিছুই। বুকে রক্তবর্ণের এক বৃত্ত নিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা শুভ্র-সফেদ মিনারগুলোর কারণেই হয়তো সেদিন চোখ থেমে গিয়েছিলো জায়গাটাতে। তখনো খুব বেশিদিন হয়নি ওটার বয়স, আশেপাশের আলগা মাটি বলে দিচ্ছে মাত্র ক'দিন আগেই হয়তো ঘোমটা খুলে গর্বের সাথে নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে স্তম্ভটি। ভাড়া মিটিয়ে বিদায় দেয়া হলো ব্যাটারিচালিত 'টুকটুক' অটোরিক্সাটি। এগিয়ে গেলাম বিশাল স্থাপনাটার দিকে, জানলাম জায়গাটাকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দীর্ঘ নয় মাস হানাদার বাহিনী কর্তৃক স্লটার হাউজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিলো... হ্যাঁ, কসাইখানা কিন্তু মানুষ হত্যার। ভাবছিলাম বা আরো স্পষ্ট করে বললে চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো -- সাধারণ মানুষ, ছাত্র, খেটে খাওয়া দিনমুজুর, খুচরো ব্যবসায়ী, হিন্দু অথবা মুসলমান, কখনো বা মুক্তিযোদ্ধা... অজানা অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর আতংক মাখা করুণ মুখ! যাদের রোজ এখানে ধরে এনে নির্বিচারে গরু-ছাগলের মত জবাই দিয়ে পাশের ময়ূর নদীতে ফেলে দেয়া হতো!! পৃথিবীর তাবৎ অনাচার একদিন ঠিকই প্রকাশ পায়, এই নৃশংসতার কাহিনীও চাপা থাকেনি বেশিদিন, যুদ্ধের পর পাশের ছোট্ট নদীটিতে পাওয়া যায় হাজারে হাজারে নরকঙ্কাল, যাদের পরিচয় কোনদিন জানা যায়নি, জানা যায়নি তাদের নির্দিষ্ট কোন সংখ্যাও। কারণ কীটপতঙ্গের মতো বাঙ্গালীনিধনে মেতে থাকা পাকি কুত্তারা ও তাদের সেবায় নিয়োজিত এদেশেরই কিছু শুয়োর মিলে যখন পুরো বাংলাকেই মানুষ মারার কসাইখানায় পরিণত করেছিলো, তখন তারা এসব হত্যাকাণ্ড বা নিজের পাপের হিসেব কোথাও রাখবে না, সেটাই স্বাভাবিক।
 
 
গল্লামারি স্মৃতিস্তভের কথা বলছি, বলছি এই রক্তস্নাতা ভূমিটির কথা। এখনো কান পাতলে যেখানে আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয় সেই হাজারো অজানা শহীদের গোঙ্গানি। ৭১-এ ঘটে যাওয়া বীভৎস সব গণহত্যাগুলোর মধ্যে খুলনার চুকনগরের কথা কিছুটা জানা থাকলেও, সত্যি বলতে গল্লামারির ইতিহাস আমার জানা ছিল না। পরবর্তিতে এই গল্লামারির তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়েও খুব হতাশ হয়েছি, কোথাও নির্দিষ্টভাবে এর কোন উল্লেখ নেই দেখে।

 








   

৭১-এ এই খুলনার ক্ষতের মাত্রাটা ছিলো তুলনামূলক কিছুটা বেশি। তাজা দেড়লক্ষ প্রাণ বা কে জানে হয়ত তারও বেশি। ভারত-বাংলাদেশ বর্ডার সংলগ্ন ডুমুরিয়া থানার অন্তর্গত এক চুকনগরে একদিনে ঘটে যাওয়া নারকীয় গণহত্যা শুধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ও নৃশংস একটি গণহত্যা নয় বরং পৃথিবীর আর কোথাও একদিনে একসাথে এত ব্যাপক কোন হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে কিনা এ ব্যাপারে সন্দেহ আছে। যেখানে মুহূর্তে মেরে ফেলা হয়েছিলো দশ হাজার বা তারও বেশি মানুষ। প্রাণের ভয়ে বর্ডার পার হতে জড় হওয়া নিরপরাধ-নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ!



মার্চের পর থেকে পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী যখন মোটামোটি পুরো দেশ জুড়েই গণহত্যা শুরু করে দেয়, তখন প্রথম ধাক্কায় দেশ থেকে হিন্দুরা দলে দলে পালাতে থাকে ভারতে। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে স্থানীয় দালালদের হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, অগি্নসংযোগ বেড়ে যাওয়ায় বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, খুলনা, সাতক্ষীরা থেকে আনুমানিক ৭১ হাজার শরণার্থী বর্ডার পার হতে জড় হয় বাংলাদেশ-ভারত শীমান্তবর্তী ব্যবসাহিক অঞ্চল এই চুকনগরে, তাদের মধ্যে কিছু পার হয়েও গিয়েছিলো, আর বাকিরা সেদিন ২০ মে সকালে নৌকায় নোঙর করছিলো। স্থানীয় বাঙ্গালী দালাল ও বিহারীদের মাধ্যমে পাকিস্থান বাহিনী খবরটা জানতে পারে, এবং তাদেরই সহযোগিতায় সেখানে পৌছে এই বিশাল হত্যাযজ্ঞ চালায়। সারে সারে লাশের স্তুপ... মৃত মায়ের কোলে লেপ্টে থাকা মৃত সন্তান, মৃত স্বামীকে আকড়ে রাখা মৃত স্ত্রী, মৃত পিতার বুকে লুকানো মৃত কন্যা... এভাবেই মুহূর্তে প্রাণমুখর একটি অঞ্চল পরিণত করা হয়েছিলো মৃত নগরীতে। কয়েক ঘন্টা ব্যাপী আবিরাম গুলি বর্ষনে এতোগুলো মানুষের তুলনায় যখন ফুরিয়ে এসছিলো দানবগুলোর বুলেট তখন বেনোয়েট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা শুরু করে বাকিদের... হতভাগাদের রক্তের ধারা মিশে হয়ত লাল হয়েছিলো ভদ্রা নদীর পানি পর্যন্ত... এতো লাশের যায়গা হয়ত হয়নি নদীটির বুকে, তাই এখনো এখানকার জমিতে লাঙ্গল দিলে উঠে আসে মানুষের হাড় কখনো বা স্বর্ণালংকার। আরো জানুন এখানে

একটি দেশ, মানচিত্র ও পতাকার মূল্য এ মাটিকে যতখানি দিতে হয়েছে, পৃথিবীর আর কোথাও ততখানি দিতে হয়েছিলো কিনা আমার জানা নেই। এত বিশাল হারানোর ভার নিয়ে আজ আমি গর্বিত হতে পারি না, বরং আমার লজ্জা হয়, পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল এই ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞগুলো আজ ৪১ বছর পরেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের দলিল-দস্তাবেজে যথাযথ ঠাঁই পায় না দেখে। লজ্জা হয় প্রশাসনের টানাপোড়ন, অনীহা ও বিলম্বীকরণ দেখে। একদিনে সংঘটিত পৃথিবীর বৃহত্তম গণহত্যার নাম হিসেবে ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছে ভিয়েতনামের মাইলাই। মাইলাইয়ের গণহত্যায় মারা যায় প্রায় ১৫০০ মানুষ। আর চুকনগরে কম করেও হলে ২০ মে গণহত্যার শিকার হয়েছে ১০ সহস্রাধিক মানুষ। তবু পৃথিবীর কোন ইতিহাসে এই গণহত্যার স্থান মেলেনি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকারের 'স্বাধীনতার দলিল' নামে ১৫ খণ্ডে লিখিত যে দলিল রয়েছে, সেই ১৫ খণ্ডের কোথাও চুকনগরের গণহত্যার স্থান হয়নি (২০১০ সালের সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী)। কেন হয়নি? এই ব্যাপক নৃশংসতার ইতিহাস চেপে রেখে আদতে কার লাভ? এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?

লেখাটা আমার অন্যান্য অসমাপ্ত লেখার মতই এভাবে আধা-আধুরা, পরিত্যক্ত পড়ে থাকত ল্যাপটপটার নোটপ্যাডের কোনো এক ফোল্ডারে, স্নায়ুচাপ থেকে রক্ষাপেতে যেটাকে কৌশলে এড়িয়ে যেতাম বারবার। যদিনা গত কয়েকদিনের ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনায় মনটা ভীষণভাবে আবার অস্থির হয়ে উঠত...

কত মানুষের মুখোশ যে খুলে গেল এরই মধ্যে! প্রতিটা মানুষের চেহারা যেমন ভিন্ন তেমন একজনের সাথে আরেকজনের চিন্তাজগতের তফাৎ থাকবে সেটাও স্বাভাবিক। কিন্তু তারপরেও কোথাও কোনো এক বিন্দুতে এসে কোনো এক সামগ্রিক চেতনা দাবী করে যে আমরা জাতি হিসেবে আসলেই মানুষ, সেইসব ককুরের বা শুয়োরের বীর্য থেকে আমাদের জন্ম নয় (আমি দুঃখিত, বারবার সাধারণ প্রাণীগুলোকে অপমান করছি)! আমি বোকা ছিলাম, ছিলাম মূর্খের মত আবেগি... ভেবেছিলাম আমার ছোট্ট দেশটার প্রতিটা মানুষ বুঝি আমার মতই সমান ঘৃণা আর লজ্জা নিয়ে এতদিন সহ্য করে আসছে ঐ গলার ঘ্যাগ হয়ে টিকে থাকা নিলজ্জ-বেহায়া নরপশুগুলোকে। ভেবেছিলাম এক রাজকারের ক্ষমাহীন অপরাধের বিচারে আজ সবাই একসাথে উল্লসিত, জ্বলে উঠেছে সেই পুরনো চেতনায়। কিন্তু আমি ধাক্কা খেলাম, থমকে গেলাম... মানুষের অকৃত্জ্ঞতা দেখে, বধিরতা দেখে। একটা স্বাধীন দেশ, মুক্ত আলো-বাতাস পেয়ে আমরা আজ ভুলে গেছি এই স্বাধীনতা অর্জনের গল্প। ভুলে গেছি নিজেদের দায়বদ্ধতা! আমার লজ্জার পাল্লাটা এবার নুয়ে পড়ে মাটি স্পর্শ করে।

আজ যারা ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করছে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যে গঠিত ট্রাইব্যুনালটি নিরপেক্ষ নয় তারাও গলায় জোর এনে বলার সাহস পায় না যে, আজন্মাগুলোর বিরুদ্ধে আনা ৭১-এর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ভিত্তিহীন। তারপরেও অবাক লাগে যে মানুষগুলোকে আজ অব্দি কখনোই দেশের ছোট-বড় কোনো বিষয়ে তেমন উদ্বিগ্ন হতে দেখি নাই, তারাও আজ চুল-চেরা বিশ্লেষণে লেগে পড়ে কেন এই বিচারকার্যে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। তাদের মতে বিচার তারাও চায় কিন্তু তা হতে হবে একশভাগ নিরপেক্ষ, অভিযুক্তদেরও যেন নিজের সমান 'সে' থাকে। তারা দেশের আশু বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি, শিবিরের তান্ডব/প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভীষণ চিন্তিত, যে কারণে এখন থেকেই 'যুদ্ধপরাধীদের বিচার' বিষয়টিকে ইস্যু বানিয়ে রাজনৈতিক জল ঘোলা করতে পারলে নিজেরাই পানিতে নেমে পড়ে।

একবার না একহাজারবার তাদের আত্নপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হবে, কিন্তু তারা বা তাদের চামচারা কি অন্তত একবার বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে যে ষোলোশো কিলোমিটার দুর থেকে উড়ে আসা পাকি হায়েনাদের দীর্ঘ নয় মাস ধরে তারা স্বজাতির মাংসের যোগান দিয়ে যায়নি? তারা কি একবার বলতে পারবে তাদের হাত, অন্তর নিজ অঞ্চলের এরকম লাখে লাখে নিরপরাধ/নিরস্ত্র মানুষের (নারী/শিশুর) রক্তে কুলষিত নয়? তারা কি ফিরিয়ে দিতে পারবে সেই কৃতিসন্তান বা বুদ্ধিজীবিদের অন্তত একজনকে? তারা কোন মুখে অস্বীকার করবে ক্ষমাহীন ২৫ শে মার্চ বা ১৪ ই ডিসেম্বর? কয়টা গল্লামারি, চুকনগর তারা অস্বীকার করবে? কয়টা ময়ূর অথবা ভদ্রা নদীকে তারা অস্বীকার করবে? -- এই পাপের বোঝা নিয়ে হাজার মানুষের অভিশাপ, ঘৃণা নিয়ে আজ অব্দি তারা বেঁচে আছে কেমন করে!! ধর্মে যথার্থ বলা হয় শয়তানের আয়ু অসীম!

সেসময়ের শক্তিশালী পাকিবাহিনীর পা-চাটা কুকুরগুলো নিজের সুবিধাজনক অবস্থান পাকাপোক্ত করতে পরিণত হয়েছিলো স্বজাতির মাংস খুবলে খাওয়া শকুনে, এখনো সুযোগ পেলে আমাদের হারানোর মাত্রাটা তারা বারবার নিয়ে দাঁড় করায় সম্পূর্ণ অপূরণীয় এক অবস্থায়। যাদের অনেক আগেই ফাঁসির কাষ্ঠে তুলে দীর্ঘ চার দশক ধরে এই দমবদ্ধকর লজ্জার বোঝা বয়ে বেড়ানোর হাত থেকে জাতিকে মুক্ত করা উচিৎ ছিলো, তারাই পেয়েছে এই সেলুকাস দেশে এ-গ্রেড নাগরিকের মর্যাদা, তাদের থাকে সদা সক্রিয় সংগঠিত ইনডোর আউটডোর বেক-আপ, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক শক্তি, যা এখনো তাদের রক্ষায় নিয়ে যাচ্ছে একের পর এক চোরা পদ্ধতির আশ্রয়। আমি অবাক হবো না যদি দেখি শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন আজাদের মতো আজ প্রিয় জাফর ইকবালকেও হঠাৎ কোন চোরা হামলা বা গুপ্ত হামলার শিকার হতে হয়। তারপর হয়তো এরকমই মুখোশধারী কোন সুশীলকে আমরা বলতে শুনবো -- যথার্থই হয়েছে বড্ড বেয়াড়া কথাবার্তা শুরু করেছিলো মুনাফিকটা!

