Monday 10 September 2012

বিস্মৃতির বালুতট

একটার পর একটা ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে পায়ের কাছে। সাদা ফেনার তলে কত রাশি রাশি বালির নিত্য তটে জমা হওয়া, আবার ঢেউয়ের সাথে গা ভাসিয়ে চলে যাওয়া এ এক নিরন্তন খেলা। কিছু রেখে কিছু টেনে নেয়া এ শুধুই সাগরের অবাধ্য ঢেউগুলোর ছেলেমানুষি ছাড়া আর কি বা হতে পারে! তারপর কত দেশ যে জেগে ওঠে জলের বুকে আবার ভুস্ করে কত কিছু তলিয়ে যায় কোনটারই হুঁশ থাকে না এই আপন খেলায় মেতে থাকা অবাধ্য জল-শিশুগুলোর। মানুষের জীবনটাও তো সাগরের জল আর তীরের মাঝামাঝি এই অংশটার মতই, প্রতি মুহূর্তে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো যেন ছোট বড় একেকটা ঢেউ, যা সাথে করে নিয়ে আসে বালির আস্তরণের মত নানা অভিজ্ঞতা ও পাওয়া-না পাওয়ার গল্প, আর টেনে নিয়ে যায় জীবন থেকে অতিমূল্যবান সময়গুলো। ভেজা বালিতে পায়ের ছাপ তুলে হাঁটতে হাঁটতে এরকম নানা ভাবনায় মেতে থাকে খেয়া, ঢেউগুলো তার সাথেও খেলা শুরু করেছে, পায়ের তল থেকে সুরসুর করে বালিগুলো টেনে নিয়ে যাচ্ছে, আবার কিছুটা আহ্লাদ করে পা ছুঁয়েও দিয়ে যাচ্ছে। এভাবেই আপনমনে কখনো জল কখনো বালি স্পর্শ করতে করতে সে হেঁটে এসেছে বেশ খানিকটা। পেছন ফিরে তাকায়, মেয়েটা এখনো বালি নিয়ে খেলছে। কিছু একটা তৈরি করছে। কিন্তু ভাটার কারণে সাগর অনেকটা নিচে নেমে যাওয়ায়, বালিগুলো শুকিয়ে আসছে, সহজে জমাট বাঁধছে না। তাই সে একটু পরপরই দৌড়ে সাগর থেকে হাতের তালু করে জল নিয়ে আসছে, ছোট হাতে আর কতটুকুই বা ধরছে, তার থেকে আবার ফিরতে ফিরতে প্রায় সবটাই পড়ে যাচ্ছে। মেয়েটার কষ্ট দেখে মায়া হয় খেয়ার, আবার মজাও লাগে বেশ।

পাশেই পিয়াস অলসভাবে শুয়ে কি একটা পড়ছে।

বাবা আমাকে একটু হেল্প করবা, প্লিজ? আদুরে গলায় কিছুটা ক্লান্তি ও অভিযোগ মিশিয়ে বলে তিতির, প্রিন্সেস ফিওনা-র প্যালেস বানাচ্ছি কিন্তু বালিগুলো শুধু পড়েই যাচ্ছে! পচা বালি! নির্বোধ বালিগুলোর উপর তার সবটুকু বিরক্তি ঝেড়ে বলে তিতির।

মেয়ের কথায় হাসে পিয়াস, আজকাল মেয়ে এই একটা গালি শিখেছে 'পচা', এই বিশেষ শব্দটুকু বলার ভঙ্গিটাও দারুণ, চোখ-নাক কুঁচকে, ঠোঁট ফুলিয়ে বলে 'পচ-চা'।

শিওর মাম! আমই এক্ষুণি বানিয়ে দিচ্ছি তুমি কিছু শামুক-ঝিনুক কুড়িয়ে আনো তো দেখি, প্রিন্সেসের প্যালেস সাজাতে হবে তো!