যে পতাকার বিরোধিতা তারা করেছিলো আজ এতদিন পরেও সেই পতাকার সমুন্নত রূপ মেনে নিতে তাদের কষ্ট হয়, তাদের বুক ফেটে যায় রক্তের তৃষ্ণায়, চোখ জ্বলে যায় হিংসায়। যে কারণে সেই স্বাধীন দেশেই নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে অক্টোপাসের মত আষ্টেপৃষ্টে ছড়িয়ে রেখেছে নিজেদের বিষাক্ত শেকড়। অথচ যারা নিজের সবটুকু দিয়ে এই দেশকে এনে দিলো স্বাধীনতার লাল সূর্যটা, সেই মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ পরিবারগুলোকে হয়তো থাকতে হয় অজানা দীর্ঘশ্বাস চেপে, আধপেটা খেয়ে, খড়কুটোর আশায় বুক বেঁধে... একদিন তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষায় অর্জিত প্রিয় ভূমিটি ঐ জারজগুলোর ভারমুক্ত হবে, একদিন বাংলার প্রতিটি রাজকার, আলবদরের বিচার হবে!

আমার গা জ্বলে আসরে নিরব শ্রোতার ভূমিকায় থাকা বাকিদের উপর বেশি। নিজের পুতুপুতু ভালমানুষী বা জী-হুজুরি ইমেজ রক্ষায় যারা অত্যন্ত্ সচেতন। চারিদিকে অনুভূতিশূন্য জড়পদার্থের ভিড় দেখতে দেখতে আমার হাঁসফাঁস লাগে! আশ্চর্য ব্যাপার! এদের আসলেই কখনো কিছু বলার থাকেনা। যেন বসে বসে তামাশা দেখাই তাদের অন্যতম প্রিয় কাজ, তামাশাই তো বটে। গণহত্যার ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর এক ক্ষুদ্র অংশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) নেমে আসা সবচেয়ে বড় নৃশংসতা, ম্যাসাকার আর কালচক্রান্তের সীমা লঙ্ঘন করে একটি জাতিকে পুরো পঙ্গু করতে তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা, বেহিসাবী ধর্ষিতাদের আর্তনাদ চোখের জলে ধুয়ে আসা স্বাধীনতা প্রকৃত অর্থে আজ তামাশা! তাও ভালো এই সো-কল্ড ভালো মানষি রূপ আমাকে কখনো নিতে হয়নি দেখে আজ সত্যি আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

তাদেরই বলছি -- হয়তো অসংখ্যবার আপনারা এই বধ্যভূমিগুলোর কথা শুনেছেন। নানা প্রয়োজনে এ পথ ধরে হেঁটেও গিয়েছেন। কখনো একটিবার, একটিবারও কি আপনাদের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠেনি? মন বিষিয়ে ওঠেনি সেই খুনি এবং খুনির দোসরদের উপর? কখনো কি মনে হয়নি এই অন্যায়ের বিচারে কোনো আপোষ নাই, কোনো বিকল্প নাই? কখনো এই স্তম্ভের দিকে তাকিয়ে নিজের ভিতরে তীব্র কিছু কি গর্জে উঠেনি? মনে আসেনি কোনো প্রতিজ্ঞাবোধ? এক বীরত্বগাঁথা ইতিহাসের কাপুরুষোচিত উত্তরসূরি হয়ে ধুঁকে ধুঁকে টিকে থাকার চেয়ে, না হয় দেশের সবচেয়ে ভালোটার জন্যে সবচেয়ে খারাপটাকে দেখে নিলাম আর একবার! একবার ভাবুন তো, চল্লিশ বছর আগেই যদি এই বেজন্মাগুলার বিচার হয়ে যেত, তাহলে পুষে রাখা এই কালসাপের বিষাক্ত ছোবলে বারবার কি ক্ষতবিক্ষত হতে হতো প্রিয় জন্মভূমিকে? আফসোস হয় কি?

ভিনদেশী হয়েও এক অ্যালেন গিনসবার্গ বা জর্জ হ্যারিসনের হৃদয়ে সেসময়ে বাঙ্গালীর দুর্দশা দেখে যে পরিমাণ রক্তক্ষরণ হয়েছিলো, তার কতটুক ছুঁয়ে যায় আজ আমাদের?










   

মৌসুমি ভৌমিকের সুরে যশোর রোড বাংলায় -










   


আমার রাগ লাগে যখন দেখি প্রত্যক্ষ বা প্ররোক্ষভাবে কেউ রাজাকারদের পক্ষ নেয়ার চেষ্টা করে তাদের উপর, আমার ঘৃণা হয় তাদের উপর যারা সত্য জেনেও চুপচাপ মৌনবাবাজী সেজে তাদের কথায় সায় দিয়ে যায় কোন প্রতিবাদ ছাড়াই, আমার লজ্জা হয় তাদের নপুংশকতা দেখে, আমার করুণা হয় তাদের মেরুদন্ডহীনতায়। আমার থুথু দিতে ইচ্ছে করে তাদের মুখে যারা মুক্তিযুদ্ধ/মুক্তিযোদ্ধা/স্বাধীনতার বিপক্ষে কথা বলে।


-----------------------------------------------------------------------------------------

বাংলাদেশ (পর্ব-২)

বাংলার আদি ঐতিহ্য ও সভ্যতার পন্ড্রুবর্ধন বা বরেন্দ্রভূমি এই রাজশাহী। যুগ যুগ ধরে বিশাল পদ্মার তীর ধরে পৃথিবীর কত প্রান্ত থেকে কত মানুষ এসে বসতি গড়েছে এখানে, রেখেছে স্ব স্ব ঐতিহ্যের ছাপ। রাজশাহির আনাচে কানাচে নানা উপজাতির বাস, তাদের ভিন্ন জীবন প্রণালী আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা প্রাচীন নিদর্শন তারই সাক্ষ্য বহন করে।



কুবেরের রূপোলি আঁশের ইলিশের পদ্মা! "পদ্মার ঢেউরে মোর শুন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা" - নজরুল জানে নাই এই পদ্মার ঢেউ একদিন থেমে যাবে, পদ্মার হৃদয় চিরে জেগে উঠবে আদিগন্ত শূন্য বেলাভুমি, বিবর্ণ মুখে উপহাস করবে একদার এই উচ্ছলা, প্রানবন্ত, অবাধ জলরাশির ভরাযৌবনা পদ্মার! শত শত বছর ধরে যা দিয়েছে মানুষের জীবন-জীবিকার সন্ধান, যুগিয়েছে সাহিত্য সাধনার খোরাক। আজ এই পদ্মার বুক জুড়ে শুধুই মানুষের নির্মমতার হাহাকার!
রাজশাহী এসে প্রথমে আমাকে যা মুগ্ধ করলো তা হলো রাজশাহী ষ্টেশনটি। বাংলাদেশের রেলযোগাযোগ মাধ্যমের প্রকৃত অবস্থা অন্তত এই ষ্টেশনটি দেখে বোঝার উপায় নাই। এটি কেবল আধুনিকই নয় বরং বাংলাদেশের অন্যান্য ষ্টেশনগুলোর তুলনায় পরিচ্ছন্ন। যা দেখে দেশে জীর্ণদশা এই মাধ্যমটির উপর একটু হলেও নতুন আশা জাগে, আবার পরক্ষণেই মনে পড়ে বীরগঞ্জ থেকে সন্ধ্যা ৮টার ট্রেন সৌভাগ্যক্রমে রাত ২টায় পেয়েছি, এই দীর্ঘ সময়টা ছোট বাচ্চা নিয়ে আমাদের কাটাতে হয়েছে অস্বাস্থ্যকর অন্ধকার ষ্টেশনটির মধ্যে, কারণ প্রায় পুরোটা সময় সেখানে কারেন্ট ছিলো না। নিজের মনে সান্তনা দিচ্ছিলাম এই ভেবে- এ তো মানুষের রোজকার ভোগান্তি, আমি একদিন দেখলাম! সে সময় মাথায় শুধু একটা কথাই ভাসছিলো, আমরা নিরাপদ সড়ক, যানজটমুক্ত জীবনের জন্য এত কথা বলছি, এত কিছু ভাবছি, অথচ সে একই কারণে কেন দেশের রেলযোগাযোগ মাধ্যমকে সচল ও পুনরুজ্জীবিত করতে সমান ভাবে আওয়াজ তুলছি না? এটাতো স্পষ্ট যে, এই বিশাল জনগোষ্ঠীর চাপ দেশের রাস্তাগুলো থেকে কমাতে না পারলে 'নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ সড়ক' করে মুখে ফেনা তুলে ফেললেও লাভের লাভ কিছু হবে না। আর সড়কের উপর চাপ কমানোর একমাত্র উপায় হলো সারাদেশের অচলপ্রায় মুখ থুবড়ে পড়া রেল ব্যবস্থা পুরো উদ্দমে চালু করা।

ঢাকা শহরে যানজট কমাতে বিশাল বিশাল সব ফ্লাইওভার বানানো হচ্ছে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, দেখতে ভালোই লাগে। কিন্তু যে পরিমানে প্রাইভেট গাড়ি প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় নামেছে, তাতে আদৌ কি এই ক্রমবর্ধমান যানজট সামাল দেয়া সম্ভব! আর রাস্তাগুলোতে দেদারসে চলে বেড়ানো ত্রুটিপূর্ণ আনফিট যাত্রীবাহী যানগুলোর দৌরাত্ব দেখে মনে হয়, এর বদলে ঢাকা ও এর আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে এবং সাথে অবশ্যই দেশের অন্য বড় শহরগুলোতেও যদি অভ্যন্তরীণ মেট্রো ট্রেন সার্ভিস চালু করা যেত, ষ্টেশনগুলোর মানোন্নয়ন করে সব শ্রেণীর মানুষের উপযোগী করা হত , মান্ধাতার আমলের ট্রেনগুলোর সাথে যদি কিছু নতুন সার্ভিস চালু করা যেত, প্রয়োজনে পরিকল্পিতভাবে নতুন ট্র্যাক স্থাপন করে মোটকথা পুরো সিস্টেমটিকে ঢেলে বর্তমান সময়ের চাহিদানুরূপ সাজানো হত, তাহলে দেশের সড়ক মাধ্যমটির উপর থেকে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর ভার অনেকাংশেই কমে আসত! পরিণামস্বরূপ দুর্ঘটনা, যানজট, রোজকার এই ভোগান্তির হাত থেকেও মানুষ রেহাই পেত বলে মনে করি।

আমার আলোচনা আবার অন্য ট্র্যাকে যাচ্ছে, আসছি মূল বিষয়ে।

‘বাংলাদেশ’ লেখাটি শুরু করেছিলাম দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী কান্তজীর মন্দির থেকে। এ পর্বে থাকছে রাজশাহী অঞ্চলের প্রাচীন বাঘা মসজিদ। পঞ্চাশ টাকা নোটে এই মসজিদটির ছবি দেখে আসছি সেই ছোটবেলা থেকে, সুযোগ হয়েছিলো মসজিদটিকে একেবারে কাছ থেকে দেখার।





রাজশাহী শহর থেকে ২৫ মাইল দক্ষিণে ঐতিহাসিক বাঘা মসজিদ অবস্থিত। মোঘলদের অনেক কীর্তি নিয়ে আমরা প্রায়শঃই গর্ববোধ করি, যেমন, এযাবৎ বাংলাদেশের তিনটি ওয়াল্ড হেরিটেজের একটি বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ, পুরান ঢাকার লালবাগের কেল্লা ইত্যাদি। হয়ত আমার বাংলাদেশ ভ্রমণে পরবর্তী পর্বগুলোতে এসবের উল্লেখ আসতে পারে। তবে আমার কাছে এগুলোর মধ্যে বাংলার নিজ ঐতিহ্যের প্রকৃত গর্বের দ্বাবিদার অবশ্যই এই প্রাচীনতম এই বাঘা মসজিদটি, কারন এটিকে আমরা আদি বাংলার নিজেস্ব ঐতিহ্য বলে নিঃসঙ্কোচে দ্বাবি করতে পারি। বাবর যেখানে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহীম লোদীকে পরাজিত করে ভারত দখল করে ১৫২৬ খ্রিটাব্দে, তারও অনেক পরে ১৫৫৬ র দিকে মোঘলরা বাংলায় প্রবেশ করে, সেখানে ১৫২৩ সালে বাংলার স্বাধীন সুলতান নাসিরুদ্দিন নুশরাত শাহের আমলে বাঘা মসজিদটি নির্মান করা হয়। তিনি ছিলেন আবদুল্লাহ হোসেন শাহের পুত্র অর্থাৎ হোসেন শাহি বংশের দ্বিতীয় সুলতান, বাবার মতই মোঘলদের আক্রমণ হতে নানা কৌশলে যিনি বাংলার ভূমিকে রক্ষা করেন। অর্থাৎ বাঘা মসজিদটি এ অঞ্চলে মোঘলদের আগমনেরও কয়েক দশক আগের প্রাচীন এক কীর্তি।মসজিদটি ভেতরে ও বাইরে পোড়ামাটির ফলক চিত্রের অপূর্ব নকশা দ্বারা অলংকৃত। যার আসল সৌন্দর্য্য কালের পরিক্রমায় অনেকটাই মুছে গিয়েছে।



প্রবেশের জন্য দুপাশে আকর্ষণীয় দুটো বিশাল ফটক, যা একই সাথে একই আদলে তৈরী করা হয়েছিলো, এগুলোর মধ্যে পোড়ামাটির নকশার কাজগুলো আজ অদৃশ্য।



১৮৯৭ এর শক্তিশালী ভূমিকম্পে বাংলাদেশের অধিকাংশ পুরাতত্ত্বের বিবিধ ক্ষতি সাধন হয়, সেসময় বাঘা মসজিদের মূল ছাদটিও খসে পড়ে। পরবর্তীতে দেশের পুরাতত্ত্ব বিভাগ পুণরায় পাথরের পিলারে উপর বর্তমান একাধিক কাপ আকৃতির গম্বুজের ছাদটি নির্মান করে যা মসজিদটির ভেতর ও বাহিরের জৌলুশময় রূপটি আরো ফুটিয়ে তুলে। খুব সম্ভব এই একই ভূমিকম্পে বাংলার আরেক ঐতিহ্য কান্তজীর মন্দিরের আদি আকৃতির ৯টি চূড়াও ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।



টেরাকোটা বা পোড়ামাটির কারুকাজ - কান্তজী মন্দিরের মতই বাঘা মসজিদটিও বাংলাদেশের পোড়ামাটির ফলকে কারুকাজ বা নকশার জন্য উল্লেখযোগ্য একটি নিদর্শন, কিন্তু মসজিদটি আরো প্রাচীন হওয়ায় এখানকার অধিকাংশ নকশা প্রায় ক্ষয়প্রাপ্ত। আর ধর্মীয় কারণে এগুলো কোন পৌরাণিক কাহিনী বর্ণনা করে না। যদিও তা সেসময়ের সূক্ষ রুচি ও গাঢ় শিল্পবোধের পরিচয় ফুটিয়ে তুলতে অনবদ্য ভূমিকা রাখে।


যেভাবে প্রাচীন স্তম্ভগুলো টেরাকোটায় অলংকৃত ছিলো।


সম্মুখে এই সবুজ ঘেরা বিশাল প্রাচীন দীঘিটি মসজিদের চারপাশে একটি নির্মল শান্তির পরিবেশ আবিষ্ট করে রেখেছে যা মূলত খনন করা হয়েছিলো কৃষিজমিতে জলসেচের জন্য।



অসূর্য্যস্পর্শা নারীদের গল্প- এটি ছিলো সেসব নারীদের স্নানের পুকুর যারা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত রয়ে গেছে সূর্যের স্পর্শের বাইরে। বাড়ি হতে সুড়ঙ্গপথে তারা পুকুরে স্নান করতে আসত আবার সুড়ঙ্গপথেই ফিরে যেত। এই সৌরজগতের প্রতিটি গ্রহ-উপগ্রহ, জীব-জগত, ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ প্রতিটি বস্তুকণার মূল চালিকাশক্তি বা প্রাণ যেখানে সূর্য্য সেখানে এইসব নারীদের জীবন কতটা স্বভাবিক ছিলো এই সূর্য্য নামক কল্পিত পুরুষটিকে প্রত্যাক্ষিত করে! জানতে ইচ্ছা করে তাদের জীবন কেমন ছিলো, যারা কখনো আকাশ দেখেনি, শীতের সকালের নরম রোদ গায়ে মাখেনি, নদীতে ভাসেনি, খোলা মাঠে বন্ধুদের সাথে চি-বুড়ি, গোল্লাছুট খেলনি! সেই ঘেরা দেয়া গাছটির সাথে তাদের কি খুব বেশি পার্থক্য ছিলো, সুরক্ষার বেড়াজালে যে গাছটি এত অধিক পরিমানে ঢেকে দেয়া হয় যে তার প্রকৃতি প্রদত্ত স্বাভাবিক বৃদ্ধিই থমকে যায়, মুক্ত আলো বাতাসের অভাবে গাছটি বাহিরে নির্জীব ও ফ্যাকাশে হয়ে বেড়ে উঠে, তাহলে তার ভেতরে বা মনের উপর এর প্রভাব কতটা ভয়াবহ হতে পারে! হঠাৎ সে ঢাকা তুলে দিলেও গাছটি আর বাঁচেনা, জ্বলে য়ায়, কারণ সূর্য্যের প্রখরতা সহ্য করার মত মনের শক্তি তার অর্জিত থাকেনা! বাঘা মসজিদ থেকে কিছুটা দুরে অবস্থিত এই পুকুরটি নিয়ে কোনো ঐতিহাসিক দলিল পেলাম না। তবে পুকুর, সাথে ঝোপঝাড়ে ঢাকা সুড়ঙ্গ পথটি এবং পুকুরটি নিয়ে মানুষের প্রচলিত গল্প বা ধারনা, সহজে মিলে যায় একটির সাথে আর একটি। বাংলাদেশ পুরাতত্ত্ব বিভাগ এই পুকুরটি সংরক্ষণের চেষ্টা করছে, যদিও দেখে তা মনে হয়নি।



পুকুরটি থেকে কিছুদুর গিয়ে চোখে পড়ল আরেকটি প্রাচীন মসজিদ, যেটির ছাদও পুনঃস্থাপিত করা হয়েছে দেখে বোঝা যায়!






বাংলার অবারিত কচি ধানের মাঠ, মাটির সোঁদা গন্ধ, খোলা আকাশ আর কাশবনে ঢেউ খেলানো বুনো হাওয়া সব কিছুর খুব চেনা এক আকুল আবেদন মন ভুলিয়ে নিয়ে যায় দুরে- যেখানে আছে আমার ফেলে আসা দিন, নকশীকাঁথার মাঠ, রূপকথার দেশ, মাটির চুলোর ওম, দাদীর পান খাওয়া ফোকলা দাঁতের হাসি আরও অনেক কিছু!


পুরনো দুঃখ - আমি কেন শিশু হলাম না!

---------------------------------------------------------------------------------------------------

Friday 21 December 2012

যুগে যুগে কেয়ামত বেচে খাওয়ার অভিনব কায়দা

দক্ষিন ফ্রান্সের ছোট্ট গ্রাম বুগারাশ। জনসংখ্যা খুব বেশী হলে দু'শর মত। কোলাহল থেকে দুরে শান্ত, স্নিগ্ধ, প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে ভরা একটি গ্রাম বুগারাশ। কোন এক অদ্ভুত রহস্যজনক কারণে গত দু'বছর ধরে গ্রামটিতে বহিরাগতের সংখ্যা কিছুটা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গিয়েছে। ছোট্ট গ্রামটির ধারণক্ষমতার বাইরে এরূপ দলে দলে পর্যটকের আগমনে শুরু থেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে এখানকার মেয়র। জুল ভার্নের Journey to the Center of the Earth বা পাতাল অভিযানের বিখ্যাত সে পাহাড় যার ভেতরে লুকানো আছে পাতালে যাওয়ার রহস্যাবৃত এক পথ, যে পথের একমাথা দিয়ে ঢুকে আরেক মাথায় বেরুলে ঘটে যায় পারিপার্শ্বিকতার অভুতপূর্ব পরিবর্তন, সেই অজানা এক রহস্যপুরী ১২৩০ মিটার উঁচু পাহাড়টির নাম Pic De Bugarach। আর এই বুগারাশ পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত গ্রামটিই হলো বুগারাশ। জুল ভার্নের আরেক দুঃসাহসী উপন্যাস Clovis Dardentor এও আছে যার উল্লেখ। বর্তমানে অঞ্চল্টিতে জড়ো হওয়া লাখখানেক দর্শনার্থীর প্রধান আকর্ষণ মূলত এই পাহাড়টিকে ঘিরেই। তাদের বিশ্বাস পাহাড়টির ভেতরে বাস্তবেই অন্যজগতে যাওয়ার কোনো লুকানো পথ আছে।

যথারীতি কিছু সুবিধাভোগী মানুষের তৎপরতাও শুরু হয়েছে সেখানে জোরেশোরে। চলছে অথেনটিক বুগারাশ পাথরের সেল, স্থানীয় জলপ্রপাতের পানি বুগারাশের চোখের জল নামে বিক্রি হচ্ছে এক বোতল £১৫। খুব সাধারণ কোন বাড়ির দাম হাঁকানো হচ্ছে রাত প্রতি £১২০০! কেউ আবার সহৃদয়বান ব্যক্তি নিজের পরিত্যক্ত বঞ্জর ভূমিটিকে ক্যাম্পিংয়ের জন্যে ছেড়ে দিচ্ছে মাত্র ৩২৪ পাউন্ডেই। রাতারাতি কাঁচা টাকা কামানোর মোক্ষম সুযোগ ছাড়ছে না রেস্টুরেন্টগুলোও, সেখানেও চলছে নানা অফার, নানা তকমা।

যাইহোক যে কারণে এতো শোরগোল সেটাই বলা হলো না এখন পর্যন্ত, আর তা হলো -- আদিম মায়াদের দীর্ঘ ক্যালেন্ডারে সমাপ্তি হিসেবে রেখে যাওয়া '২১ ডিসেম্বর ২০১২' এর ঘাপলা! একদল শুরু থেকেই কৌশলে হাওয়া ছড়িয়ে আসছে এই নির্দিষ্ট দিনটিই পৃথিবীর শেষ দিন অর্থাৎ রোজ কেয়ামত। সে হাওয়াকে বাণিজ্যিক রূপ দিতে বরাবরের মতই তৎপর কিছু অতি ধুরন্ধর সুযোগসন্ধানী চক্র -- ম্যাগাজিন কাভারেজ, ব্লক বাস্টার মুভি, মিথ বা গুজবপ্রেমীদের জন্যে মাল্টি-মিলিয়ন ডলার বাজেটের ইউটিউব প্রোডাকশন এবং তা থেকে আরো অনেকগুণ বেশি প্রফিট ইত্যাদি...

আর তারই শেষ প্রফিটটা গুণছে বর্তমানে বুগারাশের এই সুবিধাভোগীরা, যেখানে শুরু থেকেই ছড়ানো হয়েছে বুগারাশই পৃথিবীর একমাত্র স্থান যা '২১ ডিসেম্বর ২০১২' এর মহাপ্রলয়ের হাতে হতে রক্ষা পাবে। বিষয়টিকে ধর্মীয়ভাবেও সমর্থন করে, বুগারাশকে ঈশ্বরের করুণাপ্রাপ্ত বিশেষ পবিত্রস্থান হিসেবে দাবি করেও আসছে একদল ধর্মযাজক। অনেকে আবার এই পাহাড়টিকে 'সুপার মাউন্টেন' হিসেবে উল্লেখ করে, তার চারপাশের রহস্য আরো ঘনীভুত করার চেষ্টা করছে, তাদের মতে পাহাড়টি ঘিরে আছে আশ্চর্য চৌম্বকীয় শক্তি, যা ভিনগ্রহীদের গোপন আস্তানা নির্দেশ করে। এমনকি তারা এখানে আশ্চর্যরকম রশ্মি, ভূগর্ভস্থ নানাবিধ শব্দ, সৈন্যসামন্ত, ফ্লাইং সসারের নিত্য যাওয়া-আসা দেখে বলেও দাবী করে। তারা এ পর্যন্ত কল্পনা করে রেখেছে যখন পৃথিবী ধ্বংস হবে, তখন এখানে অবস্থিত ভিনগ্রহীরা তাদের আস্তানাসমেত পুরো অঞ্চলটিকেই এখান থেকে তুলে নিয়ে যাবে, অতএব এভাবেই তারা নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে। অর্থাৎ যেকারণে কেয়ামতের ভয়ে দলে দলে লোক লোটা-বাটি হাতে পৌঁছাচ্ছে বুগারাশ পাহাড়ের সান্নিধ্যে!

'২১ ডিসেম্বরের ২০১২' সত্যি কি মায়ারা তাদের দীর্ঘ গণনায় এই দিনটিকে পৃথিবীর শেষদিন হিসেবে নির্ণয় করেছিলো?




আদিম মায়াদের রেখে যাওয়া ১,৩০০ বছর পুরনো এই ক্যালেন্ডারটিতে দিন গণনা শুরু করা হয়েছে খৃষ্টপূর্ব ৩১১৪ বছর থেকে যেখানে ৩৯৪ বছর সময়কালকে একেকটা 'বাকতুন' হিসেবে ধরা হয়েছে। মায়াদের কাছে ১৩ ছিলো একটা তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যা। আর ১৩ বাকতুন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ফলক যা পূর্ণ হয় ৫,১২৫ বছরের দীর্ঘ গণনার পর ২১ ডিসেম্বর ২০১২-এর কাছাকাছি, যা একটি পূর্ণচক্র বা অব্দের সমাপ্তি নির্দেশ করে। মায়াদের এই হিসেব মতে আসছে ২১ ডিসেম্বর পৃথিবী একটি চক্র অতিক্রম করতে যাচ্ছে, এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই যার পর আরেকটি নতুন চক্রের শুরু হওয়ার কথা। আমাদের প্রচলিত ক্যালেন্ডারের যেমন শেষ থাকে - '৩১ ডিসেম্বরের' পর কোনো মাস বা তারিখ থাকে না তারপর নতুন আর একটা বছরের শুরু হয় বিষয়টি খানিকটা সেরকম। অতএব ২১এ ডিসেম্বর পৃথিবীর শেষ দিন বা কেয়ামত এরকম কোনো ভবিষদ্বাণী মায়ারা করেনি, এটা স্রেফ একটা ভ্রান্ত ধারণা বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি মিথ!