মুহূর্তে সব ক্লান্তি ভুলে আনন্দে চড়ুই পাখির মত লাফিয়ে উঠে তিতির, ফ্রকের কোছা পেতে চারপাশে শামুক-ঝিনুক কুড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

পিয়াস তার সবটুকু নৈপুণ্য ঢেলে মেয়ের জন্যে বালির প্রাসাদ বানাতে শুরু করে, কোছা ভরে মনি-মুক্তা এনে খুশিতে দিশেহারা হয়ে পড়ে তিতির, ক্রমাগত লাফাতে আর চিৎকার করতে থাকে - মা, ও মা, দেখ বাবা আমার জন্য কি সুন্দর প্যালেস বানিয়েছে! পিয়াস অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেয়ের দিকে, তিতিরের এত অল্পতে এই বাঁধভাঙ্গা খুশি হবার ক্ষমতা মুগ্ধ করে তাকে! মনের ভেতরে কোথেকে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পরে এক পলশা স্নিগ্ধ তৃপ্তির আবেশ!

তিতিরের চেঁচামেচিতে খেয়া না এসে পারে না, পিয়াসের শিল্পকর্মে সেও একটু থমকে যায়, অস্ফুটে নিজেকেই বলে, ক্যামেরাটা(?!)। এক ছুটে ক্যামেরা নিয়ে ফিরে আসে সে, ততক্ষণে বাবা মেয়ে মিলে অতি যত্নে শামুক-ঝিনুক দিয়ে বালির প্রাসাদ সাজাতে ব্যস্ত, শব্দ না করে খুব সাবধানে ফটাফট কয়টা স্ন্যাপ নিয়ে নেয় খেয়া!

আর একজনের কথা বলা হয়নি, পুরোপুরি নিজের মধ্যে আছে সে। বিশাল তটের সাদা বালি, মত্ত উম্মাদনায় আছড়ে পড়া ঢেউ কোনো কিছুই তার ধ্যান ভঙ্গ করতে পারে না, পৃথিবীর যাবতীয় বিষয় তার কাছে অমূলক অর্থহীন। কোন গতি তাকে স্পর্শ করে না, কোন সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করে না। বালির উপর উপুড় হয়ে বসে খুব যত্নে একটা একটা করে বেছে বেছে আপাত সকলের কাছে অদৃশ্য কিন্তু তার কাছে অতি মূল্যবান কিছু ডান হাত দিয়ে তুলে বাম হাতে রাখছে, রেখেই যাচ্ছে, আবার বাম হাত থেকে খুব সাবধানে তা ডান হাতে ঢেলে দিচ্ছে, শেষে  নাহ! হয়নি! এমন একটা ভাব করে আবার সব ঝেড়ে বালিতেই ফেলে দিচ্ছে। এই চলছে ঘন্টার পর ঘন্টা, অস্থিরতায় তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে, হাতগুলো থর থর করে কাঁপতে থাকে। কিন্তু কি এক অজানা অথচ অতি জরুরি হিসাব মিলানোর চেষ্টা সে করেই চলে তার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে, শুধু তা মিলছে না কিছুতেই! দুই একজন পথচারী আচমকা তাকে দেখে থেমে যাচ্ছে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজাও দেখছে অনেকে। কিন্তু সেদিকে মোটেও ভ্রূক্ষেপ নেই তার।

খেয়া তেড়ে এসে প্রচণ্ড বিরক্তি প্রকাশ করে আশেপাশের মানুষগুলোর উপর - এখানে কি? ইজ হেয়ার এনি শো গোয়িং অন। একটা মানুষকে নিজের মত থাকতে দেন, প্লিজ!

বাবার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে সে, বাবা তার কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে দেয় খেয়ার দিকে। অস্পষ্ট ক্লান্ত গলায় বলে- নেও, হচ্ছে না, পারছি না... না পারার কষ্ট ঠুকরে বের হয় ভাঙ্গা এ কটা শব্দে!