এটা সত্য যে কেয়ামতকে চোখের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা এবং এটা নিয়ে জল্পনা-কল্পনাও মানুষের জন্যে নতুন কোন বিষয় নয়। যুগ যুগ ধরেই মানুষ অতি উৎসাহের সাথে পৃথবীর সম্ভাব্য ধ্বংসের একের পর এক দিন ধার্য করেই যাচ্ছে, লক্ষ্যণীয় যে এই ভবিষ্যৎবাণীগুলি ঠিক এমনভাবে করা হয় যেন, সেসময়ের প্রতিটি মানুষই সেই মহাপ্রলয়ের ভেতর নিজেকে দেখতে পায়, এবং নিজের করুণ পরিণতি ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এবার দেখা যাক কেয়ামত নিয়ে অতীতের কিছু চাঞ্চল্যকর পূর্বানুমান বা ভবিষ্যৎবাণী --



১। ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতঃ আমাদের আগে বুঝতে হবে, কেয়ামত বা পৃথিবীর শেষ বলতে আমরা আসলেই কি বুঝি? মৃত্যু, ধ্বংস? কিন্তু মৃত্যু, ধ্বংসের অর্থও মূলত সবসময় শেষ বা সমাপ্তি বোঝায় না। বরং অনেক সময় মৃত্যুও স্থান করে দেয় নতুন প্রাণের। ধ্বংসযজ্ঞের উপর জেগে উঠে নতুন প্রাঞ্জল সভ্যতার। এযাবৎ পৃথিবীর শেষ নিয়ে কিছুটা অভুতপূর্ব ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন প্রাচীন রোমান দার্শনিক সেনেকা যিনি মারা গিয়েছিলেন খৃষ্টপূর্ব ৬৫ সালে। এবং তার করা পৃথিবীর পরিসমাপ্তির অনুমানটি ছিলো, সমগ্র পৃথিবী ধোঁয়ায় ছেয়ে যাবে, যা খৃষ্টপূর্ব ৭৯ সালের ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাত ও পম্পেইএর মতো নগরীর ধ্বংসলীলার সাথে মেলানো হয়, যেন এরকম কিছুই নির্দেশ করেছিলেন দার্শনিক সেনেকা। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে এতো কিছুর পরেও শেষ কিন্তু আসেনি, এবং মানুষের জীবনও থেমে থাকেনি। বরং আরো দুই হাজার বছর পেরিয়ে মানুষ সেই ধ্বংসযজ্ঞের উপরই অবাক বিস্ময়ে খেয়াল করে নতুন প্রাণের স্রোত। "All we see and admire today will burn in the universal fire that ushers in a new, just, happy world,"



২। লন্ডনের বিশাল অগ্নিকান্ডঃ ইউরোপের খ্রীষ্টধর্মাবলম্বীরা ১৬৬৬ সালটি নিয়ে ভয়ে অস্থির ছিলো। কারণ বাইবেলে ৬৬৬ এই সংখ্যাটি অশুভ শক্তিধর শয়তানের সংখ্যা হিসেবে ধরা হয়। যা মেলানো হয় ১৯৬৫ সালে প্লেগ মাহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া এবং তার পরপরই যখন লন্ডনে ভয়াবহ আগ্নিকান্ডের ঘটনার সাথে। মানুষ ভেবেছিলো ঈশ্বরের অভিশাপ কেয়ামতের রূপ নিয়ে নেমে এসে সবকিছু তছনছ করে দিয়ে গেছে। অথচ তারপরেও কেটে গেছে আরো কয়েক শতাব্দী। কিন্তু 'শেষ', সে কোথায়? লন্ডনসহ পুরো পৃথিবীই তো আছে এখনো দিব্যি!



৩। ১৯১০ সাল, হ্যালির ধূমকেতুঃ হ্যালির ধূমকেতুর আবির্ভাব হয় প্রতি ৭৬ বছর পরপর। যাকে ইতিহাসে বরাবরই দুর্যোগের শকুন হিসেবে মনে করা হয়েছে। ১৯১০ সালে এটি আবির্ভাব হলে ইউরোপ-আমেরিকায় ব্যাপক সোরগোল পড়ে যায় যে এটার লেজে এমন বিষাক্ত গ্যাস আছে যার কারণে পৃথিবীর মানুষের ভয়ানক হিস্টিরিয়া শুরু হবে। ফ্রান্সের জ্যোতির্বিজ্ঞানী Camille Flammarion ভবিষ্যৎবাণী করে বসলো যে, এর প্রভাব পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উপর এতো ভয়াবহ হবে যে, সব প্রাণই হুমকির মুখে পড়ে বিনাশ হবে। যথারীতি মায়া ক্যালেন্ডার কন্সপিরেসির মতই এখানেও কিছু সুবিধাবাদী চক্র এই ভবিষ্যৎবাণীর ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করতে থাকে -- মাস্ক, কমেট পিল, স্কাই রকেট, অক্সিজেন ইত্যাদির রমরমা ব্যবসা শুরু হয়ে যায়। মানুষও নিজেকে ও নিজের পরিবার রক্ষার তাগিদে ধূমকেতুর অতিক্রমের পুরো সময়টা ধরে নিজ বাসায় এসবের সরবরাহ মজুদ রাখে। বিশেষ করে রোমে এমনটা বেশি হয়েছিলো।



৪। হেল-বব ধূমকেতুঃ এই অতি-উজ্জল ধূমকেতুটিকে আবিষ্কার হয় ১৯৯৫ সালে, এবং পৃথিবী থেকে এটিকে শেষ দেখা যায় ১৯৯৭ সা্লের মার্চ অব্দি। যাকে স্বরণ করা হয় এক করুন পরিহাসের ইতিহাস হিসেবে! এক ধর্মীয় গ্রুপ থেকে এই ধূমকেতুকে স্বর্গের দ্বার হিসেবে বিশ্বাস করা হয়ে আসছিলো, তাদের মতে পৃথিবী পরিচালিত হচ্ছে শয়তানের দ্বারা এবং খুব শীঘ্র শয়তান সবকিছুই ধ্বংস করে দিবে এবং এর থেকে উদ্ধারের একমাত্র উপায় হলো স্বর্গের উড়ন্ত দ্বারে আশ্রয় নেয়া। ক্যালিফোর্নিয়ার পাশ দিয়ে যখন এটি অতিক্রম করে তখন সেখানে ৩৯ জন মানুষ আত্নহত্যা করছিলো, পৃথিবীর প্রলয়কারী ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেতে বা ডাইরেক্ট স্বর্গে যাওয়ার আশায়। মায়া ক্যালেন্ডারে অনুমিত শেষদিন ২১ ডিসেম্বরের ২০১২ এ কেয়ামতের হাত থেকে রক্ষা পেতেও অনেকে আগে থেকেই এরকম আত্নহুত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। বিস্তারিত এখানে



৫। ৫-ই মে ২০০০ সালে সৌরজগতের পাঁচটি গ্রহের সারিবদ্ধ হওয়ার ঘটনাঃ এটা বেশীদিন আগের ঘটনা নয় বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি এবং শনি সৌরজগতের এই পাঁচটি গ্রহ সূর্য ও চন্দ্রের সাথে সরল রেখায় আসার ঘটনা জন্ম দেয় রোজকেয়ামতের মোটা-তাগড়া এক পূর্বাভাসের। কেউ অনুমান করে পুরো পৃথিবী বরফে ছেয়ে যাবে, আবার কারো মতে - ভয়াবহ ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, পৃথিবীতে নানা যায়গায় ফাটল দেখা দিবে... আতঙ্কে জমে যাওয়ার মত অবস্থা হয়েছিলো আমাদের অনেকের। আমরা তিন ভাইবোন মিলে একটা চিঠি লিখে জ্যামের বয়ামেও ভরে রেখেছিলাম! এখন যদিও হাসি পায় ঘটনাটা মনে পড়লে, কিন্তু বাস্তবতা হলো, মানুষের এই অনুভূতি বা আতংককে পুঞ্জি করেই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এসব কেয়ামতকে বেচে খাওয়া বাণিজ্য। তারপরেও এই বুড়ো গ্রহটা রয়ে গেছে বহাল তবিয়তে।

এবার ২১ ডিসেম্বর নিয়ে তৈরি হওয়া নানা হাইপোথিসিস, ভুয়া বিজ্ঞান বা 'pseudo-science' এর তেলেসমাতিঃ ২০১২ সালের কেয়ামতের গুজব বন্য আগুনের মতই অতি দ্রুত নানা শাখাপ্রশাখায় ছড়িয়ে পড়তে মূলত ঘিয়ের কাজ করে '2012' এর মত ব্লকবাস্টার মুভি ও বিজ্ঞানকে বিকৃতকরণের মাধ্যমে সহজে এই মিথ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলে ধরায় ব্যবহৃত বর্তমান প্রযুক্তি। সিউডো সাইন্সের হাইপোথিসিস মতে ২১ এ ডিসেম্বর পৃথিবী সম্ভাব্য ধ্বংসের কিছু বিস্ময়কর কল্পনার দৌড় -



১। পৃথিবীর সাথে নিবিরু অথবা প্ল্যানেট এক্স এর সংঘর্ষঃ এই গল্পটার শুরুই হয়েছিলো সুমেরীয়দের তথাকথিত গ্রহ নিবিরু আবিষ্কারের পর থেকে। শুরু থেকেই এই গ্রহটিকেও কেয়ামতের মতই পৃথিবীর উপর ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে অনুমান করা হয়েছিলো ২০০৩ সালের মে-তে এটা পৃথিবীর উপর আছড়ে পরবে যখন এরকম কিছুই ঘটলো না তারপর মায়া ক্যালেন্ডারের ২১ ডিসেম্বর ২০১২ এর কেয়ামতের হাইপোথিসিসের সাথে সুমেরীয় নিবিরুকে যোগ করা হলো। নিবিরু বা প্লানেট এক্স এর মত গ্রহের অস্তিত্ব যদি বাস্তবেই থাকত এবং পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষের অপেক্ষায় থাকত তো একটা অন্তত কয়েক দশক আগেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতো, আর এতদিনে তো এটাকে সবাই খালি চোখেই দেখতে পেতো।



২। উল্কাপিন্ডের তাণ্ডবঃ পৃথিবীতে এই উল্কা বা গ্রহাণুর আঘাতেই একসময় ডাইনোসরের মত প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটেছে ৬৫ মিলিয়ন বছর আগেই অতএব পৃথিবী ধ্বংস বা কেয়ামতের সাথে এই উল্কাঝড় বেশ যায়। কিন্তু নাসার বেরসিক জ্যোর্তিবিজ্ঞানীরা Spaceguard Survey নামে এক জরিপ পরিচালনা করে আসছে, যার কাজ হলো পৃথিবীর কাছের যেকোনো গ্রহাণুর অস্তিত্ব খুঁজে বের করা এবং প্রয়োজনে পৃথিবীতে কোনো হুমকী সৃষ্টির আগেই সেটিকে ধ্বংস করা। সেখান থেকেও নিশ্চিত করা হয়েছে আপাতত এক্সাইটেড হওয়ার মত কিছুই ঘটছে না, অর্থাৎ ২০১২ সালে কোনো উল্কা, ধূমকেতু, গ্রহাণু কিছুই পৃথিবীতে আঘাত করছে না। এই প্রক্রিয়াটি এতোই সোজাসাপ্টা যে আপনি নিজেও রোজ এখানে আপডেট পেতে পারেন NASA Near-Earth Object Program Office website।



৩। ধ্বংসাত্মক সৌরঝড়ঃ সূর্যে সৃষ্টি হওয়া প্রলঙ্কারী সৌর ঝড়ের একটি শিখাই যথেষ্ট পৃথিবীকে পুড়িয়ে ছার-খার করতে! আইডিয়াটা খারাপ না তবে সমস্যা হলো - সৌর গতিবিধি একটি নির্দিষ্ট চক্রের মধ্যেই আবর্তিত হয়, যা প্রতি এগারো বছরের কাছাকাছি সময় ঘটে থাকে। এই সময় সূর্যের সৃষ্টি হওয়া এই আগুনের ঝড় বড়জোরউপগ্রহনির্ভর যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ক্ষতি করতে পারে, তবে বর্তমানে গবেষকরা চেষ্টা করছে কিভাবে আরো প্রটেক্টেড সোলার স্টর্ম ইলেক্ট্রনিকস তৈরি করা যায়। বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছে ২০১২ সালে সৌরঝড়ের তেমন কোন ঝুঁকি নাই। পরবর্তী সৌরঝড় ২০১২ থেকে ২০১৪ এই ফ্রেমে ঘটবে, যা একটা স্বাভাবিক সৌর-চক্রের মতই অনুমান করা হচ্ছে। মানে এর সাথে অতীতের সৌরচক্রগুলোর কোন তফাৎ থাকবে না। আরো জানুন এখানে



৪। পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ চৌম্বকীয় রদবদলঃ আগেই বলেছি বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে গুজব-বেচনেওয়ালারা ইনোভেটিভ উপায়ে অধিক গ্রহণযোগ্য করে টোপ ফেলে মানুষকে বোকা বানিয়ে থাকে। ২১শে ডিসেম্বরের কেয়ামতের হাইপোথিসিসের সাথে আর এক ইনোভেটিভ সংযোজন হলো পৃথিবীর কোরের চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে বিশাল পরিবর্তন, যার প্রভাবে পৃথিবীর উপরিভাগ পুরাই ওলটপালট হয়ে যাবে, যেমন - উত্তর মেরু হয়ে যাবে দক্ষিণ মেরু, আর দক্ষিণ মেরু হয়ে যাবে উত্তর মেরু। কেয়ামত যেন সাক্ষাৎ পৃথিবীর মাটি ফুঁড়ে উঠে আসবে। ক্ষতিকর মহাজাগতিক রশ্মিগুলো আর ফিরিয়ে দেয়ার শক্তি আর এই গ্রহটার থাকবে না, স্যাটেলাইটগুলোও তাদের কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে। তাহলে কি হবে? আমাদের যাবতীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা - সবই এগুলোর ওপর নির্ভরশীল, তাই সবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। জিপিএস ছাড়া পৃথিবীর বিমানগুলো উড়তে পারবে না, মাটিতে বসে হাওয়া খাবে ইত্যাদি.. পৃথিবীতে দেখা দেবে বিশৃঙ্খলা, মৃত্যু, বিপর্যয়, কেয়ামত। নাসা বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর সবকিছু এভাবে আচমকা উল্টেপাল্টে যাওয়াটা পুরো অসম্ভব একটা ব্যাপার। আমাদের এই পৃথিবীর মহাদেশগুলো খুবই আস্তে আস্তে একটি থেকে আর একটি দুরে সরে যাচ্ছে, কিন্তু এটার সাথে দুই মেরুর অবস্থান পরিবর্তনের কোন সম্পর্ক নাই। পৃথিবীর পোলারিটি এতো দ্রুত পরিবর্তন হওয়া সম্ভব না, যা হতে পারে প্রায় ৪,০০,০০০ বছরে একবার। আর তাছাড়া বিজ্ঞানীরা মনে করেন আগামী কয়েক হাজার বছরে এই পোলারিটি পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনাও নাই।

এবং রোজ রোজ জন্ম নেয়া কেয়ামতের এরকম আরো অনেক কল্পনা, যার প্রতিটির সাথে পেরে উঠায় লাগে অসীম ধৈর্য্য আর সময়, যতক্ষণে বিজ্ঞানীরা একটা ভ্রান্তধারণা যুক্তি ও বিশ্লেষন দিয়ে খণ্ডাতে ব্যস্ত ততক্ষনে কল্পনাবাদীরা হাজারটা কল্পনায় তকমা লাগিয়ে সাধারণ মানুষের সামনে পরিবেশন করেই যাচ্ছে।

অতএব এত গেঁজানোর পর আমরা আসলে কি কি জানলাম -

১। আসছে ২১শে ডিসেম্বর এই বিশেষ দিনটিতে কোন বিশেষ ঘটনাই ঘটতে যাচ্ছে না, তবে যেহেতু দিনটি শুক্রবার পড়ছে তো নিঃসন্দেহে ফ্রাইডে নাইট পার্টি হতে পারে।
২। কোনো আদিম সভ্যতা, নবী-রাসুল বা কেয়ামতের তত্ত্ব প্রদানকারী সূত্র এখন পর্যন্ত পৃথিবী ধ্বংসের নির্দিষ্ট কোন দিন প্রমাণ করতে পারে নাই, তাই অতীতের ভুল প্রমাণিত নানা অনুমান থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত।
৩। তারপরেও যথারীতি একদল আতঙ্কিত মানুষ বরাবরের মতই সব কিছুতেই কেয়ামতের আলামত খুঁজতে থাকবে।
৪। উত্তরোত্তর উন্নত প্রযুক্তির কল্যাণে আরো ক্রিয়েটিভ ও ইনোভেটিভ উপায়ে এই কেয়ামত আতঙ্কে হরহামেশায় ঘি ঢালার চেষ্টা চলতে থাকবে।
৫। এবং এই সুযোগে সুবিধাবাদীরা তাদের পকেট ভরতে থাকবে। ২১শে ডিসেম্বর পৃথিবীর যাই হোক না কেন এধরণের সুবিধাবাদী/সুযোগসন্ধানীদের পকেট কিন্তু ইতোমধ্যে লাল!

মূলকথাঃ

আপাতত কেয়ামতের চেয়ে বেশি আতঙ্কের বিষয় হলো মানুষের সেইসব অন্ধবিশ্বাস বা ভ্রান্তধারণা যা কোন বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দিয়েও দুর করা সম্ভব না। তার উপর বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে খুব সহজেই এরকম ভুরিভুরি ভুয়া বিশ্লেষণ হাজির করা সম্ভব তাদের অন্ধবিশ্বাসের খোরাক যোগাতে। আর এই ফাঁকে হয়তো পৃথিবীর প্রকৃত কিছু সমস্যা যেগুলোতে আসলেই মানুষের নজর দেয়া প্রয়োজন তাই তাদের নজর এড়িয়ে যায়, যেমন - পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তন, তাপমাত্রার পরিবর্তন, নানা প্রজাতি (প্রাণী, গাছ) বিলুপ্তি, প্রকৃতির চেইন ধ্বংস ইত্যাদি। যে সমস্যাগুলোর জন্যে মানুষ নিজে দায়ী হলেও দিনদিন তা চলে যাচ্ছে মানুষের আওতার বাইরে। যেগুলো আপাতত কেয়ামত না হলেও অদুর ভবিষ্যতে কেয়ামতের চেয়ে কোন অংশে কম ভয়াবহ পরিণাম বয়ে আনবে না। অর্থাৎ কেয়ামত কোন আকস্মিক আরোপিত দুর্যোগের চেয়ে নিজে বয়ে আনা অপরিণামদর্শী ফলাফলও হতে পারে। অথচ তা নিয়ে কেয়ামতবাদীদের খুব বেশী চিন্তিত মনে হয়না।

যাইহোক পৃথিবী তো একদিন ধ্বংস হবেই, আরো চার বিলিয়ন বছরের কাছাকাছি সময় যখন সূর্যের মজুত হাইড্রোজেন গ্যাসের পরিমাণ শেষ হয়ে আসবে। যখন আমাদের কাছের এই নক্ষত্রটি বেলুনের মত ফুলতে শুরু করবে গ্রাস করবে আশেপাশের সব গ্রহ উপগ্রহকে। পৃথিবী পরিণত হবে টোস্টে। আপাতত এইটাই একমাত্র পৃথিবীর শেষ বা কেয়ামতের নিশ্চিত বিজ্ঞান প্রমাণিত সময়কাল। যা নিয়ে আমাদে্র এখনি উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। আর সেই একটি দিনের চিন্তায় জীবনের বাকি দিনগুলোও অর্থহীন করার প্রয়োজন নেই। তারচেয়ে এই সুন্দর নীল গ্রহটাকে কিভাবে আরো অনেকদিন মানুষের বসবাসের উপযুক্ত রাখা যায়, বরং তা নিয়ে ভাবি।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------

তথ্য ও ছবি সূত্রঃ
ন্যাশনাল জিওগ্রাফী
ডিসকভারি নিউজ
ইউনিভার্স টুডে
বিবিসি ও
নাসা

Wednesday 5 December 2012

ছবি যখন ফ্র্যাংকেনস্টাইন ফেক!

গত সোমবারে আমেরিকার উত্তর-পূর্ব কোণের অধিক সমৃদ্ধ ও বসতিপূর্ন এলাকায় আঘাত হানে শক্তিশালী ঘুর্ণিঝড় স্যান্ডি। ক্যাটাগরি দুই এই হারিকেনের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যায় নিউ জার্সি, নিউ ইয়র্কসহ গুরুত্বপূর্ণ জনপদের কোস্টাল এরিয়াগুলো। বিদ্যুৎ, সাবওয়ে ট্রেন সার্ভিস, রাস্তাঘাট, বন্দর ইত্যাদি ব্যাপক ক্ষেত্রে নজিরবিহীন ক্ষতির মুখে পড়ে অঞ্চলগুলো। Mary Shelley এর বিখ্যাত দানব Frankenstein যেন রূপ নিয়েছিলো সুপারস্টর্ম স্যান্ডির, তাই এর প্রাকান্ডতা বোঝাতে দেয়া হয় Frankenstorm নাম। বিশেষজ্ঞদের মতে ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে এটা শতাব্দীর ভয়াবহতম ঘুর্ণিঝড়, যা কমপক্ষে ৫০ মিলিয়ন মানুষের জীবনকে এনেছিলো হুমকির মুখে এবং তাদের জীবনযাত্রা ব্যাহত করেছে সম্পূর্ণরূপে। মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০০ তে, যারমধ্যে ৭০ জনই শিকার হয় ক্যারিবীয় উপকূলীয় আঘাতের। যাই হোক, স্যান্ডির ভয়াবহতা, রেখে যাওয়া ক্ষয়ক্ষতির হিসেব এসবের কোনোটাই আমার আজকের লেখার মূল বিষয় নয়। যে কারণে সব কাজ ফেলে এক প্রকার জোড় করেই লেখাটি লিখতে বসলাম তা কিছুটা ভিন্ন। ঠিক যে মুহূর্তে আমেরিকার উত্তর-পূর্ব উপকূল জুড়ে চলছে প্রচন্ড উষ্ণ অতলান্তিকীয় বায়ুর প্রভাবে হারিকেন স্যান্ডির তাণ্ডব, ঠিক সে মুহূর্ত থেকেই অতলান্তিকের এপাড়ে বসে কিছুটা উদ্বিগ্নতায় সাথে কুখ্যাত এই ঝড়টির আপডেট জানার চেষ্টায় খানিক পরপরই নেট গুঁতা-গুঁতি করে যাচ্ছিলাম। ঝড়ের ইমেজ ঘাঁটতে গিয়ে কমপক্ষে শ'খানেকের মতো আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যাওয়া ইমেজ চোখে পড়লো। এবং এক পর্যায়ে চোখ আটকালো ডিসকভারি নিউজের একটি আর্টিকেলে - Top 5 Fake Hurricane Sandy Photos। সচলে হয়তো অনেকেই এই ফেক ছবির বিষয় সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত আছেন। বিশেষ করে বর্তমানে এই ডিজিটাল যুগে যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা নানা চাঞ্চল্যকর ঘটনায় খুব দ্রুত ফেসবুক, টুইটারসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক মাধ্যমগুলোতে যেসব বানোয়াট মিথ্যে ছবিতে সয়লাব হয়ে যায়, আমার আজকের আলোচনা মূলত এধরনের কিছু ফেক ছবি নিয়ে।

এই ফেক ছবিগুলো বাস্তব ঘটনার সাথে মিল রেখে এতো নিখুঁতভাবে তৈরী করা হয় যে, আপনার পাকা চোখও একবারের জন্যে হলেও থমকে যেতে বাধ্য। আর শুধু সান্ডির বেলায় নয় এমন আপত্তিকর মিথ্যে ছবি প্রকাশিত হচ্ছে হরহামেশাই। আজকে এরকমই কিছু ছবি নিয়ে আলোচনা করবো। এই আলোচনায় ফটোশপের কাজ ছাড়াও যেসব ছবির বিষয়বস্তু মূলত সত্য কিন্তু ব্যবহৃত হয়েছে উদ্দেশ্য-প্রণোদিতভাবে মিথ্যে জায়গায়, তাকেও সমানভাবে ফেক ধরা হবে।

প্রথমে একদম 'ফ্রেশ ফেক' ডিসকভারির আর্টিকেলটিতে পাওয়া স্যান্ডির ফেক ছবিগুলো দিয়েই শুরু করিঃ

ছবি-একঃ

(Ominous Clouds Looming Over Statue of Liberty)

নিউ ইয়র্ক টাইমসের বড় বড় সব মহারথীরা উপরের ভুয়া ছবিটিকে হারিকেন স্যান্ডির ছবি বলে দিব্বি চালিয়ে দেয় নিজেদের ওয়েবসাইটে, টুইটারে। যা মূলত মাইক হোলিংশিডের ছবি নাব্রাস্কা সুপার সেল ও নিউ ইয়র্ক হারবার (ইন্ডিপেনডেন্ট ডে মুভি থেকে নেয়া) এর সংমিশ্রণে ঘুটা মারা এক উৎকৃষ্ট ফটোশপের নমুনা।

আসল ছবি

ছবি-দুইঃ

(Sinister Clouds Threaten to Swallow Empire State Building)

সত্য ছবি, মিথ্যে প্লট। ছবিটি স্যান্ডির ছবি হিসেবে ফেসবুক, টুইটারসহ অন্যান্য মাধ্যমে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে এটি ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ২০১১ এর ছবি।

আসল ছবি

ছবি-তিনঃ

(Waves Crashing On Statue of Liberty)

আরেকটি দ্রুত ও সহজ ফটোশপের নমুনা। অরিজিনাল ছবিটি 'দ্যা ডে আফটার টুমরো' মুভির ওয়ালপেপার।

মূল ছবি

ছবি-চারঃ

(Dark Clouds Rolling Over the George Washington Bridge)

জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজের উপর কালো মেঘের ঘনঘটা, ঝড়ের পূর্বের তীব্র চন্ডালরূপী আকাশ। ছবির উপাদানগুলো নিঃসন্দেহে পুরোপুরি সুপার স্যান্ডির সা্থে গেলেও বস্তুত ছবিটি নেয়া হয়েছে 'গেটি ষ্টক' ২০০৯ থেকে।

মূল ছবি

গেলো স্যান্ডি নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অসাধারণ অথচ ভুয়া কিছু ছবির কথা। প্রশ্ন হলো কেন এই প্রতারণার আশ্রয়? এতে আদৌ কি কারো কোনো লাভ হয়? উত্তর খুব সোজা আপনার বিনোদনের পাতে সবচেয়ে প্রথম ও আকর্ষণীয় খোরাকটি পৌঁছে দিতেই এত্তো হুড়াহুড়ি। উপরের ছবিগুলোর উদ্দেশ্য একটাই আর তা হলো সবার আগে মানুষকে এন্টারটেইন করার টেন্ডেন্সি, বাস্তবে দুর্যোগটির রূপ কেমন, কতজন মানুষ ঠিক সেই মুহূর্তে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসহনীয় মুহূর্ত পার করছে, তা নিয়ে প্রকৃতপক্ষে কোনো মাথা-ব্যথা এই ফেকার তথা বিনোদনকারীদের থাকে না। তাদের কাছে মানুষের কষ্ট-দুর্ভোগ-আহাজারি, বিপদ্গ্রস্ত জনপদ-সভ্যতা সবই শুধু নিউজ। আর তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে অপেক্ষাকৃত আকর্ষণীয় উপায়ে সবার আগে, প্রয়োজনে মিথ্যা মাল-মশলা-তকমা মিশায়ে। হু কেয়ারস! পাবলিক কিছু বুঝে উঠার আগেই তো কেল্লা ফতে!