বাবাকে জড়িয়ে ধরে খেয়া, চারপাশের অহেতুক কৌতূহল, মানুষের চোখের তীর্যক প্রশ্নগুলো থেকে আড়াল করতে চায় তাকে। বাবা আবার বলে, 'খুকু, হচ্ছে না, পারছি না'। খেয়ার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে আজকাল বাবা খুব কম তাকে এই নামে ডাকে। শুধু শূন্যে অস্পষ্ট-ঝাপসা চোখে তাকিয়ে থাকে বেশীর ভাগ সময়।

বাবাকে আশ্বস্ত করতে চায় খেয়া - এইতো বাবা সব ঠিক আছে।

বাবার এই অবস্থা তাকে যত না কষ্ট দেয়, তার চেয়ে বেশী কষ্ট দেয় মানুষের বিবেকহীন অসহিষ্ণু আচরণগুলো। প্রতিটা মানুষই তো জীবনের এক পর্যায়ে এসে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, না হয় কিছু অসহায় মানুষকে এই অবস্থায় পথ চলতে হয় আরো খানিকটা। কিন্তু তাতে সকলের এত বাধে কেন! সমাজের তথাকথিত ভারসাম্যমান সুস্থ মানুষগুলোর প্রতিনিয়ত কৌতূহলী জিজ্ঞাসু দৃষ্টি এই পথ চলা যে আরও কঠিন করে দেয়, এটা কেন কেউ বুঝেনা? কেউ কেউ আবার আগ বাড়িয়ে সহানুভূতি দেখাতে আসে, সেটাও ভালো লাগেনা খেয়ার। সে নিজেও দিন দিন অসামাজিক হয়ে যাচ্ছে, বেশ বুঝতে পারে। বাবার যুদ্ধটা তো তাকে একাই লড়তে হচ্ছে - প্রতিনিয়ত ভুলে যাওয়া, তীব্র কোনো প্রশ্নের জাবাব না পাওয়া, কোনো জরুরি হিসেব মিলাতে না পারার যে যুদ্ধ। বাবাতো নিজেও একজন সৈনিক ছিলেন। বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মোঃ জহিরুল হক। মানুষের চোখে সম্মান ও নিয়মানুবর্তিতার প্রতীক ছিলেন তিনি। পুরোটা জীবন যিনি কাটিয়েছেন কঠোর অনুশাসনের মধ্যে। নিজের তিন ছেলে-মেয়েকেও বড় করেছেন একই আদর্শে। কিন্তু আজ সব উলটপালট। যদিও পরিবর্তনটা শুরু হয় মা মারা যাওয়ার পর থেকে। অনেকটা সময় তাকে একাই থাকতে হয়েছিলো। ভাইদের দোষ দিতে পারেনা খেয়া, উচ্চ শিক্ষা-ইমিগ্রেশন, তারপর তারাও তো জীবনের কাছেই জিম্মি। মাঝে মাঝে ফোন করে তারা, দায়িত্ব পালন করতে না পারারও যে একটা কষ্ট আছে, বুঝে খেয়া। শুধু অবাক হয় যখন দেখে ভাইয়েরা তাকে অনেক কিছু এড়িয়ে যেতে চায়, হয়তো একজনের কাছে জানতে হয় আরেকজনের ভ্যাকেশনে ইতালী, প্যারিস যাওয়ার গল্প! কিন্তু কেন? কেন তারা লুকোতে চায় নিজের ভাল থাকার কথাগুলো তার কাছে। সে কি এতোই খারাপ! সে কি হিংসে করবে নিজের ভাইয়ের সুখে!