তবে যাই বলি না কেন, একটা বিষয় অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এই ফেকাররা নিঃসন্দেহে ক্রিয়েটিভ, একটিভও বটে। যেকোনো বিষয়ে তাদের ক্রিয়েটিভিটি আর অ্যাক্টিভিটির উদাহরণ পদে পদে। তাদের ক্রিয়েটিভিটির একটি দারুণ উদাহরণ নিচে দিলাম।

ছবি-পাঁচঃ



চে গুয়েভারা ও জন লেনন দুই মহামানব একসাথে নিবিষ্ট মনে সঙ্গীত চর্চায় ব্যস্ত! ছবিটি দেখে প্রথমে চমকে যাই, খানিকক্ষণ চোখে বিস্ময় আর প্রশ্ন নিয়ে তাকায় থাকি। এখান থেকে প্রাপ্ত বিশ্লেষণ অনুযায়ী এটা আসলে আরো একটা ক্রিয়েটিভ ফেকের নমুনা। ব্যাপারটার ধরতে পেরে আমার নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটে উঠে, এক্ষেত্রে রাগের বদলে ফেকারদের ক্রিয়েটিভিটিকে কেন জানি আনমনে অ্যাপ্রিশিয়েট করি। তোফা আইডিয়া, সন্দেহ নাই! যদিও ছবি ফেক।

আসল ছবিটি হলো -

আসল ছবিতে জন লেনন তার সমসাময়িক গিটারিস্ট ওয়েইনি গ্যাবরিয়েল অনুশীলনে ব্যস্ত।

আবার ফিরে আসি দুর্যোগে - ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১০ সাল, স্থানীয় সময় ৩:৩৪ মিনিট। ৮.৮ (MMS) মাত্রায় ৩ মিনিট স্থায়ী seismograph রিপোর্ট অনুযায়ী এযাবতকালের ৬ষ্ঠ শক্তিশালী ভূমিকম্পটি আঘাত হানে চিলির উপকূলীয় কেন্দ্রের আবাসিক অঞ্চলগুলোতে। সরকারী হিশেব মতে এ দুর্যোগে প্রাণ হানির সংখ্যা প্রায় ৫২৫ জন, ২৫ জনের মত নিখোঁজ, আর মোট জনসংখ্যার ৯% মানুষ হারায় তাদের প্রিয় বাসস্থান। বিস্তারিত এখানে









আগেই বলেছি সব ক্ষেত্রেই যে ছবি এডিট, ফটোশপ, জোড়া-তালি, ঘুটা মারার প্রয়োজন পড়ে, তা নয়। জ্ঞানী মুমিনরা তার চেয়ে কম পরিশ্রম বা মাথা খাটিয়ে, অপেক্ষাকৃত সহজ ও বলদীয় উপায়ে নিজের বক্তব্য পরিবেশন করে থাকে। নিচে লক্ষণীয় -

ছবি-ছয়ঃ




উপরের ছবিটি যে কতটা উর্বর মস্তিকের জ্বলন্ত উদাহরণ, তা নিয়ে মনে হয় না আর কিছু বলার প্রয়োজন আছে! যা বলার আগের ছবিগুলোই তা বলে দিচ্ছে। শুধু কিছু প্রশ্ন এই অধমের মাথায় চাড়া দিয়ে উঠছে, কেউ যদি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে তার ধর্ম সত্য ও ন্যায়ের, তাহলে সে নিজেই কেনো নির্লজ্জ মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সে ধর্মকে কলঙ্কিত করছে? তাহলে কি তার নিজের বিশ্বাসের উপর নিজের আস্থা নেই! কেউ যদি জানে, সৃষ্টিকর্তা যা দেখানোর তা দেখাবে। তাহলে কি সেটা সৃষ্টিকর্তার উপর ছেড়ে দেয়াটাই যুক্তিযুক্ত নয়? বরং এই মিথ্যাচার দিয়ে যা প্রমাণিত হয়েছে তা হলো, প্রথমতঃ কেউ বা কারা ধর্ম ও খোদার নাম ভাঙ্গিয়ে নিজেরা কতটা মূর্খ তার পরিচয় দিয়েছে। দ্বিতীয়তঃ শুধু তাই নয় সে বা তারা সেই খোদার উপর মাতবরি করে নিজেই খোদা হবার চেষ্টা করেছে।
সবশেষে ফেকিং এ মিডিয়ার রূপ তুলে ধরতে খুব পরিচিত একটি ছবি।

ছবি-সাতঃ


উপরের ছবিতে একটি ঘটনাকে মিডিয়া কিভাবে নিজের সুবিধামত ভিন্নরূপে কাভারেজ করে তা দেখানো হয়েছে। একটি সত্য ছবি প্রকাশের ভিন্ন স্টাইলের দরুণ নিঃসন্দেহে দু'ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত দু'রকম প্রভাব ফেলতে পারে। "Half truth is worse than complete lie" - কথাটা এক্ষেত্রে পুরোপুরি খেলে যায়!

হ্যাঁ, ছবি কথা বলে। শুধুমাত্র একটি ছবি পারে হাজারো মানুষের ভেতরে ঝিমানো মনুষ্যত্বকে নাড়া দিয়ে তলিয়ে যাওয়া চেতনাকে এক করতে, এরকম উদাহরণও আছে ভুরিভুরি। তাই বলা হয়ে থাকে, একটা ছবি হাজারটা শব্দের চেয়ে বেশি কার্যকর। অথচ ভেবে দেখুন সে ছবি যদি হয় মিথ্যা, তাহলে অবশ্যই তার বিপরীত প্রভাব পড়বে। এবং যা হবে হাজারটা মিথ্যার চেয়ে বেশি ভয়ংকর! যার তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে কিছুদিন আগে বহুল আলোচিত রামু, পুটিয়ার ঘটনায়। অতএব বর্তমানে এই ফেকিং ও যথেচ্ছার রাজত্বে, নিজেকে 'জ্যাক অ্যাস' বানানোর হাত থেকে রক্ষার দায়িত্ব আপনার নিজের। যেকোনো সন্দেহজনক, মনে প্রশ্ন জাগে এরকম ছবিতে ছোখ বন্ধ করে বিশ্বাসের আগে, অন্তত আরেকবার তা ভালো করে দেখুন, নিজের মাথা (জ্ঞান-বুদ্ধি, বিচার-বিবেচনা) খাটান। নিজে সত্য জানার চেষ্টা করুন এবং অন্যকে জানতে সাহায্য করুন। নিজের মধ্যে সচেতনতা বাড়ান এবং দশজনের মাঝে তা ছড়িয়ে দিন! যেহেতু এরকম বস্তা বস্তা আলোচনা ঐ সব নির্লজ্জ ফেকার বা মিডিয়ার উপর কোনই প্রভাব ফেলবে না, এক ফোঁটাও কমাবে না তাদের ফেকিং অ্যাক্টিভিটি। তাই নিজের সচেতনতার বিকল্প কিছু নাই।
------------------------------------------------------------------------------

ছবিগুলো নেট থেকে নেয়া
স্যান্ডিতে ব্যবহৃত তথ্যসূত্র -
বিবিসি
ডিসকভারি নিউজ -১
ডিসকভারি নিউজ -২

--------------------------------------------------------------------------------

সাজেদারা হারিয়ে যায়

আজ অনেকদিন পর মায়ের বাসায় নিজের পুরনো বই-খাতাগুলো নিয়ে বসলো নূপুর। টেনে নিলো বেশ ক'বছরের অবহেলায় ধুলো জমা গাদাখানেক নোটবুক। যেন খুঁজে পেয়েছে এমন একটা ভাব করে তুলে নিলো সেখান থেকে একটা, দ্রুত হাতে উল্টাতে থাকলো ওটার পাতাগুলো, শেষে এক জায়গায় এসে থেমে গেলো সে, চোখ আটকে থাকলো ছোট্ট একটা লাইনে -- 'আমার নাম সাজেদা'। কেউ জানলো না, কি তীব্র ঝড় বয়ে যেতে লাগলো তার ভেতর দিয়ে! স্মৃতি-ঝড়। সাইমুম, সাইক্লোনের চেয়েও খারাপ এ ঝড়। যা সরাসরি আঘাত করে মানুষের কালে, তলিয়ে দেয় বর্তমান, মুহূর্তে নিয়ে যায় ফেলে আসা অতীতে -

ছাদের নিচে ছোট্ট এক রুমের একটা বাসা। নিজের, একান্ত নিজের একটা সংসার। আপন নীড়। জীবনে প্রথমবারের মত বাবা-মায়ের ছায়া শেকল থেকে বেরিয়ে মাথার উপর খোলা আকাশটা পেয়ে সে দিশেহারা। মুক্তি ও পূর্ণতার ডানা মেলে ধরেছে নির্দ্বিধায়। সারাদিন পুতুলখেলায় মেতে থাকার মতোই পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখে নিজের ঘরদোর। হাতে গোনা ক'টা আসবাব, তাও আবার এপাশ-অপাশ করে অহেতুক, বারবার। দিন-দুনিয়ার হিসেব তখন তার কাছে অর্থহীন, মাথাব্যথাও ছিলো না রাজনীতি, দেশ বা অন্য কোনো বিষয়ে, যা কিছু ছিলো তার ছোট্ট ঘরটার বাইরে। সে সময় বিরোধীদলের ডাকা একের পর এক হরতালগুলো ছিলো বরং তার কাছে মেঘ না চাইতে জলের মতই অতি-আনন্দের! কারণ হরতালে সারাদিন কাছে পাবে প্রিয় মানুষটিকে। আর ঠিক রাতে শুতে যাওয়ার আগে নিয়ম মেনে কারেন্ট চলে যাওয়াও প্রচন্ড গরমে যোগ করত আলাদা রোমাঞ্চের। রোজ তাড়াতাড়ি রাতের খাবার সেরে, তারা অপেক্ষা করতে থাকত এবং কারেন্ট যাওয়া মাত্রই গীটারটা নিয়ে সোজা ছাদে। পল্লব ফেরার পথে ছাদের চাবিটা দারোয়ানের কাছে থেকে নিয়ে আসতো, আবার কখনো অন্ধকারেই নিচে গিয়ে চাবিটা আনতে হতো।

ছাদে তাদের প্রিয় একটা কোণ ছিলো, সে দিকটায় তখনো কোনো বাড়ী উঠে নাই, একপাশে রাস্তা, রাস্তার ওপাশেও তখন ফাঁকা প্লট, তারপর বড় মেইন রাস্তা। জ্যোৎস্না রাতে মনে হতো পৃথিবী থেকে তারা সম্পূর্ণ বিছিন্ন দু'জন মানব-মানবী। আপন মনে গীটার বাজাতো পল্লব আর নূপুর বেড়ালের মত গুটিশুটি মেরে ওর হাতের ফাঁকা-ফুকো দিয়ে ঠিকই কোলের মধ্যে আরামের জায়গা করে নিতো। বেড়ালের মতই চোখ বন্ধ রেখে মিউ মিউ করে আব্দার করে যেতো, একটার পর একটা গানের। কখনো - কাঞ্চন জঙ্ঘা, বেলা বোস, আমার চক্ষু নাই... আবার কখনো - ববি রায়ের কথায় চলে যেও না ছেড়ে আমায়...

একদিনের কথা মনে পড়লে এখনো লজ্জা পায় নূপুর, যেদিন বাড়িওয়ালী আন্টি এসে বলল - "তোমরা নাকি টোনা-টুনি রোজ ছাদে উঠে টুংটাং করো?" সে ভেবেছিলো কমপ্লেইন করতে এসেছে বুঝি, তাই কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না। বাড়িওয়ালী তাকে অবাক করে দিয়ে ছাদের আরেকটা চাবি ধরিয়ে দিয়ে বলল - "এটা রাখো, যখন খুশি ছাদে গিয়ে টুংটাং করবা!"

অফিস থেকে ফেরার পথে প্রায়ই পল্লব হাত ভরে নিয়ে আসতো দোলনচাঁপা, নূপুরের প্রিয় ফুল। খুব যত্ন করে জারে পানি ঢেলে রেখে দিতো সে, পুরো বাড়ি মন পাগল করা বেহেশতী গন্ধে ভরে যেত! এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিলো স্বপ্ন আর কবিতার মত! এক সময় নূপুর আবিষ্কার করলো তার ভেতরে জন্ম নিচ্ছে নতুন আরেক স্পন্দন! প্রথমে ভয় তারপর অদ্ভুত মোহাচ্ছন্ন ভালো লাগায় ভরে উঠলো তার মন! শুধু বাবা, মা-কে জানাবে কিভাবে এ চিন্তায় তারা দু'জনেই লজ্জায় লাল! কারণ মা বলেছিলো লেখাপড়া শেষ হওয়ার আগে যেন উল্টা-পাল্টা কিছু না হয়। আর সেই 'উল্টা-পাল্টা কিছু' টা যে এত তাড়াতাড়ি বাধিয়ে বসেছে, তা এখন বলে কোন মুখে। তাই নিঃশব্দে তারা দু'জন দু'জনকে অভিনন্দন জানালো। নূপুর কল্পনায় বুঁদ হয়ে মা হবার অনুভূতিটাকে নিজের মধ্যে তরিয়ে তরিয়ে অনুভব করতে লাগলো।

বাড়িওয়ালী আন্টির স্বভাব ছিলো দু'দিন পর পর নূপুরের খোঁজখবর নেয়া। সে তার অভিজ্ঞ চোখে মুহূর্তে কেমন করে জানি ধরে ফেলেছিলো নূপুরের অদৃশ্য পরিবর্তন। কোত্থেকে এক কাজের মেয়ে নিয়ে এসে বলল - "তোমাকে সারাদিন কাজ করতে দেখি। এসময়ে ভারী কাজ করা ঠিক না। মেয়েটাকে রাখো। নতুন ঢাকায় আসছে, এখানকার হাওয়া-বাতাস এখনো গায়ে লাগে নাই।"

নূপুর অবাক হয়ে বললো - "সেকি! ও ঢাকায় আসলো কিভাবে?"

"এক ব্যাটা ওকে গ্রাম থেকে বিয়ে করে আনছিলো, কাছেই এক বস্তিতে ঘর ভাড়া করে সংসারও করছে দুই মাস, তারপর সে লাপাত্তা। বেচারীর এখন পেট শুকায়ে মরার দশা! গ্রামে ফেরত নেয়ার মতোও কেউ নাই, সৎ মায়ের ঘরে দাসি বান্দি করে বড় হইছে। বাপ মরার পর খোঁজখবর না নিয়েই, কোনোরকমে আপদ বিদায় করছে সেই মায়।" - এ যেন রোজকার খুব স্বভাবিক গল্প, এমন একটা ভাব করে বলল বাড়িওয়ালী।

এবার রীতিমত ধাক্কা খায় নূপুর। দুই মাসের কিছু বেশি সময় সেও স্বামীর সাথে আছে। মফঃস্বল থেকে ঢাকায়। পল্লবের সাথে অবশ্যই ওই মেয়েটির স্বামীর তফাৎ আছে, কিন্তু কোথায় জানি নিজের সাথেই ওর মিল খুঁজতে থাকে। তাকায় মেয়টার দিকে -

নিতান্তই বাচ্চা একটা মেয়ে। আর নিত্য ঘাটতির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে ওঠা শরীরটাতেও স্পষ্ট দৈন্যতার ছাপ। গায়ে বেঢোপ আলখাল্লা সাইজের সালওয়ার-কামিজ। দেখে প্রায় হেসে ফেলেছিলো সে। তার উপর মস্ত বড় একটা ওড়না দিয়ে কপাল থেকে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা। শুধু ক্লান্ত চোখ দু'টো দিয়ে ঠুকরে বেরিয়ে আসা অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা! কোনো আবরণ ঢাকতে পারেনি তা। বেশিক্ষণ তাকাতে পারলো না সেখানে নূপুর, বুকটা কেমন হা হা করে উঠলো!
"কি নাম রে তোর?"- জানতে চাইলো সে।

"সাজেদা।"- জবাব দিলো মেয়েটা।

----------------------------------------------------------------------------------
সাজেদা রোজ আসা শুরু করলো। সারাদিন থাকে। যতক্ষণ না তাকে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়া হয়, সে চুপচাপ রান্নাঘর বা বারান্দার এক কোণে বসে থাকে। 

নূপুর একদিন জিজ্ঞেস করেছিলো - "এতো দেরি করে যাস কেন?"