আজ তিন বছর সে বাবাকে আগলে রেখেছে প্রতিটা মুহূর্তের জন্য। কখনো তো কোনো অভিযোগ করেনি কারো কাছে। ছোট্ট তিতিরটাও ধীরে ধীরে পিয়াসের উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। পিয়াস স্বামী হিসেবে সহানুভূতিশীল। পিয়াসের স্বতঃস্ফুর্ত সহযোগিতা প্রায়ই খেয়াকে শক্তি যোগায়। আবার অনেক সময় ছোট কোনো বিষয়ে পিয়াসের চুপ থাকাটাও আঘাত করে তাকে! যদিও পিয়াসও কখনো কোনো অভিযোগ করেনা, তবু কোথাও এক অজানা ভয় সবসময় খোঁচাতে থাকে তাকে।

............

পিয়াসের চাকুরী সুবাদে দেশ-বিদেশ ঘোরার নেশা একসময় খেয়াকেও পেয়ে বসে। কিন্ত আজকাল আর ইচ্ছেমতো বেরিয়ে পড়তে পারে না তারা। এডভান্সড ডিমেনশিয়ার ডাক্তারি সার্টিফিকেট, মেডিকেশনের ঠিক ঠিক নথিপত্র, যেকোন জার্নির পূর্বের প্রয়োজনীয় শারীরিক ফিটনেস চেক আপ ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও এয়ারপোর্টগুলোতে নানা প্রশ্ন আর অমূলক সতর্কতার জবাব দিতে দিতে মাঝে মাঝে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। মানুষ যেখানে নিজেকে সভ্য হিসেবে দাবী করে, সেখানে একজন অসহায় মানুষের জীবন সভ্যতার দোহাই দিয়ে অকারণ জটিলতায় ভরে দিয়ে কি আনন্দ পায়, এটাই রহস্য মনে হয় তখন। কেন কেউ বাবার মানসিক বিপর্যস্ততাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না, যেখানে মেডিকেলী তিনি শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ একজন মানুষ। সে সব কিছু বাবাও দাবী করে যা একজন মানুষ হিসেবে তার প্রাপ্য। কেন এটা বোঝাতে এত বেগ পেতে হয় তার। কদিন আগে তেমনি বাংলাদেশ থেকে ফেরার পথে ঢাকা থেকে দুবাইগামি প্লেনটিতে বাবা কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। ঠিক অসুস্থও বলা যায়না, ঘুমের মধ্যে ঠাণ্ডায় কাঁপছিল সে। এয়ারহোস্টেসের কাছে কম্বল চেয়েছিলো খেয়া। এয়ারহোস্টেস জিজ্ঞেস করেছিলো, কোনো সমস্যা?

খেয়া বলছিলো, আমার মনে হয় তার ঠাণ্ডা লাগছে, একটু কাঁপছে মনে হলো।

এয়ারহোস্টেসটির কি মনে হলো কে জানে, সে তার আরো দুএকজন সহকর্মীকে ডেকে আনলো, তারা খুব বিচক্ষণতার সাথে বাবাকে ঘুমের মধ্যেই নেড়ে-চেড়ে দেখা শুরু করলো। খেয়া বাধা দিয়ে বল্লো, সে ঘুমাচ্ছে, তাকে ঘুমোতে দিন।

তারা বিজ্ঞের মত বললো, তোমার বাবা কোনো রেসপন্স করছে না কেন?

খেয়া বললো, তার মানসিক অবস্থা এবং এর কারণে চলা মেডিকেশনের জন্যে, তার ঘুম এরকম হয়ে গিয়েছে। আমি তাকে এভাবে ঘুমোতে দেখতে অভ্যস্ত।

তারা, মেডিকেশন্স-এর কাগজ পত্র দেখতে চাইলো।

এগুলো সবসময় খেয়া প্রস্তুত রাখে, দেখানো হলো।

ইতোমধ্যে, যাত্রীদের মধ্যে থেকে একজন পেশাদার ডাক্তার অ্যানাউন্স করে আনা হলো। বাবার প্রেশার, ডায়াবেটিস সব চেক করা হলো। সব ঠিক আছে। ডাক্তারের কাছ থেকে জানা গেলো, এয়ার ক্র্যাফট টীম আশংখা করছে এটা খিঁচুনির সিম্পটম কিনা। ডাক্তার তাকে জিজ্ঞেস করে এর আগে এরকম কিছু ঘটেছে কিনা।

খেয়া প্রতিবাদ করে বলে, আমার বাবার এখন পর্যুন্ত খিঁচুনি বা এই টাইপ কোনো সমস্যা হয় নাই। যেহেতু তিন বছর আমি তাকে পুরোপুরি টেক-কেয়ার করছি আমি তার মধ্যে কোনরকম অ্যাবনরমাল সাইন দেখতে পাচ্ছি না। সে স্রেফ ঘুমাচ্ছে আর কিছুই না। সে আরো বলে, তিন বছর যাবত নিয়মিত আন্টি ডিপ্রেশন, পারকিনসন্স ও অন্যান্য এন্টি অ্যাংযাইটি ড্রাগের কারণে তার ঘুম কিছুটা অস্বাভাবিক রকমের গাঢ় হয়ে গিয়েছে। ব্যাস!

তারপরেও তাদের সন্তুষ্ট মনে হলো না। কাগজে ডিটেলস রিপোর্ট নেয়া শুরু করলো। শেষে বলল তোমার বাবাকে ল্যান্ডিং-এর পর এয়ারপোর্ট ক্লিনিকে নেয়া হবে। সেখানে দেখা হবে সে ফারদার ফ্লাইটের জন্য ফিট কিনা।

পিয়াস জিজ্ঞেস করল, আমাদের চার ঘণ্টা পর নেক্সট কানেক্টিং ফ্লাইট, এর মধ্যে সব হবে কিনা?

এয়ারহোস্টেসটি মুখে হাসি টেনে বললো, আশা করছি, এটা শুধু একটা রেগুলার ফিটনেস চেকআপ। যদি ক্লিনিক থেকে বলা হয় তিনি নেক্সট ফ্লাইটের জন্যে সম্পূর্ণ ঠিক আছেন তাহলে তোমরা অবশ্যই কানেক্টিং ফ্লাইটটা পাবে নাহলে তোমাদের অপেক্ষা করতে হবে তার সুস্থ্য হওয়া অব্দি।

পিয়াস কে কিছুটা চিন্তিত মনে হলো। দুবাই থেকে তাদের গন্তব্য লন্ডনের গ্যাটউইক এয়ারপোর্ট সেখানে হোটেল বুকিং দেয়া আছে। কিন্তু সমস্যা সেটা না, সমস্যা হলো পুরো প্ল্যানটা সেভাবেই সেট করা ছিলো, লন্ডনে পৌঁছানোর পরদিন সকাল দশটায় তার অফিসের জরুরি কনফারেন্স, এখানে শিডিউল উল্টাপাল্টা হলে হয়তো সেটা মিস হয়ে যাবে। বিষয়টিকে বাড়ানো হচ্ছে অহেতুকভাবে, কিন্তু কিছুই করার নাই। মানুষটাকে তিন বছর ধরে কাছ থেকে দেখছে পিয়াস, তার সমস্যা শুধু ভুলে যাওয়া, যে কারণে মাঝে মাঝে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে নিজে থেকেই, এই ভুলে যাওয়াটা দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। নিজের কোনো কাজ সে এখন আর করতে পারে না। বিষয়টা এমন যে, এক পা এগিয়ে পরের পা তুলতে সে ভুলে যায়। কিন্তু তারপরেও শারীরিকভাবে সে সম্পূর্ণ সুস্থ। এই বয়সী যেকোন আর দশটা মানুষের থেকে নিঃসন্দেহে সে সুস্থ একটা মানুষ - প্রেসার, হাই কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিসের মত সমস্যাগুলো তার নেই, এমনকি সাধারণ সর্দিজ্বরে ভুগতেও তাকে কম দেখেছে পিয়াস। হয়তো ভুলে যাওয়ার এই রোগ তার নিত্যনৈমিত্তিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে অনেক, এক্ষেত্রে আচরণগত কিছু পরিবর্তনও অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু তা কখনো অন্যের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি।

............