"একা ঘরে ঢুকতে ডর করে।" - বলেছিলো সাজেদা।

"কেনো?"

"পাশের ঘরে হের দুরসম্পর্কের এক বোন থাকে, গার্মেন্টসে কাম করে। আর তার স্বামী সারাদিন লাফাঙ্গা পোলাগো লগে গাঞ্জা টানে, বৌ না থাকলে আমার ঘরে উঁকি দেয়।"

সাজেদার ভয়ের কারণ বুঝতে পেরে গা কাঁটা দিয়ে উঠে নূপুরের! পায়ের নিচে মাটি শক্ত করে, গলায় জোর এনে বলেছিলো - "তুই এখানেই থাক!"

কিন্তু সাজেদা বলেছিলো - "হে যদি আসে!"

অদ্ভুত ধোঁয়াশায় যুঝছিলো সাজেদার মন, স্বামী ফিরে আসবে এ বিশ্বাস তখনো তাকে শক্তি দিচ্ছিলো, চারপাশের প্রতিকূলতাগুলোর বিরুদ্ধে টিকে থাকতে। নূপুরেরও তখন জীবনের নির্মম বাস্তবতার সাথে পরিচয় ছিলো না। তার ভেতরের নব্য পরিণতা নারীও কেন জানি সাজেদার বিশ্বাসকেই সমর্থন করতে চাইতো। মনে মনে ভাবতো, হয়তো সত্যি ফিরবে সাজেদার স্বামী! তাই রোজ ওর মুখে তাকাতো একটু আলো দেখবে বলে, কখনো উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করেও বসতো - "কিরে ফিরেছে সে?"

----------------------------------------------------------------------------------
নূপুর আর পল্লবের গাদা গাদা বইয়ের পাহাড় জমে যাচ্ছিলো। মাঝে সাঝে সেগুলোর ধুলো ঝাড়পোঁছ করে নিজেরটা আর পল্লবেরটা আলাদা করে গোছানোর চেষ্টা করতো সে। একদিন দেখে সাজেদা খুব আগ্রহের সাথে জ্ঞানকোষের পাতা উল্টাচ্ছে, কৌতূহল থেকে জানতে চাইলো - "তুই পড়তে পারিস?"

"পারি।"

"একটু পড়ে শোনা তো?"

সাজেদা পড়া শুরু করলো, ঝর ঝরে রিডিং, কোথাও আটকালো না, উচ্চারণে আঞ্চলিক টান ছাড়া আর কোনো সমস্যা ছিলো না। 

হাতের কাছেই নূপুরের ক্লাসের একটা নোটবুক ছিলো এগিয়ে দিয়ে বললো - "লিখ তো?"

সাজেদা গোটা গোটা অক্ষরে স্পষ্ট করে লিখলো - 'আমার নাম সাজেদা'। 

"কেলাশ এইট পড়ছিলাম, হের পর বিয়া হইলো!" আপন মনেই যেন নিজেকে শোনালো সে।

অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নূপুরের ভেতর থেকে!

এর মাঝে একদিন একটা ঘটনা ঘটলো। রান্না ঘরে ওরা দু'জনে কাজ করছিলো, সাজেদা একটু দুরে সিঙ্কে থালাবাসন ধুচ্ছিলো। হঠাৎ সে শূন্যে হাত তুলে কিছু আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলো, তারপর ধড়াম করে পড়ে গেলো। নূপুর কি করবে বুঝে উঠতে পারেনি, শুধু এটুকু বুঝলো এটাকে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া বলে। হাতের কাছেই পানি ছিলো, চোখে মুখে দেয়া শুরু করলো। একটু পরেই চোখ মেললো সাজেদা। তারপর ওকে নিয়ে গেলো পাশের এক হসপিটালে। সাজেদা যেতে চাইছিলো না, ওর নাকি এরকম মাথা 'চক' প্রায়ই লাগে, আবার নিজেই ঠিক হয়ে যায়। রিক্সায় নূপুরের ভয় হচ্ছিলো সাজেদা আবার পড়ে যায় কিনা, তাই ধরে রেখেছিলো তাকে শক্ত করে। হসপিটাল গেটে টিকেট করার সময় নূপুরের হাত কাঁপছিল।

ডাক্তারও প্রথমে নূপুরকেই জিজ্ঞেস করেছিলো - "কি সমস্যা?"

নূপুর সাজেদাকে দেখিয়ে বলেছিলো - "ও মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলো।"

ডাক্তার সাজেদাকে পরীক্ষা করে বলল - "তেমন কিছু না, দুর্বলতা থেকেই ফেইন্ট হয়েছে। রেস্ট প্রয়োজন।" 

সাজেদা যে প্রেগন্যান্ট সেটা ওখানেই ডাক্তারের কাছ থেকে জানলো নূপুর।
দু'জন নার্স ফেরার পথে তাদের ধরলো কিছু করাতে চাইলে যাতে দেরি না করে, ওদের পরিচিত এক জায়গায় এসব কম খরচে করানো হয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। ওরা মনে মনে সূত্র মিলিয়ে নিয়েছে, সাজেদার গর্ভের সন্তান অবৈধ, সে সন্তানের পিতা হয়তো পাশের মেয়েটার অর্থাৎ নূপুরের স্বামী। নূপুর চোখ-কান বুঝে সেই দুর্বিষহ পরিস্থিতি থেকে কোনরকমে বেরিয়ে আসে।
তার ভেতরটা সমানে হাহাকার করে যাচ্ছিলো, এই মেয়েটা এতবড় হতভাগী যে জীবনে মা হবার মতো আনন্দটুকুও প্রাণভরে উপভোগ করার উপায় নাই। অন্যদিকে সাজেদা তখনো নির্বিকার!

নূপুরের সাধের ঘর ঝাড়াপোঁছা বন্ধ হয়ে গেলো। সে তার পছন্দের মজার কিছু বই সাজেদা কে দিয়ে পড়াতে শুরু করলো - টুকুনজিল, হাত কাটা রবিন, টুকি ঝাঁ, পাগলা দাশু, প্রফেসর শঙ্কু... একেক দিন একেকটা, বিশেষ করে বেছে বেছে হাসির অংশগুলো বার বার পড়তে বলত। সাজেদা জোরে জোরে পড়তো, আর নূপুর পেট চেপে হো হো করে হাসতো। তাকে হাসতে দেখে সাজেদাও হাসতো। আবার কখনো খুব সিরিয়াস কোনো নাটকের কষ্টের মুহূর্ত দেখে দু'জনেরই চোখ ভেসে যেতো।

----------------------------------------------------------------------------------
এটা সত্য যে পল্লব বাসায় থাকলে সাজেদার উপস্থিতি তাদের দু'জনের জন্যেই খুব অস্বস্তিকর ছিলো। তখন তাদের ছোট ঘরটা কেমন যেন আরো ছোট হয়ে যেতো। পল্লব প্রায়ই নূপুরকে বলতো সাজেদাকে বলো ছুটির দিনগুলোতে যেন না আসে। কিন্তু সে পারতো না। সে তো জানে সাজেদা কেন আসে, এক দণ্ড নির্ভরতার আশ্রয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে। 

৭২ ঘন্টার হরতাল। পল্লব বাসায়। সেদিন স্বামীর মন রক্ষার্থে নূপুরকে খুব বেশি স্বার্থপর হতে হয়েছিলো, সাজেদাকে বলেছিলো - তিন দিন তোর ভাই বাসায় থাকবে, এ ক'দিন তুই আসিস না। সাজেদা কিছু বলে নাই চুপচাপ চলে গেলো। কিন্তু সে ক'দিন অজানা আশংকা আর ভয়ে অস্থির হয়ে থাকল নূপুর।

প্রথম বারের মত টানা পাঁচদিন আসে নাই সাজেদা। মনে মনে অস্থির হয়ে নূপুর যখন ভাবছিলো ওর খোঁজে যাবে কিনা, তখন সে এলো। অস্থিরতা রাগে পরিনত হয়, কিছুটা ঝাঁঝালো স্বরে জানতে চায় সে - "এ ক'দিন আসিস নাই যে?"

"হরতালে আমার স্বামী ফিরছে।" সাজেদা জবাব দেয়।

চোখে বিস্ময় ঠুকরে বের হলো নূপুরের।
সাজেদা আঁচলে লুকানো হাতটা তার সামনে মেলে ধরে বলে - "আমার জন্যে এটা আনছে।" ওর হাতে একটা শাড়ি। মেরুন রঙ, জরির পাড়।

নূপুরের চোখে জল এসে গেলো, গলায় মিথ্যে অভিমান টেনে বলল - "ও আচ্ছা, তাই স্বামীকে পেয়ে আমাকে ভুলে গেছিলি বুঝি!"

------------------------------------------------------------------------------------
নূপুরের মা হবার খবরটা পেয়ে আর দশটা মায়ের মতোই নূপুরের মা-ও তাকে নিয়ে যথারীতি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন! মেয়ের পড়াশুনা, বাচ্চা, শরীর কোনটারই যাতে কোনো ক্ষতি না হয় তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো বাকী সময়টা সে মায়ের বাড়িতেই থাকবে। মা নিজে এসে তাকে নিয়ে গেলো। নূপুর চলে গেলো, তার ছয় মাসের ছোট্ট সংসারটা রেখে।

এরপর পড়াশুনা ক্লাস ইত্যাদি নিয়ে সে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মায়ের বাড়িতে আদর-যত্ন, সেবা-শুশ্রুষায় কোনোটারই কোনো কমতি ছিলো না। পল্লবও সুযোগ পেলেই তাকে দেখে আসতো। তারপরেও তার মন পড়ে থাকতো নিজের ঘরে -- দোলনচাঁপার গন্ধ, রাতের খোলা আকাশের নিচে গীটারের সুর আর হরতালের অলস দুপুরগুলোতে।

ইয়া বড় একাটা পেট নিয়ে লজ্জার মাথা খেয়ে কোনোমতে পরীক্ষাগুলো দিলো সে। এর কিছুদিন পরেই নূপুরের কোল জুড়ে এলো রূপকথার ডালিমকুমারের মতোই লাল টুকটুকে এক রাজপুত্র। নিজের ঘরে ফিরে আসলো তারও অনেক পরে, ছেলে একটু শক্তপোক্ত হলে। নূপুর ফিরে আসার পর বাড়িওয়ালী আন্টি খুশিতে বাকবাকুম করতে করতে নতুন মেহমান দেখতে এলো। তার কাছে নূপুর জানতে চাইলো সাজেদার কথা। বাড়িওয়ালী বললো- "তুমি যাওয়ার পর তো তাকে আর দেখি নাই।" 

নূপুরের পীড়াপীড়িতে বস্তি থেকে সাজেদার যে খোঁজ নিয়ে এলো বাড়িওয়ালীর বুয়া, তা হলো - বস্তির ওই ঘরে সাজেদা এখন আর থাকে না, সেখানে অন্য কেউ বাস করছে। নূপুর ভাবলো হয়তো সাজেদার বর তাকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে গিয়েছে। কিন্তু তারপরেও সাজেদার বাবুটা কেমন হলো এটা জানার জন্যে নূপুরের ভেতরটা খচ খচ করেই যাচ্ছিলো।

শেষে অনেক কষ্টে সাজেদার স্বামীর সেই দুরসম্পর্কের বোনের নাগাল পেল নূপুর। সেদিন নিজেই চলে গিয়েছিলো সে বস্তিতে। মহিলার কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে, সাজেদার ব্যাপারে জানতে চাইলো? মহিলা নূপুরকে চিনলো। সে বলল - "আপনি যাওনের পর হেরে আমি গার্মেন্টস এ কাম দেই, সেখানে একদিন মাথা চক লাইগা পইড়া গেলো, বাচ্চাটাও গেলো। মেলা দিন খাড়া হইতে পারে নাই, যেখানে-সেখানে পইড়া পইড়া থাকত। তারপর কই যে গেলো, মেলাদিন আর তারে আমিও দেখি না!" 

তার কথা শুনে নূপুর জমে গেলো, কোনমতে জানতে চাইলো - "আর ওর স্বামী?" 

"হেতো সেই কবে ওরে ছাইড়া চইলা গেছে, খালি পরথম দুই মাস এক লগে বস্তিতে আছিলো, তারপর গেছে গ্যা। আপনে জানেন না?!" বিস্ময় ফুটে উঠে তার স্বরে।

নূপুরের মাথায় এবার রক্ত উঠে গেলো, রাগে কাঁপতে কাঁপতে সে বলল- "তুমি মিথ্যা বলছো কেনো?! সাজেদার স্বামী তো আবার ফিরে এসেছিলো। সাজেদাই আমাকে বলেছে!"

মহিলা এবার অবাক হয়ে বলল - "আমি সত্যই বলছি। সাজেদার স্বামী মরছে, না তারে পুলিশে ধরছে, না অন্য কোনো মাইয়ার লগে বিয়া বইছে আমি জানি না। কিন্তু সে ওই একবারই সাজেদারে ছাইড়া গেছে, আর ফিরে নাই! কেউ তারে আর বস্তিতে ফিরতে দেখে নাই! আপনি হগলরে জিগান!" উপস্থিত অনেকেই তার কথায় সায় দিলো।

প্রায় সাত বছর হয়ে গেলো। নোটবুকে সাজেদার লেখাটা এখনো ঐ একই রকম আছে, গোটা গোটা, স্পষ্ট। জ্বলজ্বলে এ ক'টা শব্দের ভেতর দিয়ে যেন ভেসে ওঠে -- সেই চোখ, সেই বিষণ্ণতা! বেশিক্ষণ তাকাতে পারে না নূপুর এবারো, লেখাটা কেমন ঝাপসা হয়ে আসে। কেন মিথ্যে বলছিলো সাজেদা, এ রহস্য আজো অজানা তার। সে শুধু জানে হারিয়ে গিয়েছে সাজেদা। সাজেদারা হারিয়ে যায়।

--------------------------------------------------------------------------------

কালো গণ্ডার, বিপন্নপ্রায় একটি প্রজাতির নাম!