ল্যান্ডিং এর পর ইমার্জেন্সি প্যাসেঞ্জারের স্পেশাল এ্যাম্বুলেন্স করে তাদের এয়ারপোর্ট ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে সব কিছু চেক করে জানানো হলো তিনি ঠিক আছেন, কোনো অস্বাভাবিকতা তারাও পেলেন না। যদিও তখনো তিনি ঘুমের মধ্যেই আছেন। ক্লিনিক থেকে একজন ইন্ডিয়ান ডক্টর জিজ্ঞেস করলো, তোমাদের পরের ফ্লাইট কখন?

পিয়াস উত্তর দিলো, রাত বারোটায়।

ডক্টর বলল, এখন বাজে ন'টা। তার মানে এখনো তিন ঘন্টা বাকি আছে। উনি তো এখন ঘুমোচ্ছেন, এখন টানাটানি না করে, ঠিক এক ঘন্টা আগে নিয়ে গেলেও হবে। এখান থেকে ডাইরেক্ট তাকে বোর্ডিং গেটে পৌঁছে দেয়া হবে। তোমরা চাইলে এয়ারপোর্ট-এর ক্যাফে শপগুলো থেকে ঘুরে আসতে পারো, ঠিক উপরের ফ্লোরেই। খেয়া বাবাকে রেখে যেতে চাইলো না।

পিয়াস মেয়েকে নিয়ে গেলো উপরে, তাকে কিছু খাওয়ানো দরকার। এইসব ঝামেলার মাঝে তাদের মতো মেয়েটারও রাতের খাওয়া হয়নি।

খেয়া লম্বা করিডোরের পাশে পাতা চেয়ারগুলোতে বসে ভাবতে থাকে - বাবার ডায়াপারটা বোধহয় পাল্টানো দরকার, ঘুম থেকে উঠলে কি খেতে দেবে তাকে, সেই কোন বেলা খেয়েছে!

কেন জানি হসপিটালের ভেতর অপেক্ষা সব সময় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর লাগতে থাকে, দুঘন্টা সময় যেন দু যুগের সমান দীর্ঘ হয়ে অবশেষে শেষ হলো।

নিয়ম অনুযায়ী হুইল-চেয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট এসে তাদের নিয়ে গেলো। ডিজেবলদের জন্যে এয়ারপোর্টগুলোতে বিশেষ এক রকম ব্যাটারীচালিত গাড়ির ব্যবস্থা থাকে। তিতির সে গাড়ি দেখে মহা আনন্দে আগেই সেখানে চড়ে বসে, পিয়াস আলাদা হয়ে যায় তাদের থেকে। বোর্ডিং-এর জন্যে তাদের নির্দিষ্ট গেটে আনা হয়। তারা সেখানে পিয়াস এর জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। এর মধ্যে বাবার সে গাঢ় ভয়ঙ্কর ঘুম পুরো হয়েছে। সে বড় বড় চোখ করে এদিক ওদিক দেখছে। কিছুটা অস্থির মনে হয় তাকে। হুইল চেয়ার থেকে বার বার উঠে হাঁটতে চাচ্ছে। বিশাল বড় এয়ারপোর্টের এক মাথায় তাদের বোর্ডিং গেট। পিয়াসের হেঁটে আসতে বেশ অনেকক্ষণ লেগে যায়। হুইল-চেয়ার আরোহী বলে সবার আগে তাদের যেতে দেয়া হয় ভিতরে। টানেলের শেষ মাথায় প্লেন এর দরজায় যেখানে এয়ারহোস্টেসরা হাসি মুখে যাত্রীদের অভ্যর্থনা জানায়, সেখানে দেখা গেলো একজন এয়ারহোস্টেস বাবার নাম আর ডিটেলস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

সে ঢোকার মুখে তাদের থামিয়ে দিয়ে বলে, এক্সকিউজ মি স্যার, তিনি কি মি. জহুরুল হক? যিনি লাস্ট ফ্লাইটে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।

পিয়াস জবাব দিলো, হ্যাঁ, কিন্তু তিনি অসুস্থ ছি্লেন না। ঘুমিয়ে ছিলেন।

এয়ার হোস্টেজ বললো, তিনি পুরো প্লেনে কোনো রেসপন্স করেননি, অস্বাভাবিক ছিলেন, আমাদের কাছে রিপোর্ট আছে।

পিয়াস, আমরা মাত্র তাকে এয়ারপোর্ট ক্লিনিক থেকে নিয়ে আসলাম, সেখান থেকে বলা হয়েছে তার কোন সমস্যা নেই, তিনি ফ্লাই করতে পারবেন।

প্লিজ আপনারা এখানে একটু অপেক্ষা করুন, আমি ক্যাপ্টেনের সাথে কথা বলে আসছি। বলে সে ভেতরে চলে গেলো।

অন্য একজন এসে বলল, আপনারা একটু সাইড হয়ে দাঁড়ান। যাত্রীদের ভেতরে নেয়া হবে।

তারা অপেক্ষা করতে লাগলো, একে একে অন্যযাত্রীরা যার যার মতো ভেতরে যেতে লাগলো। তা দেখে তিতির কান্না শুরু করে দিলো। তার একটাই প্রশ্ন - আমাদের কেন যেতে দিচ্ছে না? বাবাকে ততক্ষণে কিছুতেই হুইল-চেয়ারে বসিয়ে রাখা যাচ্ছে না, সে উঠে হাঁটতে চায়।

প্রায় আধ ঘন্টা পর সেই এয়ারহোস্টেসটি ফিরে এসে বলল, সরি স্যার আমি কোনোভাবেই ক্যাপ্টেনকে কনভিন্স করতে পারলাম না। তিনি আগের ফ্লাইটের ক্যাপ্টেনের সাথে যোগাযোগ করেছেন, এবং তিনি বলেছেন আপনার বাবা ফ্লাই করতে পারবে না।

পিয়াস কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, তিনি তো পাইলট, ডক্টর না। কেমন করে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারে কে ফ্লাই করার জন্য ফিট কে ফিট না!

তারপর এয়ারহোস্টেস যা বললো, তা হলো - একটা ফ্লাইটে ক্যাপ্টেন হলো প্রধান যেমনটা একটা দেশে একজন রাজাই প্রধান। ক্যাপ্টেন তার এয়ার ক্র্যাফটের স্বার্থে ছোট বড় যেকোন রকম সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা রাখেন। এবং যা অন্যরা মেনে নিতে বাধ্য।

আমি অন্তত একবার ক্যাপ্টেনের সাথে কথা বলতে চাই। আমি তাকে বলতে চাই প্লিজ একবার এসে দেখুন যে মানুষটা আগের ফ্লাইটে অচেতন ছিলো বলে আপনারা ভাবছেন সে এখন দিব্যি হেঁটে বেড়াচ্ছে। তিনি কথা বলতে ভুলে গিয়েছেন, হয়তো একজন স্বাভাবিক মানুষের মত আচরণ করতেও ভুলে গিয়েছেন, কিন্তু তারপরেও তার নিজস্ব একটা ভাষা আছে। আর একজন মানুষ হিসেবে যেটা বোঝা কারো জন্যে খুব বেশী কষ্টের নয়! প্লিজ, ডোন্ট বি "কমফরটেবলি নাম্ব"! - অস্থিরতা ফুটে উঠে পিয়াসের গলায়।