বর্তমানে আফ্রিকায় সবচেয়ে বেশী হুমকীর মুখে প্রাণীটি হলো কালো গণ্ডার। এক সময় বিশাল মহাদেশটির বিস্তৃত বনভূমি ও তৃণভূমিতে সাদা-কালো এই দুই প্রজাতির গণ্ডারের অবাধ বিচরণ থাকলেও বেপরোয়া হত্যা, শিকার এবং ব্যাপক চোরাকারবারির কারণে আজ বিপন্নপ্রায় কালো গণ্ডারের অস্তিত্ব। সাদা গণ্ডারও পৌঁছেচে বিলুপ্তির কাতারে। স্বর্ণের চেয়ে দ্বিগুণ দামী গণ্ডারের শিংকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে আফ্রিকায় নৃশংস ও রক্তাত্ব সব চোরাশিকারী যুদ্ধ!


 



সাদা ও কালো এই দুটো প্রজাতিই আসলে হালকা থেকে গাঢ় ধূসর বা বাদামী বর্ণের হয়ে থাকে। এদের মধ্যে তফাৎ করা হয় মূলত মুখের আকৃতি – বিশেষ করে উপরের ঠোঁটের গঠন প্রণালী থেকে। এই ঠোঁটের ভিন্ন গঠন প্রণালীর দরুণ কালো গন্ডারকে ‘hook-lipped rhino’ আর সাদা গণ্ডারকে ‘square-lipped rhino’ নামে ডাকা হয়। বস্তুত ঠোঁটের ভিন্ন আকৃতি চিহ্নিত করে এই দুটি প্রজাতির ভিন্ন খাদ্যাভাসের –- কালো গণ্ডার যেখানে ছোট ছোট ডালপালা, লতাপাতাসমৃদ্ধ গাছ ও ঝোপঝাড় খুঁজে বেড়ায়, সেখানে সাদা গণ্ডার চরে বেড়ায় বিস্তৃত তৃণভূমিতে। জীবনধারণের জন্য পানি এদের কাছে অত্যাবশ্যকীয়, তাই তারা কখনোই পানির খুব বেশি দুরে যায় না। ভোর ও সন্ধ্যা এই দুইবেলায় এরা নিকটবর্তী জলাশয়ে পানি পান করে।



গণ্ডার লম্বায় আফ্রিকান মোষের কাঁধ বরাবর হলেও ওজনে প্রায় এর দ্বিগুণ হয়ে থাকে। এই ভারি-ভরকম শরীর নিয়েও প্রাণীটি ঘণ্টায় ৫০ কিমি পর্যন্ত দৌড়াতে পারে। আর দুর্বল দৃষ্টিশক্তির অনেকটাই পুষিয়ে দেয় এর তীক্ষ্ণ ঘ্রাণশক্তি। শুধুমাত্র প্রজননের প্রয়োজন ছাড়া গণ্ডার একা থাকতেই পছন্দ করে। প্রজননের জন্য গণ্ডারের কোনো নির্দিষ্ট মৌসুম থাকে না। পুরুষ গণ্ডার মূত্রের ঘ্রাণ থেকে সঙ্গী চিনে নেয়। অর্থাৎ মূত্রের মাধ্যমেই এরা একজন আরেকজনের সাথে যোগাযোগ করে থাকে। সাধারণত পুরুষ গণ্ডার আগন্তুকের প্রতি আক্রমণান্তক হয়ে থাকে।



গণ্ডারের মুখের উপরের অংশে দুটো শিং থাকে, কদাচিৎ কোনোটার তিনটে শিংও দেখা যায়। সামনের শিংটি গড়ে ৬০ সেমি হয়, ক্ষেত্রবিশেষে তা ১৫০ সেমি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে।



ইউরোপীয় প্রভুদের দ্বারাই আফ্রিকায় গণ্ডারনিধনের সূত্রপাতঃ


বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা তাদের আবাসনের প্রয়োজনে আফ্রিকায় কিছু অবকাঠামোভিত্তিক পরিবর্তনে হাত দেয়, কৃতদাস ও খনিজ ব্যবসার পাশাপাশি আফ্রিকার উর্বরভূমিতে খামার ও পশ্চিমা কায়দায় চাষাবাদ শুরু করে, সাথে কাণ্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয়স্বরূপ এখানকার বন্য ঐতিহ্য উজাড়ে প্রাথমিক তৎপরতাও শুরু করে দেয়। ইউরোপীয় সৌখিন শিকারীদের নিছক বিনোদনের তাগিদে সেসময় রোজ গড়ে পাঁচ থেকে ছয়টি গন্ডার হত্যা করা হয়েছে। এরকম বেহিসেবী প্রাণ দিতে হয়েছে হাতি, সিংহসহ অন্যান্য বন্যপশুকেও। অবশ্য হাতির দাঁতের কারবার ইউরোপীয় বণিকরা শুরু করে দিয়েছিলো তারও বহু আগেই। অর্থাৎ সামন্তপ্রভুদের রেখে যাওয়া বিনাশের এ মাত্রা ছিলো সম্পূর্ন অপূরণীয়।

গণ্ডারের শিঙের চোরাকারবারি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়াঃ



শিকার ও হত্যার পাশাপাশি আফ্রিকান হাতির দাঁতের সাথে গণ্ডারের শিঙেরও চোরাকারবারির রাজত্ব শুরু হয় ষাটের দশকের শেষে ও সত্তুরের দশকের শুরু থেকে। অনুমান করা হয় ইউরোপিয়ানদের দ্বারা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের পরেও সেসময় মহাদেশটিতে ৭০,০০০ এর মতো জীবিত কালো গণ্ডার ছিলো। প্রাপ্ত তথ্যমতে - সত্তুর দশকের শুরু থেকে এই পোচিং মোটামুটি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে এবং আশির দশকের মধ্যেই প্রাণীটির সংখ্যা স্থানভেদে শতকরা ৪০ থেকে ৯০ ভাগ পর্যন্ত কমিয়ে আনে। কেবল মাত্র ১৯৭০ থেকে ১৯৯২ সালের ভেতর পুরো আফ্রিকায় সমগ্র কালো গণ্ডারের ৯৬ ভাগই মেরে সাফ করা হয়।




কলোনি পরবর্তী অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অভ্যন্তরীণ জাতিগত সংঘর্ষ এবং আফ্রিকার নানাদেশে চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে বিশাল এ মহাদেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে এন্টি-পোচিং কার্যক্রমও তুলনামূলক শ্লথ গতিতে এগিয়ে চলছে। এবং বেশীরভাগ স্থানেই সংরক্ষণের প্রক্রিয়াকে নিত্য বাধার মুখে পড়তে হয়। উদাহরণস্বরূপ – এঙ্গোলা, রুয়ান্ডা, সোমালিয়া, সুদানের মত জাতিগত দাঙ্গা ও গৃহযুদ্ধে জর্জরিত দেশগুলোতে বন্যজীবন সংরক্ষণের মত কার্যক্রম পরিচালনা করা রীতিমত দুঃসাধ্য ব্যাপার। ফলে এই পোচিং ও চোরাকারবারিদের দৌরাত্ব অভুতপূর্বভাবে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। যে কারণে প্রানীটির সংখ্যা কমতে কমতে আফ্রিকার বিভিন্ন প্রান্ত যেমন- পশ্চিম আফ্রিকায় ইতিমধ্যে কালো গণ্ডার সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন ঘোষণা করা হয়েছে।



বর্তমানে আফ্রিকায় জীবিত গণ্ডারের সংখ্যা ও সংরক্ষণঃ


বর্তমানে আফ্রিকায় বিশ হাজারের মত সাদা গণ্ডার এবং মাত্র পাঁচ হাজারেরও কম কালো গণ্ডার অবশিষ্ট আছে। যার মধ্যে ৯৮ ভাগই কেবলমাত্র -- সাউথ আফ্রিকা, নাবিবিয়া, জিম্বাবুয়ে ও কেনিয়া এই চারটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অনেকসময় চোরাকারবারিদের হাত থেকে রক্ষার জন্যে তাদের সরিয়ে নেয়া হয় সংরক্ষিত স্থানগুলোতে। যেখানে ডেভিড শেল্ড্রিকের ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্টের মত গুটিকয়েক কনজারভেশন সেন্টার, ন্যাশনাল পার্কগুলোতে এই বিপন্নপ্রায় প্রাণীটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ‘দুর্বল প্রয়াস’ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ‘দুর্বল প্রয়াস’ কথাটা বলার কারণ হলো - সংরক্ষিত এরিয়াগুলোতেও গন্ডার ও হাতির মত মূল্যবান প্রাণী দুর্বিৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা করতে বনরক্ষক, কর্মীদের রীতিমত হিমশিম খেতে হয়।



 কোথাও কোথাও ২৪ ঘণ্টা গান প্রটেকশনে রেখেও তাদের রক্ষা করা দায় হয়ে পড়ে। কখনো সংরক্ষণ কর্মীদের সাথে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত দুর্বিৃত্তদের সংঘর্ষ এবং মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে থাকে। এছাড়াও রাতে চাঁদের আলোয় চোরাহত্যা, গুপ্তহত্যা ইত্যাদি নৃশংসতা তো ঘটছে হরহামেশাই। 





গণ্ডারের শিঙের এই ব্যবসা এতটাই লাভজনক যে হাতির দাঁতের মত এটা সংগ্রহের জন্যেও সুসংগঠিত চোরাকারবারির আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, যাতে প্রত্যক্ষভাবে ইন্ধন যুগিয়ে যাচ্ছে আমেরিকার মত শক্তিধর দেশগুলো। ফলে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির হেলিকাপ্টার থেকে শুরু করে, রাতে দেখা যায় এমন বাইনোকুলার, সাইলেন্সড গান, বিষাক্ত বা অচেতন করার ওষুধ এবং অন্যান্য দুষ্প্রাপ্য অস্ত্রপাতি সহজলভ্য করে পৌঁছে দেয়া হয় আঞ্চলিক দুর্বিৃত্তদের হাতে। অর্থাৎ আফ্রিকার বনঐতিহ্য উজাড়ে একটি বড় দায়ভার বর্তায় আমেরিকার মত সুবিধাবাদী রাষ্ট্রের উপরও।

তাই নির্লজ্জ বাস্তবতা হলো – শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কালো গণ্ডারের মত ঐতিহ্যবাহী অসাধারণ এই প্রাণীটির শেষ রক্ষা হয়ত সম্ভব না। সম্প্রতি কয়েক বছরে আফ্রিকার কালো গণ্ডার হত্যার ক্রমবর্ধমান চিত্রটি অন্তত তাই বলে –
২০০৯ সালে হত্যাকৃত গন্ডারের সংখ্যা ছিলো – ১২২ টি
২০১০ সালে হত্যাকৃত গন্ডারের সংখ্যা ছিলো – ৩৩৩ টি
২০১২ সালে এপর্যন্ত গন্ডার হত্যার সংখ্যা – ৩৮৮ টি (যা এরই মধ্যে বিগত কয়েক বছরের গন্ডার হত্যার সংখ্যা ছাড়িয়ে গিয়েছে!) 


কেবলমাত্র যে শিঙের জন্য আস্ত একটা প্রজাতিই বিলুপ্ত হতে বসেছে, এবার দেখা যাক সেই সিঙের প্রকৃত গুরুত্ব ও মহত্ত্বঃ




এরকম একটা শিঙের ওজন আট পাউন্ডের মত। এবং যার কালোবাজারি দাম ৩৬০,০০০ ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে! (আতর্জাতিক ইন্ধন তথা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ও মূল্যবান অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের কারণটা মোটামুটি এখানেই পরিষ্কার। ব্যাপক হারে গণ্ডার নিধন বস্তুত মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের মামলা!)




গণ্ডারের শিঙের সবচেয়ে বড় বাজার দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার প্রধাণত চায়না ও ভিয়েতনাম, যেখানে এই শিং-কে অত্যন্ত কার্যকরী ঔষধিগুনসমৃদ্ধ একটি মূল্যবান উপাদান হিসেবে মনে করা হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ বছরের প্রচলিত বিশ্বাসমতে গন্ডারের শিং থেকে প্রাপ্ত পাউডার মাথাব্যথা, জ্বর, হৃদরোগ এবং কান্সারের মত অসুখ সারাতে সক্ষম।

অথচ যেখানে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, গণ্ডারের শিঙ keratin নামের প্রোটিন দিয়ে গঠিত, একই কেরাটিন যা আমাদের নখ ও চুলেও বিদ্যমান। এবং যার মধ্যে কোনো প্রকার রোগ নিরাময়ের ঔষধি গুণাবলীর বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায় না!

অতএব শুধুমাত্র ভ্রান্ত ধারণা আর বিশ্বাসই গণ্ডারের শিঙের মত খুব সাধারণ একটি বস্তুকে মানুষের কাছে করে তুলেছে অমূল্য! এবং যার বলি হতে হয়েছে পুরো সমৃদ্ধ এক প্রজাতিকে। মানষের নির্বুদ্ধিতা, অজ্ঞতা এবং নৃশংসতার মূল্য না জানি এরকম কত প্রজাতিকে ইতোমধ্যে দিতে হয়েছে এবং রোজ কত নতুন প্রজাতি এ কাতারে যোগ হচ্ছে, সে হিসেব নিঃসন্দেহে ভয়াবহ!

যদিও আপাতদৃষ্টিতে চায়নায় আইনের মাধ্যমে তাদের ঐতিহ্যবাহী ঔষধপত্রে গন্ডারের শিং ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তারপরেও পরিসংখ্যান বলছে অন্য কথা - পোচিং চলছে দেদারসে, বরং পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়েও আরো জোরেসোরে। এ প্রবণতা এতটাই আশংকাজনক যে, যদি এখনই বন্ধ না হয় তবে পৃথিবী অচিরেই হারাবে আফ্রিকান কালো গণ্ডার, প্রকৃতি হারাবে তার আরেক বিশাল প্রজাতি, এবং একের পর এক এই মনুষ্যসৃষ্ট বিলুপ্তি আমাদের নিজেদের কপালে কি দুর্ভোগ বয়ে আনবে তা হয়ত আমারা এখনো অনুমানও করে উঠতে পারি নাই!
------------------------------------------------------------------------------------------------------
তথ্য ও ছবি সূত্রঃ

ডাব্লিউ ডাব্লিউ এফ গ্লোবাল
বিবিসি
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
 ইউকিপিডিয়া
স্টার আফ্রিকা
ভণ্ডুল