এয়ারহোস্টেসটি কিছুটা সহানুভূতির স্বরে বললো - এটা সম্ভব নয়, আমি আপনার হয়ে চেষ্টা করেছি, আমাকে বিশ্বাস করুন। আপনি বরং এয়ারলাইন্স এজেন্টের সাথে যোগাযোগ করুন, তারা হয়ত আপনাকে কোন হেল্প করতে পারে। আমি আপনাদের জন্যে পুরো ফ্লাইটটি দাঁড়িয়ে রাখতে পারি না। আমি এজেন্টকে কল করে ডেকে দিচ্ছি এর বেশি আমি কিছু করতে পারবো না। আমাকে মাফ করবেন।

অনেক ধন্যবাদ! বিস্ময় স্পষ্ট ফুটে উঠে পিয়াসের স্বরে।

............

এর পরের ঘটনা-

পিয়াস দুজন এজেন্টের সাথে মেডিকেল সেন্টার, পরবর্তী ফ্লাইট বা অন্য কোন ফ্লাইটের টিকেটের উদ্দেশ্যে যায়।

তিতির খেয়ার কোলে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে, তাদের নিয়ে আসা হয় ডিজেবল লাউঞ্জে। রেফ্রিজারেটরের মত ঠাণ্ডা লাউঞ্জটিতে শোয়ার চেয়ারগুলো আগে থেকেই দখল হয়ে ছিলো। খেয়া তিতির কে কোনমত হ্যান্ড ব্যাগ আর একটা কম্বল দিয়ে শক্ত চেয়ার এর উপর শুইয়ে দেয়।

আর বাবা, পুরো লাউঞ্জটিতে বিক্ষপ্তভাবে সে হেঁটে বেড়াচ্ছে, তার অবচেতন মন যা এখনো তাকে সংকেত দেয় কোন অজানা ভাষায়, বলছে, কোথাও কোন সমস্যা হচ্ছে, হয়তো এর জন্যে সে দায়ী। এই ভাবনা তাকে অস্থির করে তুলছে। সে ঠিক বুঝতে পারে কিছু একটা এমন হচ্ছে যা এরকম হবার কথা না। কিন্ত সে জানে না কিভাবে সেটা ঠিক করবে। ভিতরে ভিতরে আরো অস্থির হতে থাকে, কারণ তার চিন্তাগুলো, তার হিসেবগুলো কোথায় যেন শুধু জট পাকিয়ে যায়। অনরবরত চেষ্টা করে সে জট খোলার, কিন্তু সব কেমন ক্রমে আরো গুলিয়ে যেতে থাকে।

খেয়া এসে বাবার হাত ধরে, বাবা অস্পষ্ট ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলতে থাকে - খুকু, হচ্ছে না, পারছি না!

খেয়ার চোখ দিয়ে অবশেষে জল গড়িয়ে পড়ে! সব সময় স্রোত ধরে রাখা কাজের কথা নয়। খালামণি বলেছিলো - খেয়া মা আমার, তোর কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছি না, তোর বাবাকে আমার কাছে রেখে যা, আমি তার সব রকম যত্ন নেব, প্রয়োজনে একজন আলাদা লোক রাখব তার জন্য।

খেয়া বলেছিলো - যারটা তাকেই করতে দেও না খালামণি। বাবাও তো তার সব শক্তি দিয়ে আমাদের পেলেছে, কষ্টের ভয়ে তো আমাদের অন্য কারো কাছে দিয়ে দেয়নি।

"আই ওয়ান্ট টু সি অল দা মারভেলস অফ দা ওয়ার্ল্ড কিপিং দা অয়েল ইন দা স্পুন।"

...............


(কিছু বাস্তবতা গল্পের মত করে সাজানোর চেষ্টা করলাম, চরিত্রগুলো সব কাল্পনিক। খুব বেশী বড় হয়ে গেলো, খণ্ডাইতে ইচ্ছা করলো না। তারপরেও আদৌ কিছু বলা হলো কিনা জানিনা!)